আমার বিদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে। দেশ নিয়ে খুব চিন্তায় আছি ঢাবি ছাত্র আবদুল কাদেরকে কেন ক্রসফায়ারে দেয়া হলো না- এ নিয়ে খিলগাঁও থানার ওসি হেলাল উদ্দিন এসআই মোহাম্মদ আলম বাদশাকে শাসিয়েছিল। বলেছিল- শালাকে রাস্তায় ক্রসফায়ার দিলি না কেন? জবাবে এসআই বাদশা বলেন, স্যার আপনার হুকুম পাইনি। কাদের ১৫ই জুলাই রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ১৬ই জুলাই সকাল ১০টার দিকে ওসি কাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যান। কাদের এ সময় নিজেকে ঢাবি’র ছাত্র পরিচয় দেয়া মাত্রই ওসি রাগান্বিত হয়ে এ কথা বলেন।
এরপর চলে তার ওপর নির্মম নির্যাতন। গতকাল কাদেরকে পরিবারের সদস্যরা দেখতে গেলে তিনি তাদের এ কথা জানান। পরিবারের সদস্যরা জানান, কাদেরকে গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত কোন ধরনের খাবার দেয়া হয়নি। কাদের সকালের নাস্তা করেছেন অন্য এক আসামির দেয়া খাবার দিয়ে। কাদেরের সঙ্গে দু’দফা তার মা মনোয়ারা বেগম, কাদের যে ছাত্রীকে পড়ান তার মা লুৎফুন্নাহার, বোন জান্নাতুল মাওয়া ও আরও কয়েকজন দেখা করতে যান।
এ সময় কাদের তার ওপর নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেন। কাদেরের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, বৃহস্পতিবারের চেয়ে কাদেরের অবস্থা একটু ভাল। এখন খাবার-দাবার করছে। ছেলেটা পড়ালেখা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সামনে পরীক্ষা।
হঠাৎ করে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। পুলিশকে নিজের পরিচয় দেয়ার পরও নির্যাতন থামেনি। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয় দেয়ার পর তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। তিনি বলেন, আমার ছেলে নিরপরাধ দাবি করার পরও পুলিশ তাকে ডাকাত বানানোর চেষ্টা করেছে। আমি এ ঘটনার বিচার চাই।
তিনি বলেন, পুলিশ একজন ছাত্রকে কেন ডাকাত বানাতে চাইলো। কাদেরের ছাত্রীর মা লুৎফুন্নার বলেন, কাদের অনেক কিছুই আদালতে বলতে পারেনি। সামনে তার পরীক্ষা। ভাল করে খেতেও পারছে না। কেন তার ওপর এ ধরনের নির্যাতন হলো তা নিয়েই ভাবছে।
কাদেরের ছোট বোন জান্নাতুল মাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। তিনি বলেন, আমার নিরপরাধ ভাইয়ের ওপর পুলিশ নির্যাতন করেছে। আমার ছোট বোন ফারজান আক্তার ইন্দিরা গান্ধি বৃত্তি পেয়েছে। ১৫ই জুলাই বিকেল পাঁচটায় ভাইয়া (আবদুল কাদের) আমাদেরকে গুলশানের ইন্দিরা গান্ধি কালচারাল সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখান থেকে হলি ফ্যামিলি স্টাফ কোয়ার্টারে খালার বাসায় আসতে আসতে রাত সাড়ে ১০টা বাজে।
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে ভাইয়া হলের দিকে রওনা দেয়। তারপর তার বন্ধুরা আমাদের জানায় পুলিশ তাকে আটক করেছে। তিনি আরও বলেন, মা ভাইয়াকে যেতে নিষেধ করেছিল রাস্তায় সমস্যা হতে পারে এই ভেবে। ভাইয়া তখন বলে আমার সঙ্গে তেমন কিছুই নেই, একটি কমদামি মোবাইল আছে। বড়জোর ছিনতাইকারীরা মোবাইলটা নিতে পারে।
এই বলে তিনি হলের উদ্দেশে রওনা দেন।
কাদেরের রুমমেট ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ছাত্র মুক্তাদির হাসান বলেন, সকালে আমাকে আনিস (কাদেরের বিভাগের বন্ধু) ফোন করে বলে দেখতো কাদের রুমে আছে কি না? তখন দেখি কাদের নেই। রাতেও রুমে ছিল না। তখন আনিস আমাকে জানায় কাদের খিলগাঁও থানায় গ্রেপ্তার আছে। আমি ও রাফি (কাদেরের অপর বন্ধু) শনিবার সকাল ১০টার দিকে খিলগাঁও থানায় যাই।
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কাদের গ্রেপ্তার হতে পারে। দেখা করার সঙ্গে সঙ্গেই সে কেঁদে দেয়। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কাদেরের পরনে ট্রাউজার ছিল। শারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন।
মুক্তাদির বলেন, এখন পায়ে যে আঘাতের চিহ্ন শনিবার সকালে তা আমি দেখতে পাইনি। আমার ধারণা সকাল ১০টার পর থানাতেই তার পায়ে নির্মমভাবে পুলিশ আঘাত করেছে। কাদেরের বিভাগের বন্ধু আনিসুর রহমান বলেন, শনিবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে কাদের নামে কাউকে চিনি কি না। আমি জিজ্ঞেস করি কেন, কি হয়েছে। তখন ওই ব্যক্তি আমাকে বলেন, কাদের গ্রেপ্তার হয়েছে।
আমি ঠিকানা নিয়ে মুক্তাদিরকে জানাই। আনিস আরও বলেন, আমিসহ আরও কয়েকজন রোববার আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাদেরকে দেখতে যাই। এ সময় পুলিশ আমাদের প্রথমে কাছে যেতে দেয়নি। একপর্যায়ে যেতে দিলেও এক থেকে দেড় মিনিট পরই সরিয়ে দেয়। আবদুল কাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের ২০২ নম্বর কক্ষে থাকতেন।
তার বাড়ি কুমিল্লার বুড়িচং গ্রামে। বাবা মুহাম্মদ আব্দুর রউফ কুমিল্লার দেবিদ্বারের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা শিক্ষা অফিসার। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ছয় ভাইবোনের মধ্যে আবদুল কাদের তৃতীয়।
৩ মামলায় কাদেরের
জামিন আবেদন
গাড়ি ছিনতাইয়ের মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরের জামিন আবেদনের শুনানি হবে আগামী সোমবার।
এছাড়া ডাকাতির প্রস্তুতি ও অস্ত্র আইনের দুটি মামলায় তার জামিনের বিষয়ে বুধবার শুনানি হবে।
কাদেরের পক্ষে এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ও মুনজুর আলম মঞ্জু গতকাল জামিনের আবেদন করলে ঢাকার মহানগর হাকিম মো. আবদুল কাদের এ তারিখ দেন। ছিনতাইয়ের প্রস্তুতির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের স্নাতকোত্তর বর্ষের ছাত্র কাদেরকে গত ১৫ই জুলাই খিলগাঁও বিশ্বরোড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঢাবি শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তার এ গ্রেপ্তার হয়রানিমূলক। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করছে তারা।
থানায় কাদেরের ওপর পুলিশি নির্যাতনেরও অভিযোগ তুলেছেন তার মা মনোয়ারা বেগম। অভিযোগ উঠেছে, কাদেরের ওপর নির্যাতনে মোহাম্মদপুর থানার ওসিরও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
এ নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তের জন্য হাইকোর্ট আইন মন্ত্রণালয় ও পুলিশ বিভাগকে দুটি তদন্ত কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া খিলগাঁও থানার ওসি হেলালউদ্দিন এবং কাদেরকে গ্রেপ্তারের অভিযানে যাওয়া এসআই আলম বাদশাহ ও এএসআই শহীদুর রহমানকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাময়িক বরখাস্ত করার জন্য পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আদালতের আদেশে গত বৃহস্পতিবার কাদেরকে হুইল চেয়ারে করে আদালতে উপস্থিত করা হয়।
পুলিশি নির্যাতনের বিবরণ দিতে গিয়ে কাদের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চকে বলেন, তাকে গ্রেপ্তার করে খিলগাঁও থানায় নেয়ার পর পেটানোর এক পর্যায়ে ওসি নিজ হাতে চাপাতি দিয়ে তার পায়ে কোপ দেন।
খিলগাঁও থানার ওসি ‘মামলা সাজানোর’ চেষ্টা করেছেন মন্তব্য করে তীব্রভাবে তাকে তিরস্কার করে আদালত। কাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে স্থানান্তর করে রাষ্ট্রীয় খরচে চিকিৎসা দিতে বলা হয় এবং কাদের বিচারের জন্য নিম্ন আদালতে গেলে তাকে যথাযথ বিচারিক সুবিধা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। হাইকোর্টের আদেশে বৃহস্পতিবার রাতেই কাদেরকে আদালত থেকে সরাসরি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের প্রিজন সেলে নেয়া হয়। কাদেরের আইনজীবী মুনজুর আলম মঞ্জু জানান, গত ১৫ই জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একটি ছিনতাই মামলায় ২১শে জুলাই কাদেরকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।
অথচ মামলার এজাহারে কাদেরের নাম নেই। এ মামলায় কাদেরের জামিনের আবেদনের শুনানি হবে সোমবার। গ্রেপ্তারের পর কাদেরের বিরুদ্ধে ডাকাতির প্রস্তুতি ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করে খিলগাঁও থানা পুলিশ। কাদের বা তার সহযোগীরা কোথায় ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সে বিষয়ে এজাহারে কোন তথ্য নেই। হাইকোর্ট অস্ত্র আইনের মামলার এজাহার দেখতে চাইলে বৃহস্পতিবার তাও দেখাতে পারেননি খিলগাঁও থানার ওসি।
এ দুটি মামলায় কাদেরের জামিন আবেদনের ওপর ৩রা আগস্ট মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে শুনানি হবে।
সুত্র: মানবজমিন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।