"I am the master of my fate I am the captain of my soul" চট্টগ্রামের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা না থাকায় শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। সুযোগও পেয়ে যাই, ব্যস ভর্তি হয়ে গেলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১ম বর্ষ (জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও আর শাটল ট্রেন):
১ম বর্ষের শুরুতেই আন্দোলনের মুখোমুখি। আমাদের ডিপার্টমেন্ট নতুন একটি বিষয়ের উপর ছাত্র ভর্তি ও সার্টিফিকেট দেয়ার অনুমতির জন্য তখন আন্দোলন করছিলো। বিষয়টি আগে থেকেই আমাদের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত ছিলো তাই দাবি না মানার কোনো কারন ছিল না।
বাদ সাধল অন্য একটি ডিপার্টমেন্ট যারা নিজেরাও একই বিষয় খোলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো। ব্যস একাডেমিক মিটিং এর আগে আন্দোলন জোরসে শুরু হলো। আর জুনিয়র হওয়ার সুবাদে আমাদের আন্দোলনে খুব ভালো করেই ব্যবহার করা হল। মিছিল, VC অফিসের সামনে অবস্থান, স্বারকলিপি প্রেরণ, ডিপার্টমেন্টে তালা দেওয়া হতে সবই করলাম তবুও কাজ হচ্ছিলো না। শেষে বিশ্ববিদ্যালয় অবরোধও করলাম শুধু ভাঙচুর করা হলো না।
যাইহোক শেষ পর্যন্ত কাজ হয়েছিলো যদিও আমাদের কোনো লাভ হলো না। আমাদের নতুন বিষয়ের উপর সার্টিফিকেট দেয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়ে উঠলো না। পরে বুঝতে পারলাম আমাদের ব্যবহার করে আমাদের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকরা তাদের স্বার্থ স্বিদ্ধ করে নিয়েছে, কিছু নতুন পদ যুক্ত হবে, আলাদা দুটি ব্রাঞ্চ হবে, তাদের কিছুটা দাম বাড়বে। আর আমাদের খাতায় সেই জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও মিছিল শেষে ঝুপড়িতে বসে এককাপ ফ্রী চা ছাড়া আর কিছুই জুটল না। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আমাদের শুধু ব্যবহার করা হল।
তা নিয়ে এখন আর আক্ষেপ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতের জন্য শাটল ট্রেনেই চরতাম। ট্রেনের বগীর দুই পাশে আলাদা- আলাদা গ্রুপের চিকা মারা থাকতো। কোনোদিন উভয়পাশেই আবার কোনোদিন একপাশে ওই গ্রুপের ছেলেরা ড্রামের তালে তালে গান করত। প্রথম প্রথম এই গান আর ড্রামের আওয়াজ গুলো জগন্য মনে হতো।
পরে অভস্ত্য হয়ে গেলাম। বরং গান না শুনলে ট্রেন যাত্রাটা বেশ দীর্ঘ মনে হত। পরে জানলাম আমাদের ডিপার্টমেন্টেরও নিজস্ব গ্রুপ আছে। ব্যস বন্ধুদের সাথে সেখানে ওঠা শুরু। অদ্ভুত লাগতো কিভাবে সিনিয়র ভাইরা বগীর পেছনে যেকোনো গানের সাথে তাল মিলিয়ে ড্রাম বাজিয়ে যায়।
সবাই ড্রাম বাজাতে না পারলেও গ্রুপে দু’তিনজন ড্রামার থাকতো। আমার নিজেরও ড্রাম পিটানোর ইচ্ছা প্রবল হতে থাকলো, ব্যস শিখার চেষ্টা শুরু (লক্ষণীয় বস্তুত বগীর ড্রাম বলতে বগীর পিছনে কিছুটা খোলা অংশে উপরের দিকে থাকা টিন বা কাঠের পাঠাতনকে বুঝানো হচ্ছে, যার পিছনের অংশ ফাঁকা বা তুলো দিয়ে ভরাট থাকে) । ড্রামারের ড্রাম বাজানোটা লক্ষ্য করতাম পরে নিজে নিজে চেষ্টা করতাম। ঝুপড়িতে বা ক্লাসে যেখানেই বসি না কেন হাত নিজে নিজে চলছেই। অনেকে বিরক্ত হত বটে তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অহরহ ঘটনা বলে তেমন একটা বিরক্তি দেখাতো না।
একসময় আয়ত্ব হয়ে গেল। সেই মাইলস এর নিলা গানটার তালে তালে ড্রাম বাজানো শুরু। সে এক অদ্ভুত ভালোলাগা। আমাদের মধ্যে আমি আর জনি ড্রাম পেটাতাম আর সবাই মিলে গান করতো। সব ধরনের গানই কমবেশি গাওয়া হত, আবার সাথে থাকতো বিজ্ঞাপন বিরতি।
সেই থেকে শুরু বগীতে গান গাওয়া। বগীর পেছনের ছোট্ট ঐটুকু জায়গায় ৫-৬জন থেকে শুরু করে ১৫-২০জন ঠাসাঠাসি করে দারিয়ে থেকে ড্রামের তালে তালে গান গাওয়া, সাথে আছে ধমবন্ধ করা সিগারেটের ধোয়া আর নিজ ঘামে নিজেই গোসল করার অভিজ্ঞতা। সিনিয়ররাও ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে পরায় বগীতে সবসময় আমরাই গান গাইতাম মাঝে মাঝে সিনিয়র ভাইরা যোগ দিত। সবার সাথে বন্ধুত্বও ধীরে ধীরে গাড় হতে লাগলো।
গানবাজনা করলেও কখনও ক্লাস ফাঁকি দেইনি, ৯৭% উপস্থিতি ছিল ১ম বর্ষে।
সে যাই হোক খুব কমই ঠিক সময়ে ক্লাস শুরু হত, কখনোবা স্যার ক্লাস নিতেন না বা আসতেন না। সময় কেটে যেত ঝুপড়িতে গান গেয়ে, কার্ড খেলে আর আড্ডায়। কোনো কোনো শিক্ষক ম্যারাথন ক্লাশ নিতেন ২ ঘন্টা বা তারও বেশি সময় ধরে। তো আমাদের এক শিক্ষক পুরো বছরই কোনো ক্লাস নিলেন না। পরীক্ষার ২ মাস আগে তিনি ক্লাস নিতে এলেন।
এসে তিনি জানালেন তার পক্ষে বেশি ক্লাস নেয়া সম্ভব না কারন তিনি PhD করার জন্য কয়েক দিনের মধ্যে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন, ফিরবেন ৪ বছর পর। তাই যে কয়দিন হাতে পান আমাদের পুরো সিলেবাস শেষ করে দিয়ে যাবেন। এর আগে তিনি পিতৃত্ব-কালীন (সঠিক শব্দটা কি হবে বুঝতে পারছিনা) ছুটি নিয়েছিলেন ২ মাস। এই ছুটিটাই আমাদের কাছে নতুন ছিলো। প্রথম ক্লাস গেল গাল গপ্পে সবার নাম-বাড়ি এই নিয়ে।
দ্বিতীয় ক্লাসে এসেই ঘোষনা “ আজ আমি তোমাদের সিলেবাসের (উক্ত বিষয়ের সিলেবাস) ২০% পড়াব’। আমরা সবাই প্রস্তুত খাতা কলম নিয়ে। সেই ক্লাসে তিনি প্রোজেক্টর এর মাধ্যমে পাওয়ার পয়েন্টে তৈরি করা লেকচার থেকে পড়াচ্ছিলেন। লেকচার শেষে তিনি আমাদের লেকচারের হার্ডকপি দিলেন যাতে কিনা প্রতি পেইজে ৬টি করে স্লাইড ছিল। আমাদের একজন উঠে জিজ্ঞেস করলো “ স্যার আমরা কি পরীক্ষার খাতায়ও এইভাবে ছোটো বক্স করে লিখব?” হাসির একটা রোল পড়ল তবে আইডিয়াটা মন্দ ছিলো না।
পরের ক্লাসে এসে তিনি আরও ২০% পড়ানোর কথা বলে কোনোমতে কিছু সংজ্ঞা আর পরীক্ষার কি কি থাকতে পারে ধারনা দিয়ে বিদায় নিলেন। এর পরের ক্লাসে আসে আমাদের ৬০% পড়াবেন বলে কি টপিকস এর উপর কত নাম্বারের প্রশ্ন হতে পারে বলে বিদায় নিলেন আর আমরা পড়লাম মাইনকা চিপায় । তার নাম পরল পারসেন্টেজ স্যার। অপর একটি বিষয়ের আমাদের পুরো ডিপার্টমেন্টের সবার প্রিয় শিক্ষকের (এখনও তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি) হঠাৎ মৃত্যুর ফলে ওই বিষয়টি পড়ানোর দায়িত্ব পেল অপর এর সিনিয়র শিক্ষক। তিনি ক্লাসে এলেন একগাদা প্রিন্ট করা লেকচার নিয়ে।
সেগুলো ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ এর হাতে তুলে দিয়ে বললেন “এই বিষয় আমি পড়াইনাতো তাই হঠাৎ করে তোমাদের পড়াইতে পারতাছিনা। তোমরা এই নোটগুলা পড়বা তারপর আমারে পড়াইবা”। স্যারের কাজ ছিলো প্রতি ক্লাসে এসে আমাদের কিছু প্রিন্ট করা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে যাওয়া যা কিনা ইন্টারনেট থেকে সরাসরি প্রিন্ট করা (অনেক ক্ষেত্রে ঐ ওয়েব সাইটের হোমপেজ সহ)। তিনি সিলেবাস থেকে টপিকস এর নাম দিয়ে নেটে সার্চ করে যা পেতেন তাই প্রিন্ট দিয়ে আমাদের দিয়ে দিতেন। এ থেকে আমাদের ফয়দা কিছুই হল না শুধু টেবিলে ফটোকপির স্তুপ বাড়লো।
পরে সিনিয়রদের কাছ থেকে জানলাম তিনি এখানে শিক্ষকতা করতে আসেননি এসেছেন চাকরি করতে। পরে অবশ্য স্যার নিজেও একই কথা বলেছিলেন যখন আমরা তাকে আবার ৪র্থ বর্ষে পেলাম। এইরকম অনেক শিক্ষকই আছেন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে আসেন।
পরীক্ষা এল পরীক্ষা দিলাম। বলাবাহুল্য PhD করতে যাওয়া সেই শিক্ষক এর কোনো % পরীক্ষায় কাজে লাগে নাই আর “ তোমরা পড়ে আমারে পড়াইবা”- এই ক্ষেত্রে আমরা স্যারকে পড়াইতে ব্যর্থ হলাম।
একইভাবে ভুগলাম প্রেকটিকেল পরীক্ষায়। সারা বছর কোনো প্রেকটিকেল না করিয়ে পরীক্ষার ১৫ দিন আগে সব বিষয়ের প্রেকটিকেল একসাথে শুরু হল। প্রেকটিকেল করালো ডেমন্সট্রেটর, শিক্ষকদের কোনো খবরও নেই। তাদের কাছে গেলেই দেখিয়ে দিচ্ছে ডেমন্সট্রেটরকে। এদিকে ডেমন্সট্রেটর সাহেব কিছু ছাত্র থেকে ৫০০টাকা করে নিয়ে তাদের এক্সট্রা ক্লাসস নেয়া শুরু করলেন।
প্রথমে ৩-৪ জন থাকলেও পরে সবাই তার স্পেশাল ক্লাসে যোগ দেয়া শুরু করলো। ডেমন্সট্রেটরও তার ক্লাস ফি ৫০০ থেকে ১০০০ এ উন্নিত করলেন। এই অন্যায় দেখেও কোনো কিছু করার ছিল না। পরে আমরা কয়েকজন মিলে ঠিক করলাম এই বিষয়টা ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানকে জানাতে হবে। যেই বলা সেই কাজ, আমাদের একজন গলা পরিবর্তন করে চেয়ারম্যানকে অভিবভাবক হিসেবে ফোন করে বিষয়টি জানালো।
পরের দিন থেকেই একশান শুরু। সহপাঠীরা তাদের টাকা হারালো স্পেশাল ক্লাসও হারালো আর প্রেকটিকেলে A+ পাওয়ার সেই আশাটাও ভেস্তে গেল। এই ব্যপারে তারা অবশ্য আমাদেরই সন্দেহ করেছিলো কারন আমরা ছাড়া সবাই ঐ স্পেশাল ক্লাস করতেছিলো। আহা বেচারা ডেমন্সট্রেটর এর এক্সট্রা আয়ও বন্ধ হয়ে গেল। এই ঘটনার পর শিক্ষকদের টনক নড়ল তারা পুরো পরীক্ষার সময় নিজে উপস্থিত ছিলেন।
পরীক্ষায় শিক্ষকদের গার্ডও লক্ষ্য করার মত ছিল, একজনের জায়গায় ৩জন গার্ড দিচ্ছিল। ডেমন্সট্রেটরকে আমাদের পরীক্ষা চলাকালিন সময়ে সকল রকম দায়িত্ব থেকে দূরে রাখা হয়ে ছিল। এতটুকুই তার শাস্তি ছিল তবে পরে আর কখনও স্পেশাল ক্লাস নেয়ার সাহস দেখায় নি।
২য় বর্ষ (শিক্ষকদের কলহ আর সেশন জট):
শাটল ট্রেনকে সঙ্গী করে বন্ধু-বান্ধবের সাথে ২য় বর্ষের শুরুটা ভালই ছিল। ক্লাসের অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি বলা বাহুল্য।
অতদিনে বুঝতে পারলাম প্রতি বর্ষে % টাইপের শিক্ষক দু-একজন থাকবেই। ১ম বর্ষের শেষের দিকে আমাদের ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান পরিবর্তন হয়। তো সবার আশা ছিলো এবার খুব ভালো কিছু হবে কারন নতুন চেয়ারম্যান নাকি খুবই ভালো একজন মানুষ এবং খুবই জ্ঞানী। জ্ঞানী মানতেই হবে তা সফটওয়্যার হোক, ওয়েবসাইট হোক বা আর্কিটেকচারই হোক না কেন তার জ্ঞান ছিলো সুদূর প্রসারী। অন্যান্য শিক্ষকদেরও বলতে দেখেছি তার ১ ঘন্টার ক্লাস অন্য সব শিক্ষকদের ১মাসের ক্লাসের চেয়েও উত্তম।
কিন্তু তার এই জ্ঞান দেখা বা পাওয়ার সুযোগ আর আমাদের হল না। পরে তাকে যত চিনেছি জেনেছি ততই ঘৃণা জন্মেছে আর তাকে আমরা শেষ পর্যন্ত জ্ঞানপাপী নামে ডাকতাম। তো লেখার সুবিদার জন্য তার নামটা তাহলে জ্ঞানপাপীই রইলো এখানে।
*************************************
আমি কোনো সাহিত্য লেখক নই তাই লেখার মান ভালো না। আর এইটুকু ঘটনা লিখতে গিয়ে বুঝলাম লেখা মনে হয় আমার দ্বারা হবে না, অত ধৈর্য আমার নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।