প্রথম আলো
দেয়ালে সাঁটানো চাররঙা পোস্টারে ছেলের ছবি দেখে থমকে দাঁড়ান নিরক্ষর নার্গিস বেগম (৪৫)। পোস্টারের কাছে গিয়ে নিশ্চিত হন, এটা তাঁর ছেলে ফরহাদের (১৯) ছবি। দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওঠার পর পড়ালেখার পাট চুকাতে হয়েছে ফরহাদকে। এখন মাছবাজারে দিনমজুরের কাজ করেন।
পোস্টারে ফরহাদের ছবি দেখে অজানা শঙ্কায় পেয়ে বসে ভৈরব পৌর শহরের চণ্ডীবেড় দক্ষিণপাড়ার নার্গিসকে।
এক পথচারীকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বাজান, পোস্টারে কী লিখা আছে। ’
পোস্টারে বড় অক্ষরে লেখা: ‘প্রথম বছরেই বিস্ময়কর সাফল্য। “ওরা আমাদের গর্ব, ওরা আমাদের অহংকার। ” তোমাদের জন্য প্রাণঢালা অভিনন্দন-অভিনন্দন-অভিনন্দন। ’
এটা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টার প্যারাগনের বিজ্ঞাপন।
ঢাকার প্যারাগন কোচিং এ বছরই ভৈরবে তাদের শাখা খুলেছে। শাখাটির অবস্থান ভৈরব পৌর শহরের রফিকুল ইসলাম মহিলা কলেজ সড়কে। এ বছর থেকে চালুর প্রক্রিয়া শুরু হলেও তাদের সেন্টার থেকে কোচিং করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে—এমন ২৭ জনের ছবিসংবলিত একটি পোস্টার শহরে কয়েক মাস ধরে শোভা পাচ্ছে।
প্রথম আলো এই ২৭ জনের বিষয়ে অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হয়েছে, এদের কেউই প্যারাগন কোচিং সেন্টার থেকে কোচিং করেননি। আবার ফরহাদের মতো অনেকে জানেই না তাঁদের ছবি কীভাবে সাফল্যের তালিকায় স্থান পেল।
পোস্টারে ফরহাদের নাম আ. রহমান উল্লেখ করা আছে।
কোচিং সেন্টারের পোস্টারে নিজের ছবি দেখে ফরহাদ বলেন, ‘বিদেশ যামু মনে কইরা জীবনে একবার স্টুডিওতে যাইয়া ছবি তুলছিলাম। ছাপানো এই ছবিটা ছাড়া আমার আর কোনো ছবি নাই। নিজেও জানি না কীভাবে আমার ছবি পোস্টারে গেল। ’ জানতে চাইলে প্যারাগন ভৈরব শাখার পরিচালক আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘আসলে বিষয়টি কীভাবে হলো, আমরাও ঠিক বুঝতে পারছি না।
মনে হয় প্রেস ভুল করেছে। ’ শাখা চালুর পর কোনো পরীক্ষা না হলেও কীভাবে ২৭ জন সাফল্য পেল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আসলে আগের বছর অন্য একটি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করতাম। এরা আগের সেন্টার থেকে কোচিং নিয়েছিল। ’
তিন জেলায় কোচিংয়ের হাট: সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শুধু প্যারাগন নয়, ঢাকার বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের প্রায় এক ডজন শাখা নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলা সদরে খোলা হয়েছে। এর মধ্যে প্যারাগন, লিডস ভার্সিটি, ইউসিসি, ইউনিএইড (কিরণ-সুমন-কবির), এডমিশন প্লাস, ইউনিভার্সিটি এডমিশন কেয়ার, ইউএসি, পজিট্রন, ইউনিএইড (মনির-মল্লিক-জহির), এভিনিউ কোচিং, মেডিকেল কলেজ ভর্তি কোচিং প্রাইমেট উল্লেখযোগ্য।
সেন্টারগুলোর নাম ভিন্ন হলেও শিক্ষার কৌশল এবং শিক্ষকের মান প্রায় একই রকম। প্রায় চার মাসের কোর্সের জন্য শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তারা গড়ে পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা নিয়ে থাকে।
কোচিং করেছে এমন কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, প্রথম কয়েক দিন প্রধান কার্যালয় থেকে শিক্ষক আসেন। পরে স্থানীয় শিক্ষক দিয়েই ক্লাস পরিচালনা করা হয়। সপ্তাহে চার দিন ক্লাস হওয়ার কথা।
কিন্তু সব সপ্তাহে হয় না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভর্তি গাইড ও লেকচার শিট দেওয়া হয় না। ডেইলি টেস্ট, রিভিশন টেস্ট, পেপার ফাইনাল, সাবজেক্ট ফাইনাল, মডেল টেস্ট ইত্যাদির কথা বলা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার সব হয় না।
প্রচার: প্রচারকাজে বেহিসাবি লিফলেট, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন, তথ্য স্মরণিকা, প্রসপেক্টাস ব্যবহার করা হচ্ছে। তা ছাড়া বাড়ি-বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী সংগ্রহ এবং শিক্ষক কমিশন প্রথা চালু এই প্রচারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রধান সড়কে ২০ থেকে ৩০ গজ দূরত্বে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের ব্যানার। সড়কবাতির খুঁটি, ছোট-বড় গাছ—সবকিছুতে ব্যানার লাগানো। ‘অবাক করা সাফল্য’, ‘বিস্ময়কর সাফল্য’, ‘তাক লাগানো সাফল্য’, ‘চোখ ধাঁধানো সাফল্য’, ‘আশ্চর্য রকম সাফল্য’, ‘হতবাগ হবার মতো সাফল্য’ ইত্যাদি ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে এসব পোস্টার-ব্যানারে।
ভৈরব জিল্লুর রহমান মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আবু সাঈদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশন যেমন আচরণবিধি জারি করে যত্রতত্র প্রচারণার অত্যাচার থেকে নাগরিকদের রক্ষা করেছে, তেমনি কোচিং সেন্টরের বেলায় এমন আচরণবিধি করা দরকার।
একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জনকারীদের তালিকায় দিনমজুর ফরহাদের ছবি আসলে কোচিং সেন্টারের প্রতারণার চিত্র।
এর মাধ্যমে সামান্য হলেও প্রকাশ পেয়েছে কোচিং সেন্টারগুলোর শিক্ষা-বাণিজ্যের অন্ধকার দিক।
নীতিবর্জিত কর্মকাণ্ড: ভৈরবের শিক্ষার্থী মানাল বিনতে মো. উল্লাহ ও আবদুল্লাহ আল হামীম টানাহেঁচড়ার শিকার হয়েছেন বলে জানান। ইউসিসি এবং প্যারাগন ভৈরব শাখার পোস্টারে তাঁদের ছবি ছাপিয়েছে।
মানাল তাঁর কাছে পড়ত কি না জানতে চাইলে প্যারাগনের পরিচালক বলেন, ‘মানাল আমার এখানে মডেল টেস্ট পরীক্ষা দিয়েছে। সে হিসেবে তাকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।
’
ইউসিসি কোচিং সেন্টার ভৈরব শাখার পরিচালক এনামুল হক বলেন, ‘আমার সেন্টার থেকে কোচিং করেছে এমন অনেক শিক্ষার্থীর ছবি বিভিন্ন কোচিং সেন্টার প্রচারণায় ব্যবহার করছে। বিশেষ করে, প্যারাগন আমাদের মেধাবীদের নিয়ে বাণিজ্য করছে। ’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শারমিন আক্তার ও শারমিন ইসলাম নামের দুই শিক্ষার্থীর ছবি ইউসিসি, ইউনিভার্সিটি এডমিশন কেয়ার এবং ইউএসি কোচিং পোস্টারে ছাপিয়েছে।
ইউনিভার্সিটি এডমিশন কেয়ার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শাখার পরিচালক তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘দুই শারমিনই আমাদের এখানে কোচিং করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। আমাদের সাফল্য কেড়ে নিয়ে ইউসিসি ও ইউএসি শিক্ষার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
’
পাল্টা দাবি ইউসিসির পরিচালক ইজাজ বিন আজিজের। তিনি বলেন, ‘দুই শারমিন আমাদের এখানে পড়েছে। এডমিশন কেয়ার ভুয়ামি করেছে। ’
ইউনিএইড নরসিংদী শাখার পরিচালক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এখান থেকে কোচিং করল আর তাদের ছবি ছাপিয়ে গর্ব করে অন্যরা। সে দুঃখে এবার আমি পোস্টারই করিনি।
’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ কাজী মো. মোস্তফা জালাল প্রথম আলোকে বলেন, এরা কোচিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের হাতে কিছু শিট ধরিয়ে দেয়। এতে শিক্ষার্থীদের খুব বেশি উপকৃত হওয়ার সুযোগ নেই। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।