আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনেক দিন পর ছোটগল্পের মত কিছুএকটা লিখলাম.........।

উপলব্দি আমি তূর্য মাহমুদ। সেদিন বাবার ইচ্ছাতে ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডনে গিয়েছিলাম নিজের সবচেয়ে আনন্দের সময়গুলো বিসর্জন দিয়ে। আমার চোখের জল বাবার সেদিনের অদ্যম ইচ্ছাশক্তিকে দমাতে পারেনি। বাবার ইচ্ছা ছিল ব্যারিস্টারি শেষ করে আমি বাড়ি ফিরে আসব। বাবার প্রতি ক্ষোভের কারনে আমার ইচ্ছের নিচে বাবার ইচ্ছাটা চাপা পড়ল।

আমার আনন্দের মুহূর্তগুলো কেড়ে নেওয়ায় আমি নিজে নিজেকে অভিযোগ দিয়েছিলাম। আমার মনের ভিতরকার বিচারক বাবাকে শা¯িত দিয়েছিল। বাবার শত অনুরোধের পরেও আমি দেশে ফিরে আসিনি। তবে দেশে ফিরে না আসার এই কারণটি আমার কাছে এখন হাস্যকর মনে হয়। মা মারা যাওয়ার পর বাবার দ্বিতীয় বিবাহ আমি মেনে নিতে পারিনি।

লন্ডনেই থেকে গেলাম। কিছুদিন অর্থের পেছনে তারপর তারপর অর্থ আমার পেছনে ছুটতে লাগল। উঠের পানির তৃষ্ণা যেন শেষ হওয়ার নয়। এখন বউ আর ছেলে মেয়ে নিয়ে অনেকের মতে, খুব সুখে আছি আমি। কিন্তু আমি জানি আমার ভিতরের বোবা ব্যথা গুলোর কথা।

দেশে থাকলে হয়তো আমার এরকম লোভী মানসিকতা হতো না। জীবনটা রোবটের মতোও হতনা, পাখির মতো একটা জীবন হতো। অনেকদিন দেশে আসা হয় না। বোবা কথাগুলো পুঞ্জিভুত মেঘের মত বুকে চেপে আছে। এবার আর সম্ভব না।

সোনালী স্মৃতি গুলো খুব টানছে। আমার গ্রামের কথা মনে পড়ছে। আমার স্কুলের কথা,কলেজের কথা আমার বন্ধু রাখাল পধ্যাররে কথা খুব মনে পড়ছে। জীবন যুদ্ধে কেউ বা ক্রনিং করে আবার কেউ দৌড়ে লক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। তাদের মাঝে আবার অনেকে থেমে যায় রাতের অন্ধকার পথ দেখে।

আবার অনেকে চলতে থাকেন। রাখাল ও আমি আমরা দুই বন্ধুই সূর্যদ্বয়ের সন্ধান পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার লক্ষ অর্জনের সংগ্রামমুখরদনি গুলো ছিল পূর্নিমার আলোতে উদ্ভাসিত আর রাখালের জন্য ছিল অমবস্যার কালো রাতগুলো। তাই আমাকে নতুন সূর্যদ্বয়ের সকালে পৌছাতে এতো বেশী কষ্ট করতে হয়নি। কিন্তু অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে লক্ষে পৌছাতে রাখালকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।

আমার জীবনটা ছিল বাচ্চাদের ললিপপ খাওয়ার মতই সহজ। তাই যে স্বপ্ন উঁকি দিয়েছে বাবার অঢেল সম্পত্তির বদৌলতে কিনে নিতে কষ্ট হয়নি। আর রাখালের কাছে বড় স্বপ্ন দেখা ছিল বিলাসিতা,দারিদ্রতা তার কাছে বা¯তব। তাই নতুন জামা কেনার চেয়ে বই কেনার অভাব বেশী তীব্র বলে জামা কিনা হতো না কিংবা সিংগারা খাওয়ার চেয়ে কলম কেনা বেশী জরুরি বলে হয়তো সিংগারা খাওয়া হতো না। এত কিছুর পরও লেখাপড়ার দৌড়ে রাখাল ছিল সবার আগে।

তাই ক্লাসের সবারই তার সাথে বন্ধুত্ব করার বিশেষ আগ্রহ ছিল। আর আমার প্রভাবশালী বাবার কারণে আমারও বন্ধুর অভাব ছিলনা । কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে কি কারণে যে বন্ধুত্ব হয় তা হয়তো মনোবিজ্ঞানীরা বলতে পারবে, তবে পাঠক সমাজকে এটুুকু বলতে পারি এটা ছিল নির্ভেজাল বন্ধুত্ব, আত্মার সম্পর্ক । অনেক বছর পর দেশে ফরিছে। ি মনে হচ্ছে যেন অ¯িতত্ব খুঁজে পেয়েছি।

সবকিছুকে ভালবেসে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। বন্ধু রাখালকে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠেেছ। এত দিন পর রাখালকে দেখে আমার চোখ যেন আকাশে উঠল। শেষবার যখন দেখা হয়েছিল তখন ও অনেক মোটা ছিল। আজকের রাখাল যেন তার পুরানো ঐতিহ্য হারিয়ে আলনায় ঝুলিয়ে রাখা পুরানো কাপড়।

ওকে দেখে আমি কোন কথা বলতে পারি নি। নিরবে জড়িয়ে ধরেছি অনেক্ষণ। আসলে কিছু কিছু অনুভূতি লিখার নয়। এই অনুভূতি গুলো চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে হয়। ৭ বছর পর আমাদের দেখা।

রাখাল আমাকে কথাই বলতে দিচ্ছে না। হাজারটা প্রশ্ন করতে লাগল। আমি তাকে একটু থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘কেমন ছিলি এতদিন ?’ কোন উত্তর পাইনি। বরং সে প্রশ্ন করল- “এত দিন পর আসতে পারলি ? উত্তরে আমি শুধু একটু হাসলাম। আমি তাকে দেখছি।

অনেক পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে। আগে হাসলে তার মুখে টোল পড়ত। এখন গাল ভেঙ্গে যাওয়ায় তা আর বুঝা যায় না। কিন্তু পরিবর্তনের স্রোতে সব কিছু ভেসে গেলেও তার চোখ দুটি যেন অপরিবর্তনের চিহ্ন হয়ে ছাইয়ের পাশে জলšত দুটি কয়লার মত সগৌরবে জ্বলছে। আমি আর রাখাল এখন বেশ গল্পে জমে উঠেছি।

বিকালের আলোটুকুও তেমন বুঝা যাচ্ছে না। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করছে। ে এরই মধ্যে একটা মেয়ে দ্রুত পায়ে আমাদের জন্য চা নিয়ে এল। তারপর যেভাবে এল তারচেয়ে দ্রুত পায়ে আবার চলে গেল। এই অল্পসময়ে যা দেখেছি তা হলো মেয়েটার গঠন ছিপছিপে,মুখটা গোলগাল, কপালের উপর এলোমেলো ভাবে ছড়ানো সিঁদুর।

তারপর আমি বোকার মতো রাখালের কাছে জিজ্ঞেস করলাম- তোর মেয়ে ? উত্তর হিসেবে রান্নাঘর থেকে চাপা অথচ লম্বা একটা হাসি শুনতে পেলাম। সেই হাসি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে আমাকে যেন লজ্জাই দিয়ে গেল। শৌরমি বৌদির গত হওয়ার সংবাদ আমি শুনেছিলাম কিন্তু তার আবার বিয়ে করার কথা আমি জানতাম না। মেয়েটাকে দেখে খুব মায়া হলো, আর রাখালের প্রতি রাগ হলো। ‘ওর নাম নয়নদেবী’ রাখাল ঠোঁট বাঁকা করে লজ্জামাখা হাসি ছেড়ে বলল।

অংকে কাঁচা বালক ব্ল্যাকবোর্ডের অংকের উদ্ভূত চিহ্নগুলোর যেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আমার অবস্থা তাই হলো। রাখালের দুই ছেলে সুজন ও সুমনকে দেখতে পারছি না। তার মেয়েটাকেও দেখতে পারছিনা। ছেলে দুটিকে রাখাল খুব শাসনে রাখতো। কিন্তু মেয়েটির ক্ষেত্রে ছিল ঠিক তার উল্টো বাবা যেন তার কাছে কোন খেলনার বস্তু।

আমি যখন শেষবার এসেছিলাম তখন ছেলে দুটি খুব সম্ভবত দশম শ্রেণীতে পড়তো। আর মেয়েটা পড়তো ৫ম শ্রেণীতে। সেবারে বৌদির হাতে টাকি মাছের ভর্তা খেয়েছিলাম তার গন্ধ হাতে এখনও পাই। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো মনে হচ্ছে। এই রাখাল সেই রাখাল না ।

এই ঘর সেই ঘর না । এই পরিবর্তন যেন দশ বছরের বালকের মুখে হঠাৎই গোঁফ দাড়িতে ভরে ওঠার মতই অস্বস্তিকর। আমি চাচ্ছিলাম গত সময়গুলোর সামনে যে কুয়াশা জমে আছ তা যেনা রাখাল পরিস্কার করে। আকাশে মেঘের আনাগোনা বেড়েছে। বৃষ্টি হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত।

রাখাল কথা বলা শুরু করল। তার জীবন নদীতে ভাটার কথা,জীবনের সামনে ধূধূ সাহারামরুভূমরি কথা, ভালবাসার পিপাসায় তৃর্ষ্ণাত রাখালোর কথা। তোর বৌদি মারা গেছে পাঁচ বছরের একটু বেশী সময়। মেয়েটার চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। বাড়িতে সুন্দর কলেজ পড়–য়া মেয়ে থাকলে একটু আধটু ঝামেলা সবারই হয়।

এলাকার মজুমদারের ছেলে শৈবাল আমার মেয়ে পুতুলের সাথে কথা বলতে চাইতো । এ রকম হতেই পারে। কিন্তু আমতিো আমার মেয়েকে চিনি। এমন লাজুক মেয়ে, ছেলেটের সাথে কথায়ই বলবো না। ছেলেটার যোগ্যতা বলতে কছিুই ছিল না।

তবে যা ছিল আবেগের রাজ্যে বসবাসকারী একটা মেয়েকে অন্ধ করতে যথেষ্ট ছিল। ছেলেটার রুপ ছিল যথেষ্ট কিন্তু রুচিবোধ ছিল সামান্য। আমার মেয়ে ও ছেলেটা কলেজে একসাথে পড়তো। পুতুল লেখাপড়ায় যেমন ভালো ছিল ছেলেটা ছিল তমেন খারাপ। আমাদের বাড়ির সামনের চায়ের দোকানটাতে প্রায় সময় আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করতো।

কিন্তু তার এত ব্য¯ততার মাঝেও পুতুলকে বিরক্ত করার একটা সময় ঠিকই বের করে নতি। এই ভাবে বন্ধ দরজায় প্রতিদিন আঘাত করার ফলে একদিন পুতুল দরজা খোলে। একদিন কলেজ থেকে বাড়িতে ঢুকেই চিৎকার চেচামেচির শব্দ শুনতে পেলাম। আমার বড় ছেলে সুজন, শৈবাল ও পুতুলকে একত্রে রিক্্রায় দেখেছে। এটা সুজনের সহ্য করার কথা নয়।

পুতুল আমাদের কাছে সত্যকার পুতুলই ছিল। একই ধরণের আচরণে অভ্য¯ত মানুষ হঠাৎই তার আচরণের পরিবর্তন ঘটালে মানুষ স্বাভাবিকভাবে নেয় না। সেখানে শৈবালের মতো একটা আগে পাকা ছেলের সাথে রিক্্রায় ঘুরে বেড়ানো !! -‘মনে এত রং লাগলে বাবাকে বলিল না কেন বিয়ে দিয়ে আপদ দূর করত। একটা রা¯তার ছেলের সাথে..............তোর রুচি এত বাজে। লজ্জা করল না? কুত্তি ছিঃ........’ সুজন কথাগুলো চিৎকার করে করে বলছিল আর পুতুলকে মারছিল।

মেয়েটা একটা কথাও বলেনি। সুজন একসময় বিরক্ত আর ক্লাšত হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। একটু পর পুতুলের কন্ঠ শুনতে পেলাম। সে বলল- ‘দাদা যদি আর একবার এমন করে আমি শৈবালকেই বিয়ে করব’ -কি বললি পোড়ামুখী তোর লজ্জা শরম .... তোর বৌদি বাক্যটা শেষ না করেই পুতুলের গাল তিন চারটা থাপ্পর বসিয়ে দিল। মেয়েটা আর থাকল না।

রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমি বিশ্বাস করতে চেষ্টা করছিলাম এতক্ষণ যা হয়েছে তা একটা স্বপ্ন । আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারছিলাম না। চোখ বন্ধ করে গালে হাত দিয়ে বসে থাকলাম অনেক্ষণ। অন্য সময় হলে হয়তো ঘুমিয়ে পড়তাম।

-তুমি কখন এলে ? তোর বৌদি জিজ্ঞেস করল। সে আসলে নিশ্চিত হতে চাচ্ছিল এতক্ষণ যে অসুরের হাওয়া বয়ে গেছে তার কিছু আমি জানি কী না। তাকে আশাহত না করে আমি বললাম -এইতো এই মাত্র। সেদিন রাত্রে তোর বৌদিকে রান্নাঘরে বসে কাদঁতে দেখেছি। আমি চায়ের কথা বলতে গিয়েও বলতে পারিনি।

নিজেকে আর দর্শকের শ্রেণীতে বসিয়ে রাখতে পারলাম না। পুতুলের রুমের দরজায় টোকা দিলাম। একটু পর ভেতর থেকে বলল -কে ? আমি এই গম্ভির পরিবেশটাকে স্বাভাবিক করতে বললাম- -তোর মায়ের মেয়ের বাবা। আমি কী বলেছি তা হয়তো বুঝেনি কিছূ আমি যে রাখাল পধ্যার তা অবশ্যই বুঝেছিল। দরজা খোলল।

পুতুলকে দেখে মনে হলো যেন সারাদিন বৃষ্টিতে ভেজা নীড়হারা পাখি। এখন গায়ে লেগে থাকা পানি ঝেড়ে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছে। আমি তার সাথে এমনভাবে কথা বললাম যেন কিছুক্ষন আগে আমার জন্ম। বিকালে যা হয়েছে তার আমি কিছুই জানি না। প্রতিদিন যে কথাগুলো বলি তা শেষ করার পর কিভাবে আমি আমার মূল কথায় আসব তা চিšতা করছিলাম।

তারপর নিজ থেকেই বানিয়ে বললাম। জানিস তোদের আশিক স্যার স্টোক করছে, খুব অসুস্থ। -কোন আশিক স্যার ? জিজ্ঞাসু চোখে পুতুল জিজ্ঞাসা করল। আমি বাঁচার জন্য বললাম-তোর চেনার কথা নয়। তুই তখন অনেক ছোট।

আশিক কলেজে বাংলা পড়াত। তার একটা ছোট মেয়ে ছিল। নাম জ্যোতি। প্রতিদিন মেয়েটাকে সে কলেজে নিয়ে আসত। এমন মেয়ে পাগল বাবা আমি খুব কম দেখেছি।

মেয়েটা গত পরশু পালিয়ে বিয়ে করেছে। এটা শুনার পর থেকে আশিক ষ্টোক করে হাসপাতালে। কেমন মেয়ে দেখ,কিভাবে পারে ? আসলে এই ধরণের তথাকথিত প্রেম-ভালবাসা মানুষকে অনেক স্বার্থপর করে তুলে, অন্ধ করে ফেলে। মুরগি তখন শেয়ালকে চেনে না। দুই এক বছরের একটা সম্পর্কের জন্য ২১/২২ বছরের সম্পর্ককে অস্বীকার করবে !! সে রাতে পুতুলকে অনেক কথায়ই বলেছিলাম।

বুঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এটা অনেক দেরী হয়ে গেছে। পুতুল আর আগের পুতুল নেই। শৈাবালের প্রেম তার মনের সামনে এমন একটা বাধ সৃষ্টি করেছিল, আমার কথাগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বাধেঁ আঘাত হেনেছে শুধু ভেতরে প্রবেশ করতে পারে নি। এর পরদিন থেকেই পুতুলকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন মাথা থেকে ঝেরে ফেলি।

তার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগি। কলেজের ইংরেজি বিভাগের নতুন শিক্ষক পঙ্কজকে আমার বন্ধুকে দিয়ে পুতুলের বিয়ের প্র¯তাব দিই। রাজি না হওয়ার মত কিছুই ছিলনা। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করি। পুতুল বিয়েতে রাজি ছিল না।

কিন্তু বৌদি আমাকে অভয় দিয়েছিল। -বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু পুতুল আর সময় দিল না । বিয়ের দুদিন আগে পুতুলকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। শৈবাল মনে হয় আগে থেকেই বিয়ের সবকিছু ঠিক করে রেখেছিল।

সে রাতে তোর বৌদিকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। সুমনের তখনও ডাক্তারি পড়া শেষ হয়নি। সে তার কলেজের বড় বড় প্রফেসরদের নিয়ে আসে। কিšতু তোর বৌদিই যেখানে যমদূতের পক্ষে সেখানে হাজার প্রচেষ্টা শূন্যে তীর ছোড়ার মতো। ব্রেইন স্টোক করেছিল সে।

হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই অজ্ঞান ছিল। আমি জানতাম সে কোথায় যেতে চাচ্ছে। পুতুলকে মারার পর থেকে সুজন আর পুতুল কেউ কারো সাথে কথা বলত না। কিন্তু এখন আর অভিমানের সময় নেই। সুজন পুতুলকে ফোন করল।

রিসিভ করল শৈবাল। সুজন তার মায়ের অসুস্থতার কথা কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারিনি। শৈবাল এটা তাদের বরিুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্রের কৌশল হিসেবে মনে করেছিল। ডাক্তাররা যমদূতের সাথে যুদ্ধে পারিনি। তোর বৌদি আমার সাথে শেষ কথাটাও বলল না।

এত অভিমানী সে কিভাবে হলো। কার উপর অভিমান ? আমরা তো কিছূ করিনি। সে কি লজ্জায় আমার সাথে কথা বলেনি ? কিন্তু এই লজ্জা কী শুধু তার ? শা¯িত কী শুধু সে পাবে ? আর মুক্তিও কী শুধু তার জন্যে ? তুই হয়তো বিশ্বাস করবি না আমি পুতুলকে তার মায়ের মৃত্যুর খবর দিই নি। দিনের সর্বশেষ আলোটুকু রাতের আধারের কাছে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছে। রাখাল সেই হারিয়ে যাওয়া আলোর খোঁজে বাইরের অন্ধকারে তাকাল, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস সঙ্গে নিয়ে বলল-‘দুজনকেই হারালাম’ বৃষ্টি যেন থামতে চাচ্ছে না।

তার সাথে আবার জড়ো হলো ঝড়ো হাওয়া। এক পশলা বৃষ্টি ঝড়ো হওয়ার সাথে মিশে দরজায় বসে থাকা নিরাপরাধ বিড়ালটিকে ভিজিয়ে দিল। আর মোমবাতি ও নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারলো, নিভে গেল। ভীষণ ভয়ংঙ্কার ভাবে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চোখ ধাঁধাঁনো আলোকছটা দেখলে ভয় লাগে।

মানুষ আলোকেও ভয় আবার অন্ধকারকেও। বিদ্যুৎছটা আলোতে রাখালের দিকে তাকাতেই দেখলাম তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। রাখালের শোকেই কি আকাশের এই আয়োজন ? পরিবেশটা ভারি থমথমে। কি বলব বুঝতে পারছিনা। ভেতরে একটা তাড়না কাজ করছে।

কিন্তু এই জন্মান্ধ পরিবেশটা যেন আমার কৌতূহলগুলোর গলা চেপে বসে আছে। বেশীক্ষণ আর পারলাম না, মৌনতা ভাঙ্গালাম। সুজন আর সুমন ? আমার এই সুতীক্ষ কথাটি এই নি¯তব্ধ পরিবেশে রাখালের মনে জমে থাকা চাপা কথাগুলো বের হয়ে আসার পথ খোজে দিল। আমি যেন হ্যানিমেনের বাশিঁওয়ালা। রাখালের কথাগুলো আমার পেছনে ছোটতে লাগল।

ঘরে বাতি নিভে গিয়েছিল অনেক আগে। বাতি জ্বালানোর কথা আমাদের কারো মনে নেই। রাখালের নতুন বউ এক ধ্যানে রান্না করছে। অন্ধকার আরোও নিবিড় হলো। চোখ বন্ধ করলে যেমন দেখায়।

রাখালের বাড়ির উঠানের বড় আমগাছ, সামনের বেড়, তারপর বাঁশ ঝাড় কিছুই কল্পনা ছাড়া দেখা যাবে। সবকিছু যেন নিজদের অদৃশ্য করে নি¯তব্ধ ভাবে বসে। কেউ কোন কথা বলছে না । রাখাল শুরু করলো। শৌরমির মৃত্যু আমার জীবনের পথে বড় একটা ফাটল সৃষ্টি করছেলি।

আমি যদি হাসতাম, তখন পরিপূর্নভাবে হাসতে পারতাম না। কাঁদলেও মনে হতো ভেতরে কিছু কান্না রয়ে গেছে। সুন্দর কোন কথা শুনলে উৎসুক হতাম শৌরমিকে বলার জন্য। পরক্ষনেই ভেতর থেকে কেউ একজন বলত শৌরমিকে ? হায় ! এ যেন অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া এক টুকরা চাঁদকে খোঁজে মরা। কখনও বা চশমা ফেলে গিয়ে কলেজে ছেলেদের অংক করাতে না পারলে শৌরমি কথা মনে না করে পারতাম না।

ও হলে নিশ্চয় এমন হতো না। এক কথায় শৌরমির হাজারো শূন্যস্থান আমাকে গিয়ে ফলেিেছল। এক রাতে আমি মাথা ব্যথায় ঘুমাতে পারছিলাম না। প্রচন্ড ব্যাথার খানিকটা উপশমের জন্য বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছি। চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করছিলাম।

তখনই শৌরমির স্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনলাম, কোন কথা বলল স। ে আমার শিউরে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তার অন্য হাতটি আমার বুকের উপর রেখে হৃদয়ে আমার যে বেদনার ঝড় বইছে তার শব্দ শুনতে চেষ্টা করলাম। সে আমার চোখের তৃষ্ণামঠিয়িে দলি, হৃদয়ের ব্যাকুলতা ঝরয়িে দলি। অনেক দিন পর দ্ইু সখীর দেখা হলে অতি ক্ষুদ্র বিষয়ও না বলার আর বাকি থাকে না।

শৈরমী একে একে সব জিজ্ঞাসা করতে লাগল। আমি আগের মতো লুিঙ্গ তোয়ালে ছাড়া গোসল করতে যায় কিনা। আদা দিয়ে চা খাওয়ার অভ্যাস আছে কিনা, ঔষুধ খায় কিনা ঠিক মতো। আমি একাšত বাধ্যগত খোকার মতো সব উত্তর দিলাম। আমার কেন যেন মনে হলো মিনিটের কাটা সেকেন্ডের কাটার পথ ধরেছে।

এক ঘন্টাকে এক মিনিট মনে হচেছ। যদি পারতাম সে রাতে কালের গতিকে চিরস্থায়ীভাবে থামিয়ে দিতাম। আগে কোনদিন শৈরমীকে বোধ হয় এত গভীর ভাবে চাইনি। আসলে মানুষ হারানো পর হারানোমানুষরে শূন্যতা উপলব্ধি করে। মালির অক্লাšত পরিশ্রমে ফুলে ফুলে ভরে উঠে বাগান হঠাৎ মালির ভালোবাসার হাতের অভাবে ঝিমিয়ে গেলে মালির গুরুত্ব, শূন্যতা বুঝা যায়।

আজ বাগানের প্রতিটি গাছই ডাকছে ভালবাসার ক্ষুধায়। আমি সেই রকম একটা গাছে। আমার ডাকে সে সাড়া না দিয়ে পারিনি। তাই এত গভীর নিশীথে আমার পাশে বসে আছে। কথা যেন ফুরায় না।

সমুদ্রের জলরাশির মতো। কিন্তু কথা একসময় ফুরালো তোর বৌদি জিজ্ঞাসা করলো -আমার ছোট মেয়ে কেমন আছে ? শুনেই আমি চিৎকার করে বলে উঠি -ওর কথা মুখে আনবে না। সুজন পাশের রুম থেকে তাড়াতাড়ি ছুটে আসল। - বলল বাবা পানি খাবে ? বুঝতে পারলাম স্বপ্ন দেখছি এতোক্ষণ। শেষোক্ত কথাগুলি এত বড় করে বলেছি সুজন ঘুম থেকে উঠে গেছে।

বিশ্বাস কর বন্ধু, সেদিন আমি কলেজে যায় নি। বিকাল পর্যন্ত ঘুমিয়েছি। শুধু বিগত স্বপ্নের খোঁজে। ও কত কাছে এসেছিল শুধু মৃত্যু নামের একটি ব্যবধানের জন্য তারপরেও কত দূরে। এই ব্যবধান আমৃত্যু ঘোচাবার নয়।

শৌরমী আর আসল না। তার শেষ কথাটি যেন বাতাসের সাথে মিশে আমার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। এবার নিজেকে বিচারকের চেয়ারে বসিয়ে চন্তিা করলাম শৌরমী কি শুধু বাগানের রাখাল পধ্যায়কেই ভালবেসেছিল ? পুতুল,সুজন,সুমন, তারা কেউ না। এই েিবয়োগ ব্যাথা কি শুধু আমার? আমার সন্তানরা পাচ্ছে না? আর পরপারের ডাকতো আসবেই। পুতুল মাধ্যম মাত্র।

সরোতে পুতুলকে ফোন দিলাম। আমি আশা করেছিলাম পিতৃস্নেহকাতর মেয়ে বাবার দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত অভিমান ভাঙ্গার জন্য কান্না সোহাগ করবে, বাবাকে ভালবাসার বাধনে দূর্বল করার জন্য কত অভিযোগ করবে। কিন্তু আশা আমার মরিচীকার পথ ধরলো। সে প্রচন্ড রেগে আছে। তার অভিযোগ গুরুতর।

-তুমি মানুষ ? মেয়েকে মায়ের শেষ চেহারা পর্যšত দেখতে দিলে না। আম্মু আমার কেউ না ? তুমি আর কখনো আমাকে ফোন করবে না। তুমি আমার কেউ না। মাকালি বলছ। ি তার বুকে জমে থাকা দীর্ঘদিনের অভিমান প্রকাশ করার জন্য হয়তো এর চেয়ে সুন্দর কোন কথা তার জানা ছিল না।

আগের মত কিছু দিন কাটালাম। ভাবলাম,এইভাবে দেবদাস জীবন কাটানো উচিত হবে না । সুজন,সুমন দুজনই এখনও জীবনসাগরে সাঁতার কাটছে। তাদের কলে তুলে আনা আমার দায়িত্ব। অনেক কষ্টে কষ্টগুলোকে ভেতরে চাপা দিলাম।

স্বাভাবিক হতে লাগলাম। কলেজে যেতে শুরু করলাম। কিন্তু এসব যে আমি বাধ্য হয়ে করছি এটা মিথ্যা না। মাঝে মাঝে মনে হতো কোন উপন্যাসের ট্রাজেডি চরিএে অভিনয় করছি। একাকিত্বের শূন্যতা আমাকে গ্রাস করল।

দুই ছেলে কোনটা কাছে নেই। দুজনইে ঢাকাই পড়শোনার কাজে ব্য¯ত। তবে মাসে মাসে তাদের বাড়িতে আসতে হয় তাদের ভেতরকার এক অদৃশ্য টানে। কিন্তু দুএক দিনের বেশী নয়। পুরোটা মাস এই দুএক দিনের অপেক্ষায় থাকি।

আবার সেই জীবন যার প্রতি আমি বিরক্ত হয়ে পড়ছি। পুরো বাড়িতে আমি একাই থাকি। সকালে কলেজে যায় কন্তিু আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করে না। দুপুর ও রাতের খাবার বাইরের হোটেল থেকে খেয়ে নিই। আর রাতে কেবল বাড়িতে ফিরে আসি।

না এসেই বা কোথায় যাবো ?তারপর আমি যা করলাম তা নিয়ে আমি এখানো ভাবি। কিন্তু আমি কাজটার পক্ষে বিপক্ষে কোন দিকেই যেতে পারিনি। নিরপেক্ষ থাকতে হয় । বাইরে বৃষ্টি আরো বাড়ল। অন্ধকার ও বাড়ল।

রাখাল কাজটা বলতে যে কি বুঝিয়েছে তা বুঝতে মোটেই কষ্ট হয়নি। রাখালের নতুন বউ দেখলাম আলো নিয়ে আসছে। আলোর উপস্থিতি ভালো লাগছেনা। কোন কিছুর অšঃসার আস্বাদন করতে মানুষ চোখ বন্ধ করে কল্পনা করে। এতক্ষন অন্ধকারে আমি খোলা চোখে বন্ধ চোখের স্বাদ পাচ্ছিলাম।

মেয়েটি মোমবাতিটা টেবিলের উপর রেখে চলে গেলো। একটু পর আমি আলোটা নিভিয়ে দিলাম। অন্ধকার ঘর থেকে দেখালাম রাখালের বউ মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। আমাদের এই দুই ক্লাšত পথিকের বোবা কথাগুলোর প্রতি হয়তো তার কোন আকর্ষন নেই। রাখাল বলে যেন আনন্দ পাচ্ছিল।

সে বলতে লাগলো আর আমি অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছিলাম রাখালের সেদিনগুলোকে। আমার সাথে নয়নদেবী নামের এক বিধবা মেয়ের সাথে বিয়ে হয়। ব্যাপারটা আকস্মিক ছিল। কলেজের রিপন বাবু ছিল এর উদ্দোক্তা। একদিন রিপন বাবু নয়নদবেীর কথা বলল।

মেয়েটা আমাদের কলেজে পড়তো। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে এক মদ্যপ মাঝবয়সী লোকরে সাথে মেয়েটা বিয়ে হয়। বিয়েতে মেয়েটার এক বিন্দু মত ছিলনা। তার লেখাপড়া শেষ করে বড় চাকরী করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তার মা-বাবার ইচ্ছার কাছে তার স্বপ্ন ঝড়ো হাওয়ায় মলিন পাতার মতো উড়ে গেল।

মেয়েটার বড় দুই ভাই আগে থেকে আলাদা থাকে। এখন এই অবলার বিয়ে দিয়ে দায়মূক্তির দায়িত্ব বৃদ্ধ পিতার। এই মূহুর্তের এরকম অঢেল সম্পত্তির সাথে বিয়ের প্রস্তাবতো পিপড়ার ঘরে হাতির পা। তাদের মেয়ে তো রানীর মতো থাকবে। এমন উত্তম পরুষ হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে কাল বিলম্ব না করে তার মা-বাবা রাজি হয়ে গেলো।

বিয়ের দুমাসের পর মেয়েটার জামাই মারা গেল। অনেকে মনে করে যমদূতের নাম নয়নদেবী। দুইমাস এই মদ্যপ ব্যক্তির ক্রমাগত অত্যাচরে সৃষ্ট ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়তো তার এই স্বামী হত্যা। কিন্তু এটা শুধুই অনুমান। ঘটনাটা শুনে আমার খুব মায়া হলো।

হয়তো কয়েকদিন পর তা ভুলে যেতাম যদিনা রিপন বাবু এই ধরণের প্র¯তাব না দিতেন- -স্যার আমি বলি কি মেয়েটাকে আপনি বিয়ে করেন। আপনার উদাসী ভবঘোরে জীবনের অসুখও সারবে আর মেয়েটার জীবনও বাচঁবে, তার স্বপ্নও বাচঁবে। -তা আর হয় না। ছেলেরা কী বলবে। আমারও তো সূর্য অ¯ত যাচ্ছে।

আর তোমার বৌদি......। -আপনার ছেলেরা আপনার স্বর্গীয় স্ত্রী সবাই খুশি হবে। বৌদি যদি পারতেন আপনার আর একটি বিয়ের ব্যবস্থা করতেন। কারণ আপনার সুখই তাকে আনন্দ দিবে । আর আপনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট নভেল পড়েছেন বলে যে আর কোন নভেল পড়বেন না তা কি হয় ? আমি জানি রিপন বাবু এই যুক্তি এখানে খাটেনা।

জীবনের এমন কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে কোন যুক্তিতর্ক হয় না। এখানে শুধু আবেগের অবাধ বিচরণ। কিন্তু তারপরেও ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলম না। এরই মধ্যে শুনতে পারলাম মেয়েটার সাথে আবার এব থুরথুরে বৃদ্ধের বিয়ের কথা চলছে। মেয়েটা হয়তো কিছুই বলতে পারবে না।

কারণ অন্ধকার ঝড়ো রাতে নীড়হারা পাখির জন্য আশ্রায়টাই মূখ্য। সংবাদটা আমি কেন জানি মেনে নিতে পারলাম না। চারপাশের সবকিছু জীবšত হয়ে আমাকে যেন বলতে লাগল ‘দেখ মেয়েটার কথা বলার সাহসটুকু নেই, কত অসহায়। তুমিই পার একটি স্বপ্নের অপমৃত্য রোধ করতে’। সেদিন রাতে আর ঘুমাতে পারিনি।

মনে হচ্ছিল অসহ্য কোন অস্থিরতাকে চেপে ধরে শুয়ে আছি। পরদিন সকালে কলেজে গিয়েই রিপন বাবুর সাথে কথা বলি। আমার মনের অবস্থা সে বুঝতে পেরেছিলো। সেদিনই সে বিয়ের প্র¯তাব দয়ে। পুতুলের সাথে কথা বলার সাহস আমার নেই।

সুজন ও সুমনের সাথে কথা বলি। বাবাকে হয়তো ‘না’ বলার সাহস তখন পর্যšত তাদের ছিল না। কিন্তু ‘তুমি যা ভাল বোঝ’ তার অর্থ যে তারা বিয়েতে রাজি না তা বুঝতে পারিনি। খুব তাড়াতাড়িই তা বুঝতে পারলাম। বিয়েতে আমার দুই ছেলে এসছেলি।

তবে বাড়িতে যতদিন ছিল খুব না পারতে আমার সামনে আসতো না। নয়নদেবীর সাথে কথা বলত না। আমি বুঝতে পারছিলাম না এটা কি লজ্জা না ঘৃনা। তারপর থেকে আমার ছেলেরা বাড়িতে আসা কময়িে দিল। আসতে বললে নানা অজুহাতের কথা শুনিয়ে দিত।

আর যখন আসতো তখন মনে হতো বাগানটাতে যেন ফুলে ভরে উঠেেছ। পাখিরা গান গাইছে। কিন্তু এটা শুধু আমার কল্পনা। বা¯তব ছিলো ঠিক তার উল্টো। হৃদয়ের সম¯ত স্নেহ বুকে জমা করে রাখতে হতো।

প্রকাশ করার কোন সুযোগই দিত না। কোন দিন ছেলেদের রুমে ঢুকলে তারা কৃএমি মনযোগে পড়ালেখা শুরু করে দিত যেন আমার দিকে তাকানোরই সময় নেই। আমি খুব নিরবে চলে যেতাম। স্নেহগুলো মুক্তির জন্য হাহাকার করত। কিন্তু চাপা রাখতে হতো ।

কত কথা বলতে ইচ্ছা করতো তখন। ‘তোদের প্রতি আমার ভালবাসা কত গাঢ়, তোদের নিয়ে আমার যত স্বপ্ন সৃষ্টি, তোরা ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই, তোদের শূন্যতা পূরন করতে পারবি শুধু তোরাই’। কিছুই বলতে পারতাম না। কোন দিন যদি দেখি সুমন গায়ে জ্বর নিয়ে শুয়ে আছে তখন সারারাত আমি ঘুমাতে পারতাম না। কিন্তু গায়ে হাত দিয়ে দেখতাম না জ্বর কেমন।

এটাই আমার ভুল। ভালবাসা আসলে প্রকাশ করতে হয়। না পারলেও কষ্ট করে হলেও প্রকাশ করতে হয়। আজ চার মাস হলো সুমনরে কোন খবর নেই। বাড়িতে আসছে না ফোন করলে রিসিভ করে না।

করল্ওে কৃত্রিম একটা ব্য¯ততা দেখায়। ঠিক করেছি ঢাকা যাব। আমার ছেলেদের জুড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলব -সবকিছুর জন্য আমি দায়ী। তোদরে মায়রে মৃত্য, পুতুলের বিয়ে, তোদের সাথে এই অসহনীয় দূরত্ব সবকিছুর জন্য আমিই একমাত্র দায়ী। শত শা¯িতর বিনিময়ে হলেও আমি মুক্তি চাই,ক্ষমা চাই।

বৃষ্টির মাত্র। আরো বেড়ে গেল। তার সাথে ঝড়ো হাওয়া যেন প্রতিযোগিতা করছে। রাখালের বাড়ির সামনের আমগাছটা মনে হচ্ছে কোন শিল্পির ক্যানভাসের কালো লম্বা একটা দাগ। আর রাখালের চোখ দুটিকে মনে হচ্ছে ঝর্না।

সে কাদঁছে। বেশ বুঝতে পারছি। শাওনের এই ঝড়ো রাতে আর বাড়ি ফেরা যাবে না। রাতে ভাত খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। টিনের বৃষ্টির শব্দ লন্ডনে খুব মনে পডত।

কিন্তু এই রাতে বৃষ্টির শব্দ আমাকে টানছে না। আমার স্মৃতির ভাগাড় থেকে কিছু স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে আসল। ছোট সুজন-সুমন কে বৃষ্টিতে ভজিে ভজিে স্কুল থেকে নিয়ে আসছে। কিন্তু খুব যতœ করে রাখাল তাদের উপর ছাতা ধরে আছে। ছোট থাকতে সুমনের একবার ভীষণ অসুখ হয়েছিল।

ডাক্তার বলেছিলেন কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। রাখাল ঠিক করেছিলো ছলেরে জন্য নজিরে কিডনি দেিয় দবি। ে একদিন রাখালের বাড়িতে আগুন লেগেছিল। পুতুলকে কোথাও খুঁজে পওয়া যাচ্ছিল না। রাখাল জলšত ঘরের মধ্যে ঢুকে পুতুলকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আসছেলি।

সদেনি রাখালের মাথার চুলসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গিয়েছিল। এখনও তার মাথার পিছনের ভাগে চুল ওঠেন। ি এই রকম আরো হাজারো আত্মত্যাগ হয়ত আমার হয়তো অজানা। কিন্তু পুতুল,সুজন ও সুমন তারা তো জানে। আজ তাদের বাবার জীবনের গোধূলী বেলায় সামান্য শান্তি কেন তাদের সহ্য হবে না।

রাখালের ও তো কিছু প্রয়োজন থাকতে পারে। তার জীবন যৌবন এখনোতো নিঃশেষ হয়ে যায় নি। আর এই একাকী বাড়িতে তারও তো ইচ্ছা হতে পারে কেউ একজন দরজা খুলে দেবে। বৃষ্টির কোন এক বিকেলে খুব যতœ করে চা করে দেিব। শীতের সময় তার গোসলের জন্য একটু গরম পানি করে দেিব।

আর মাঝে মাঝে মনের কুশলাদি জানতে চাইবে। তাদের বাবার এই সামান্য সুখ কেন তারা মেনে নিতে পারবেনা? যিনি তাদের সুখের জন্য আনন্দজীবন বাদ দিয়ে গাধাজীবন বেছে নিয়েছেন। ঠিক এই মুহূতে আমার বাবার একটা করুন চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে আসলো। বাবাকে রাখালের জায়গায় আর আমাকে সুমন সুজনের জায়গায় রাখতেই বুঝতে পারলাম বাবাও নিশ্চয় রাখালের মতো ঠিক এই ভাবে কেঁদেছিলেন। লন্ডন থেকে ফিরে আসার হাজারো প্রত্যাখাত অনুরোধ হয়তো বাবার চোখেও ঠিক এইভাবে জল এনেছিল।

নিজেকে অপরাধীর চেয়ারে বসিয়ে আমি চোখ বন্ধ করলাম। তারপর হৃদয়ের গভীর থেকে আমার সম¯ত ভালবাসাসিক্ত একটি বাক্য বের করে আনলাম-‘বাবা আমাকে ক্ষমা কর’। হাজার বছর আগের শুকতারা এখনো নীল আকাশে জ্বলে চলছে। আমাদের জীবনের অনেক উপলব্ধি চার আনার অচল পয়সার মত একসময় হয়তো হারিয়ে যায়। কিন্তু সে রাতের উপলব্ধি আমার জীবন আকাশে শুকাতারার মতো বয়ে যাবে।

একে আমি হারিয়ে যেতে দিব না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.