কি বলব দেশে এখন একের পর এক নৃশংস ঘটনা ঘটছে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নেয়ার পর গত আড়াই বছরে ৩৩৬ জন পিটুনিতে হত্যার শিকার হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশ ও র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৪১৯ জন। এ হিসাব দুটি মানবাধিকার সংগঠনের। এর বাইরেও ঘটছে নৃশংস খুন, নারী নির্যাতনের ঘটনা।
এসব নৃশংস ঘটনাকে স্বাভাবিক অপরাধ প্রবণতা বলে মানতে চাচ্ছেন না দার্শনিক ও সমাজ বিশ্লেষকরা। তারা ঘটনা বিশ্লেষণ করে এটাকে ফ্যাসিবাদী অপরাধ প্রবণতা বলে চিহ্নিত করছেন। তাদের মতে, রাষ্ট্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে কাউকে অপরাধী দাবি করে হত্যার যে সংস্কৃতি চালু করেছে তাতে জড়িত হয়ে সাধারণ মানুষও সঙ্ঘবদ্ধভাবে গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটানো অর্থাত্ আইন নিজের হাতে তুলে নিতেও দ্বিধা করছে না।
সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্র অপরাধের বিচার ও নাগরিকদের জানমাল রক্ষার কর্তব্য পালন করে না। বরং বিচার প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে অপরাধ দমনের নামে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বিনা বিচারে হত্যা ও নির্যাতন চালায়।
এক্ষেত্রে রাষ্ট্র যে কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী চিহ্নিত করে তার মানবাধিকার ও সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার হরণ করার সংস্কৃতি চালু করে। যা দ্রুত সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। তারা যে কোনো ব্যক্তিকে অপরাধী চিহ্নিত করে তার মানবাধিকার ও সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার হরণ করতে উত্সাহী হয়।
আড়াই বছরে র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অপরাধ দমনের নামে একের পর এক বিনা বিচারে মানুষ হত্যা ও গুম করার অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে পুলিশের হিসাবেই দেশে অপরাধ প্রবণতা না কমে খুন, ডাকাতি, দুর্ধর্ষ চুরি, অপহরণ, নারী নির্যাতন ও শিশু নির্যাতনসহ নানা অপরাধ ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে।
আর দেশজুড়ে জনমনে প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি আইন হাতে তুলে নিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পর্যবেক্ষণে বিনা বিচারে হত্যা ও দলবেঁধে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি মহাজোট সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর গত আড়াই বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে বিনা বিচারে নিহত হয়েছে ৪১৯ জন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ২২৯ জন, ২০১০ সালে ১৩৩ জন ও চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৫৭ জন নিহত হয়েছেন।
একই সময়ে জনগণেরও হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা বেড়েছে ব্যাপক হারে।
বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, গত আড়াই বছরে ১০ হাজার ৩৯৬ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৪২১৯ জন, ২০১০ সালে ৪৩১৫ জন ও চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১৮৬২ জন খুন হয়েছেন। আড়াই বছরে এসব খুনসহ ডাকাতি, দুর্ধর্ষ চুরি, অপহরণ, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, মাদক কেনাবেচাসহ মোট ৪ লাখ ৮০ হাজার ৫৪৫টি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ১ লাখ ৫৭ হাজার ১০৮টি, ২০১০ সালে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩৪টি ও চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৭৯ হাজার ৯০৩টি অপরাধের ঘটনা ঘটে।
এমন পরিস্থিতিতে দেখা গেছে, জনগণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় অভিযুক্ত অপরাধীদের আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে সোপর্দ না করে নিজেরাই বিচার করতে শুরু করছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্দেহভাজনদের ধরে গণপিটুনি দিয়ে হাত-পা ভেঙে দেয়া ও চোখ তুলে ফেলা হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্যমতে, গণপিটুনির এ ঘটনায় গত আড়াই বছরে ৩৩৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ১২৭ জন, ২০১০ সালে ১২৬ জন ও চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৭৫ জন গণপিটুনিতে নিহত হন। এছাড়াও ৬ জুলাই ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চরকুকরী মুকরিতে সাত জলদস্যুকে আটক করে জনগণ গণপিটুনি দিয়ে চোখ তুলে নিলে পুলিশের হেফাজতে লোকমান ও মোতাহার নামে দু’জন মারা যায়। ১৭ জুলাই শবেবরাত রাত সোয়া একটার দিকে ঢাকার আমিনবাজারের বরদেশী গ্রামের লোকজন ক্যাবলারচরে ৭ ছাত্রকে গণপিটুনি দেয়।
এতে তৌহিদুর রহমান পলাশ, ইব্রাহিম খলিল, কামরুজ্জামান কান্ত, টিপু সুলতান, মুনিফ ও শামস রহিম শামাম ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তারা সবাই ঢাকার বাঙলা কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি ও ম্যাপললিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র। প্রাণে বেঁচে যান নিহত ছাত্রদের বন্ধু আল-আমিন।
কাউকে অপরাধী দাবি করে হত্যা করাই এখন রীতি : কাউকে কোনো অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করলেও বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকার বিভাগের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেফতারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে (গ্রেফতারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে)’ হাজির করতে হবে। এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শিগগির নিজের মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার ও আত্মপক্ষ-সমর্থনের অধিকার দিতে হবে।
আর অপরাধ সংঘটনের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি সংবিধানের ৩৫ (৩) ও (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের’ অধিকার পাবেন। আর বিচারের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ‘নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা’ যাবে না।
কিন্তু বিনা বিচারে হত্যার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির, অভিযুক্তকে আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করা ও আদালত বা ট্রাইব্যুনালে প্রকাশ্য বিচার লাভের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থেকেই অভিযুক্তরা খুন হয়ে যাচ্ছে। খুন হওয়ার ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই নিহত ব্যক্তিকে ‘সন্ত্রাসী’ ‘চরমপন্থী’ ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ দাবি করছে।
দীর্ঘদিন ধরে সংবিধানের অধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিমাত্রই অপরাধী দাবি করে বিনা বিচারে তাদের নিহত হওয়ার ঘটনাকে যৌক্তিক করতে চেষ্টা করায় সাধারণ মানুষও মনে করছে যে, অপরাধী হলেই কাউকে হত্যা করা যায়।
গণপিটুনির বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করে পিটিয়ে মেরে ফেলার পরও কোনো ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দেখা গেছে, গণপিটুনি দিয়ে কাউকে ডাকাত, জলদস্যু বা সন্ত্রাসী দাবি করে মেরে ফেলার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এলাকার পুলিশও নিহত ব্যক্তিকে ডাকাত, জলদস্যু বা সন্ত্রাসী বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।
গণপিটুনিতে হত্যার অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে যে অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দোষ ছিলেন। গত ১৭ জুলাই গণপিটুনিতে নিহত ৬ ছাত্রকে স্বজন ও সতীর্থরা নির্দোষ দাবি করায় এ বিষয়টি এখন সারা দেশেই আলোচিত হচ্ছে।
কিন্তু আগের ঘটনাগুলোতে দেখা গেছে, নিহত ব্যক্তিকে নির্দোষ দাবি করা হলেও তাদের স্বজনরা গণপিটুনির ঘটনায় কোনো বিচার পায়নি। এর ফলে গণপিটুনির নামে অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। যার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধীচক্র ও পুলিশের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর বাজার এলাকায় বৃহস্পতিবার রাতে চুরি যাওয়া ট্রাক খুঁজতে গিয়ে স্থানীয় অপরাধীচক্রের গণপিটুনির শিকার হন উত্তরখানের ৯ জন ব্যবসায়ী ও শ্রমিক। তাদের মধ্যে আরজু ও সিরাজুল ইসলাম নামের দু’জন নিহত হন।
কিন্তু নিহতদের ট্রাকচোর সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে ডাকাত বলে পিটিয়ে হত্যা করেছে অভিযোগ করে নিহতদের স্বজনরা দুইজনের লাশ নিয়ে উত্তরখানে বিক্ষোভ করেছিল।
একই বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের হাজতি ১৬ বছরের কিশোর সাগর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যায়। তার মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের দাবি ছিল, ছিনতাইয়ের সময় সে গণপিটুনিতে আহত হয়ে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা গেছে। কিন্তু সাগরের মা লুত্ফা বেগম অভিযোগ করেন, তাকে ২৫ নভেম্বর রাতে গ্রেফতার করে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ। ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতে তার কাছে থানার এসআই শাহীন উদ্দিন ফোন করে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে যেতে বলেন।
দরিদ্র লুত্ফা এত টাকা দিতে না পারার কথা জানালে এসআই শাহীন ও সেকেন্ড অফিসার মাজহারুল ইসলাম তাকে বলেন, ২০ হাজার দিলে হালকা মামলা দিয়ে চালান দেয়া হবে। তিনি ৩ হাজার টাকার বেশি দিতে না পারায় চারজন ছিনতাইকারীর সঙ্গে সাগরকে ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালতে চালান দেয়া হলে আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হলে ২৯ নভেম্বর তাকে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় সে মারা যায়।
সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত : বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে মানুষের জীবনের অধিকারকে সর্বোচ্চ অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
কোনো অবস্থাতেই এ অধিকারকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাধারণ মানুষ হরণ করতে পারে না। কিন্তু সম্প্রতি অপরাধ প্রবণতার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতা না রাষ্ট্র, না জনগণ কেউই মানছে না। আইন না মানার ঘটনার কোনো বিচারিক প্রতিকারও হচ্ছে না।
কেন বাড়ছে ফ্যাসিবাদী অপরাধ : দার্শনিক ও মানবাধিকার কর্মী ফরহাদ মজহার পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনাকে শুধু সাধারণ মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসেবে মানতে চাননি। তার মতে, এখন দেশে ফ্যাসিবাদের কালচার চলছে।
যার সঙ্গে শুধু জনগণই জড়িত নয়, গণমাধ্যমসহ সমাজের সবাই জড়িয়ে পড়ছে। সবাই জুডিশিয়ারিকে কাজ করতে না দিয়ে নিজেরাই আগে বিচার করছে। এ ব্যাপারে তিনি গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘গণমাধ্যম সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে অভিযুক্তদের অপরাধী সাব্যস্ত করছে। যা বিচার বিভাগের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে।
বিনা বিচারে হত্যা ও পিটিয়ে মানুষ মারাকে আইনবহির্ভূত হত্যা আখ্যায়িত করে তিনি রাষ্ট্র ও জনগণের ভূমিকার ব্যাপারে বলেন, র্যাব আইন ভেঙে আইনের বাইরে নাগরিকদের হত্যাকে ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার বলে সাফাই গায় আর মানুষ আইনের ওপর ভরসা ছেড়ে দিয়ে ধর ধর মার মার বলে কাউকে চোর, ডাকাত, পকেটমার, ছেলেধরা ইত্যাদি গণ্য করে পিটিয়ে মারে।
তার মতে, এটি শুধু রাষ্ট্র, আইন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিক থেকে নয় সব দিক থেকেই বিপদজ্জনক। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজ, সামাজিক সম্পর্ক, সংবেদনা ও সচেতনতার ভাঙন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তার লক্ষণ ধরা পড়ে। তিনি বলেন, প্রত্যেক নাগরিকেরই আইনের আশ্রয় লাভ, আইন অনুযায়ী ব্যবহার লাভ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এই অধিকার রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়পক্ষ থেকেই ক্রমাগত লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
দার্শনিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম বলেন, গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজে গণপিটুনি বলে কিছু থাকতে পারে না।
তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, আমার ভয় লাগছে। সত্ বাবা মেয়েকে ধর্ষণ করছে, স্কুল শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ করছে, তারুণ্যের প্রতীক ছয়জন ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এরকম হাজার হাজার ঘটনা ঘটছে। এমন ঘটনা কেন ঘটছে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের আইনি চেতনার মধ্যেই গলদ আছে। এ গলদ দূর করতে তিনি পুলিশকে নৈতিক ও মানবিক প্রশিক্ষণ দেয়ার সুপারিশ করেন।
পাশাপাশি রাষ্ট্রের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে মৌলিক অধিকার ও মানবিক ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলকে একযোগে করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, রাজনীতি ও ধর্মের নামে এমন কিছু করা যাবে না যা ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে খারাপ পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক পিয়াস বলেন, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে ফ্যাসিবাদ সুপ্ত অবস্থায় আছে। বিরোধী দলকে নিপীড়ন করা হচ্ছে। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় বাহিনী পিটিয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণের সামনে রাষ্ট্রের যে রোল মডেল থাকা দরকার তা হারিয়ে গেছে।
রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে। তিনি গণপিটুনিসহ জনগণের আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি গণঅনাস্থার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মানুষের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস বেড়ে যাওয়াকে দায়ী মনে করেন। তিনি বলেন, আমরা এক সময় পাড়ার সব মানুষকে চিনতাম। এখন পাশের ফ্ল্যাটের লোককেও চিনি না। সবার জীবনেই অচেনা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
অচেনা মানুষ দেখলেই তাকে অবিশ্বাস করা হচ্ছে ও অপরাধী ভাবা হচ্ছে। আর কাউকে অপরাধী মনে করলেই পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান গণপিটুনির ঘটনাকে মনোবৈজ্ঞানিক জায়গা থেকে দেখেছেন। তিনি বলেন, মনোবিজ্ঞানে ‘মব বিহেভিয়র (জনতার আচরণ)’ বলে একটা ব্যাপার আছে। এর বৈশিষ্ট্য হলো যে কোনো দিন মারামারি করেনি সেও কোনো সঙ্ঘবদ্ধ ঘটনার সময় ঢিল ছোড়ে একজন মারামারি শুরু করলে অন্যরাও জড়িয়ে পড়ে।
তিনি মবের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার জন্য সামাজিক অস্থিরতার কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হওয়াকে দায়ী বলে মনে করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন মনে করেন, এমন একটি রাষ্ট্র আমাদের এখানে বহাল রয়েছে, যেখানে নাগরিকদের বাঁচামরা ‘রাষ্ট্রপতি’ নামক একজন ব্যক্তির হাতে। এখানে রাষ্ট্রই আজরাইল। আমাদের দণ্ডবিধি ও বিচারব্যবস্থা তথা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গড়ন ‘খুনের বদলা খুন’, ‘দাঁতের বদলা দাঁত’, ‘চোখের বদলা চোখ’ জাতীয় নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর সঙ্গে ন্যায়বিচারের কোনো সম্পর্কই নেই।
তিনি বিদ্যমান পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য, সমাজ ও রাষ্ট্রের গোড়া থেকে বলপ্রয়োগ উচ্ছেদ করে রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ বেসামরিক পুনর্গঠন করার ওপর জোর দেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।