“আমি নিরালায় একা খুজেঁ ফিরি তারে, স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণ আমার আমিরে.........” অপু লঞ্চের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। বুড়িগঙ্গার কালো কুচকুচে কালো পানি দেখছে। অনেক বিখ্যাত লোকের পুরান ঢাকার স্মৃতিচারণমূলক লেখায় সে পড়েছিলো বুড়িগঙ্গা পাড়ের নির্মল হাওয়ার কথা, বুড়িগঙ্গা্র স্বচ্ছ পানির কথা, কিন্তু অপুর মনে পড়ে না সে কখনো কালো কুচকুচে পানি ছাড়া অন্য কিছু দেখেছে কি না। একটু দূরে ডকে দাঁড়িয়ে এক ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে ঝাল মুড়ি খাচ্ছে। টার্মিনালের উপর সারি সারি ফলের অস্থায়ী দোকান, আম, আপেল, আঙ্গুর আরো কত কি।
অসংখ্য মানুষের এখানে ওখানে ছোটাছুটি, যে যার নির্দিষ্ট লঞ্চ খুঁজে নিয়ে লঞ্চের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। কেউ কেউ নৌকায় করে ওই পাড় থেকে এসে নৌকা থেকে সরাসরি লঞ্চে উঠছে। অসংখ্যবার দেখা এইসব পুরানো দৃশ্য কেনো যেনো আজ অপুকে বিষন্ন করে তুলছে।
একটানা কিছুক্ষন হর্ন বাজিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে লঞ্চ ছেড়ে দিলো। আস্তে আস্তে সদর ঘাট দূরে সরে গেলো।
সন্ধ্যার হিমেল বাতাস অপুকে স্পর্শ করা মাত্রই সে কেবিনে ঢুকে গিয়ে ব্যাগ থেকে শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীন’ বইটি বের করে পড়া শুরু করলো। অনেকবার পড়া এই বইটি অপুর খুব প্রিয় একটি উপন্যাস। কিন্তু এর আগে যতবারই সে পড়েছে, তারচেয়ে আজ যেনো আরো খুব বেশী আবেগী হয়ে উঠছে। ধ্রুব আর ওর বাবার মানসিক দ্বন্দ্ব পড়তে পড়তে কখন যে রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে, অপু সেটা খেয়ালই করেনি। লঞ্চের খাবারের ছেলেটা এসে দরজায় নক করে যখন জিজ্ঞেস করলো কি খাবে, কোনো সময় না নিয়ে বলে ফেললো ডাল চর্চরি আর রুই মাছ।
একটু পরে আনমনেই হেসে উঠলো, অপু আসলে কখনো মাছ খায়না। কাঁটা বাছতে খুব কষ্ট হয় বলে মাছ খাওয়া তার কখনো হয়ে উঠেনি, অথচ নদী পথের যাত্রায় কেনো যেনো সবসময় মাছই ভালো লাগে। ছেলেটি যখন খাবারের সাথে একটু জলপাইয়ের আচার নিয়ে আসলো মনে মনে অপু খুব খুশিই হয়ে উঠলো।
খাওয়া শেষ করে অপু আবার বাইরে এসে দাঁড়ালো। লঞ্চ যেমন নদীর জলরাশিকে দুই দিকে কেটে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি রাতের দূরন্ত বাতাসও অপুর চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে।
আজ বোধহয় পূর্নিমা নয়, তারপরও অর্ধাচন্দ্রাকৃ্তি চাঁদকে খুব একটা খারাপ লাগছে না। এই চাঁদের আলোতেই মাঝ রাতের অন্ধকারকে ভেদ করে কিছুটা দূরে ছোট ছোট মাছ ধরা নৌকা দেখা যাচ্ছে ঢেউয়ের তালে উঠছে আর নামছে। নৌকার ভিতর থেকে আসা হারিকেনের ম্লান আলো দেখতে দেখতে অপুর কাছে হঠাৎ করে ইঞ্জিনের মৃদু গুমগুম শব্দটাকেও খুব মায়াময় মনে হচ্ছে। বরঞ্চ মাঝে মাঝে লঞ্চের একেবারে সামনের সার্চলাইটের আলো-ই ওকে বিরক্ত করে তুলছে।
কি মনে করে অপু লঞ্চের ছাদের উপরে উঠলো।
কাউকে দেখতে পেলো না। ছাদটির ঠিক মাঝখানে সে বসে পরলো। লঞ্চের মৃদু দোলায়, বাতাসের সুরেলা শব্দে, চাঁদের সূর্য থেকে ধার করা আলোয় অপু হঠাৎ করেই ডুকরে কেঁদে উঠলো, ওর বুকের ভিতরটা এক অব্যক্ত যন্ত্রনায় মোচড় দিলো।
অপুর অনেক কথাই মনে পড়ছে। কিছুদিন আগেও যখন এভাবে ওর বাবার সাথে গ্রামের বাড়িতে যেতো, অপুকে কখনই এই মাঝরাতে ওর বাবা ছাদে উঠতে দিতেন না।
কেবিন থেকে বের হলেই বলতেন ঠান্ডা লাগবে। লঞ্চের সবাই ওর বাবাকে চিনতো বঙ্গোপসাগরের পাশে এক দ্বীপের সবচেয়ে বড় সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে, খুব খাতির করতো লঞ্চের লোকেরা। সেই খাতিরের একটু আধটু ছিটে ফোঁটা অপুও তখন পেতো। অপুর বাবা ওকে বলতেন, ‘দেখ্ দেখ্, এদেরকে চিনে রাখ্, আমি যখন থাকবো না, তখন এরাই কাজে লাগবে’। না, এরা আজ কোনো কাজেই আসেনি, কেবিন খালি থাকা সত্ত্বেও অতিরিক্ত টাকা দিয়ে অপুর কেবিন পেতে হয়েছে।
অপুর বুক টা আবার হু হু করে কেঁদে উঠলো।
অপু যখন ওর বাবার সাথে গ্রামে যেতো, লঞ্চ যখন ঘাটে ভিড়তো, দেখতো গ্রামের অনেক লোক এসেছে ওর বাবাকে নিয়ে যেতে, উপজেলার ইউএনও পাঠিয়ে দিতেন তাঁর গাড়ি, ওসি আসতেন ফোর্স নিয়ে। এত এত লোকজনের ভিড়ে, অনেক পিছনে পরে থাকা, ওদের বাড়ির ম্যানেজার নিজাম কাকাকে দেখাই যেতো না।
অপুর গ্রামের বাড়িতে সবচেয়ে ভালো লাগে ওদের বাড়ির পাশের পাটগাছের বাগানটাকে। ছোটবেলায় ও যখন গ্রামে আসতো, দিনের বেশিরভাগ সময় পাট বাগানে থাকতো, আর বাগানের ফাঁকে ফাঁকে থাকা বেত গাছের ছোট্ট সবুজ দানার মতো ফল লবণ-মরিচ দিয়ে খুব মজা করে খেতো।
বাড়ির পিছন দিকের ধান ক্ষেতগুলো যখন নদীর জোয়ারের পানিতে ডুবে যেতো, তখন ওর সমবয়সী ছেলেদের সাথে যেতো বরশি দিয়ে মাছ ধরতে, অপুর বরশিতে বেশির ভাগ সময়ই ধরা পরতো কাঁকড়া, ছোট ছোট কাঁকড়া।
একবার এক মজার কান্ড ঘটলো। অপুর বয়স তখন আট কি নয়, সে সাঁতার জানতো না। কিন্তু গ্রামের তিন বছরের পিচ্চিও দৌড়ে এসে পুকুরে ঝাপ দিয়ে সাঁতার কাটা শুরু করতো। অপুর মনে হলো সেও যদি দৌড়ে এসে পুকুরে ঝাপ দেয়, তাহলে সাঁতরাতে পারবে।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। দূর থেকে দৌড়ে এসে পুকুরে ঝাপ এবং হাবুডুবু খেতে খেতে পুকুরের নিচে তলিয়ে যাওয়া। সে যাত্রায় সেই ছোট ছোট পিচ্চিদের জন্যই ওর প্রাণ রক্ষা হয়েছিলো।
অপুর ভালো লাগতো ধান কাটার মৌসুম আর শীতকালে গ্রামে আসতে। বর্গাচাষীরা ধান কেটে এনে বাড়ির সামনে মাচা বানাতো।
সব ধান কাটা হয়ে গেলে গরু দিয়ে ধান মাড়াই হতো। অপুও গরুগুলোর পিছনে পিছনে ধান মাড়াই করতো, লুটোপুটি খেতো, আর সারারত চুলকানিতে ঘুমাতে পারতো না। শীতকালে সবচেয়ে ভালো লাগতো সকাল বেলায় খেঁজুর গাছের কাঁচা রস খেতে। এই সময়টাতে সে দেখতো বাড়ির উঠানে বিশাল বিশাল মাটির চুলা তৈরী করে টিনের বিশাল বিশাল পাতিলে কাচা রসকে জ্বাল দিয়ে খেজুরের রসের গুড় তৈরি করা হতো। সেই গুড় দিয়ে এরপরে শীতের পিঠা খাওয়া হতো।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই অপুর খেয়াল হলো পুব আকাশে সূর্য উঠি উঠি করছে। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই লঞ্চ ওদের গ্রামের ঘাটে ভিড়বে। অপু ছাদ থেকে নেমে কেবিনে ঢুকে গেলো। কেবিনে ঢুকেই বিছানাতে ‘দূরবীন’ দেখে ধ্রুব-এর শেষ কথা মনে পড়ে গেলো, ধ্রুব-এর মতোই অপু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, ‘বাবা’।
অপু লঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
দূর থেকে ওদের গ্রামের ঘাট দেখা যাচ্ছে। সেই ঘাটে শুধুমাত্র ওদের বাড়ির ম্যানেজার নিজাম কাকা ছাড়া আর কেউ অপুর দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।