"জেগে উঠুক তারুন্য,জেগে উঠুক স্বপ্ন,জেগে উঠুক মনুষ্যত্ব.........." আবিদ শাহরিয়ার, নামটি শুনলেই মনে আসে শান্ত শিষ্ট একটি ছেলে, আপন গন্ডিতে সদা প্রানোচ্ছ্বল এক নীরব ভাষাময় চেহারা। বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে প্রতিভার পরিচয় দিয়ে কেমন যেন নীরবেই প্রবেশ করেছিল। সেই নীরবতা ছাপিয়ে তার গান,তার ব্যবহার,মার্জিত আচরন সবার নজর কেড়েছিল তো বটেই একই সাথে সমসাময়িক তারকাদের চেয়ে যেন একটু বেশিই সাধারন দর্শক-শ্রোতার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিল। তার চেহারায় এমন কিছু ছিল যে তা দেখে যে কোন মানুষের মনে মায়া জন্মাতে বাধ্য।
সেই মায়াময় নীরব মুখটি আজ চিরতরে স্তব্ধ।
সমুদ্রের পানিতে ভেসে গেছে প্রানোচ্ছ্বল এক হৃদয়, মিষ্ট কন্ঠের অধিকারী এক যুবকের মায়া জন্মানো মিষ্টি হাসি আর সেই সাথে সকল স্বপ্ন।
মাত্রা নামক কোন এক বিজ্ঞাপনী সংস্থার বিজ্ঞাপনী কাজের শ্যুটিং এর জন্য কক্সবাজারে যায় আবিদ। আজ শুক্রবার বিকেলের দিকে কাকলী পয়েন্টে গোসল করতে নামে বন্ধু মোস্তাকিম,সোহেল আর আশিক কে সাথে নিয়ে। কিন্তু উন্মত্ত বঙ্গোপসাগরের প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যায় সবাই। আটকা পড়ে গুপ্তখালের মরনফাঁদে।
স্থানীয় লোকজন দেখে উদ্ধারে এগিয়ে আসে। মুমূর্ষ অবস্থায় আবিদ ,মাত্রার কর্মকর্তা মোস্তাকিম আর সোহেলকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতেল ভর্তি করা হলে প্রথাগত নিয়ম অনুযায়ী কর্তব্যরত চিকিতসক আবিদ ও মোস্তাকিমকে মৃত ঘোষণা করে, সোহেলকে প্রাথমিক চিকিতসা দেয়ার পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
অসংখ্য ভক্তকূলের হৃদয় কাঁপিয়ে চলে গেলেন আবিদ শাহরিয়ার।
এখানে একটি ফুটেজ আছে। এখানে একটি ফুটেজ পাবেন
প্রথম বার ক্লোজ আপ ওয়ান প্রতিভা অন্বেষন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় আবিদ, রবীন্দ্র সঙ্গীতে পারদর্শী এই শিল্পীকে প্রথমে দর্শক কদর করেনি তাই প্রথম দিকেই বাদ যায়, পরবর্তীতে দর্শকের ভোটেই ঐ মঞ্চে তার প্রত্যাবর্তন হয়।
কিন্তু ক্লাসিক শিল্পীদের আমরা যে কদর করি না তা আর একবার প্রমান করে বাদ পড়ে আবিদ। তবে ট্র্যাক থেকে ছিটকে যাননি। একই সাথের রাতারাতি শিল্পী হয়ে যাওয়া তারকারা টাকার পিছনে ছুটে পাড়া মহল্লার কনসার্টগুলোতে গিয়ে সস্তা হয়ে যায়, অথচ তারই সাথে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে আবিদ ঠিকই তার গান গাইতে থাকে এবং চর্চা করে যায়। বাজারে তার এলবামগুলো ঠিক অতটা জনপ্রিয় না হলেও যারা সমঝদার তাদের মনে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছিল গানগুলো। সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছিল আবিদ।
না, আজ প্রয়ানে আবেগাপ্লুত হয়ে এই কথাগুলো লিখছি না, তাকে ভালবাসার আরো কিছু কারন আছে। সমসাময়িক শিল্পীগুলো যেখানে টাকা,এলবাম যশ খ্যাতির পেছনে পাগলের মত ছুটছিল তখন আবিদের কিছু কাজ সত্যিই আশা জাগানিয়া ছিল। গনিত অলিম্পিয়াডে বিনে পয়সায় ছাত্রদের আনন্দিত করতে গান গাইতে তাকে সব সময়ই স্বতস্ফূর্তভাবে পাওয়া যেত। সহপাঠীর অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা পিতার অপারেশনের জন্য চ্যারিটি কনসার্টে আবিদের ভূমিকা সত্যিই খুব বেশি গর্বের ছিল।
আমাদের শিল্পী সমাজে খুব বেশি অনুকরনীয় চরিত্র নেই, তারা তথাকথিত পাব্লিক কি খায় তা নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকে, কারন পাব্লিক খেলেই সে বা তারা হিট হবে, হিট হলে তার খ্যাতি বাড়বে সাথে টাকা তো অবশ্যই।
তবে এই শিল্পীদের মাঝেই আবিদ হয়ত একটা অনুকরনীয় চরিত্র হতে চলেছিল। কিছুদিন পরেই হয়ত সেটা সবাই অনুধাবন করত। কিন্তু আজ সমস্ত আশা-ভরসা নিভে গেল দপ করে, অযাচিত এক অবাস্তবতায়।
আমি একজন তার সাধারন শ্রোতা, তাকে নিয়ে আমার মাঝে যে খুব ক্রেইজ কাজ করত তা নয়, তবে তার প্রতি তার গানের চেয়েওর চরিত্র তার ব্যবহার আমাকে বেশি মুগ্ধ করত। কয়েকদিন আগে টিভিতে উপস্থাপনা করতে দেখে কাকে যেন বলেছিলাম "সত্যিই প্রতিভাবান"।
আজকে খবরটি শুনে অশ্রুধারা আটকে রাখতে পারলাম না। কোনভাবেই , কোনভাবেই মেনে নিতে পারলাম না, কিভাবে মানা যায়? সাধারন একটা মানুষ হলেও এই সংবাদটি মেনে নেয়া দুস্কর হত, সেখানে আবিদের এই মর্মান্তিক অকাল প্রয়ান আমি কিভাবে মেন নিব? পুরো স্তব্ধ হয়ে গেলাম এই ভেবে যে এই দেশে আমরা শিল্পী তো তৈরি করতে পারি-ই না, যারা অনেক কষ্টে নিজেদের তৈরি করে অন্যদের আনন্দ দেয় তাদের রক্ষাও করতে পারি না।
একটা প্রশ্ন, ঠিক কার কাছে করব তা জানি না। একজন শিল্পী, যখন কোন কাজে চুক্তিবদ্ধ হইয়ে কাজ করে তখন তার নিরাপত্তার কথা কেন সঙ্ঘশ্লিষ্ট লোকেদের মাথায় আসবে না? একজন গুনী শিল্পী কক্সবাজারে গোসল করতে গিয়ে দিনে দুপুরে মারা যাবে এটা কিভাবে মানা যায়? কক্সবাজারের গুপ্তখালের মরন ফাঁদ তো বহু পুরোনো সমস্যা, সেই সমস্যা সমাধানে কি পদক্ষেপ আছে জানি না, তবে এইভাবে এইরকম এক শিল্পী মারা যাবে তা মানা যায় না। প্রশ্ন হল এই দুর্ঘটনার দায় কার? কে এই অপূরনীয় ক্ষতির দায়ভার নিবে? হয়ত নিছক দুর্ঘটনা বলে চালানো হবে।
হয়ত দুর্ঘটনাই কিংবা না।
সমুদ্রে সলিল সমাধি হল আবিদের, সাথে অসংখ্য ভক্তকূলের তাকে ঘিরে স্বপ্ন আর প্রত্যাশারও সলিল সমাধি হল।
আবিদের জন্য আমাদের মত অভাগা ভক্ত শ্রোতাদের পক্ষ থেকে অশ্রুসিক্ত ভালবাসা আর বিনম্র শ্রদ্ধা রইল। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।