বাবর, সালাম পিন্টু ও তাজউদ্দিন জড়িত থাকার তথ্য আজগুবি গল্প বলেছিলেন খালেদা জিয়া
- মেজর জেনারেল (অব.) সাদেক হাসান রুমির জবানবন্দি
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপ-মন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু ও তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় জড়িত মর্মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে জানালে, তিনি তা আজগুবি গল্প হিসাবে মনত্মব্য করেছিলেন।
গোয়েন্দা সংস্থা তৎকালীন ডিজিএফআইয়ের ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজি) মেজর জেনারেল (অব.) সাদেক হাসান রুমি ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে জানালে তিনি ওই মনত্মব্য করেন। এ মামলার অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত মুফতি হান্নান ও মাওলানা তাজউদ্দিনের জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতেই তিনি এ তথ্য জানিয়েছিলেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাক্ষী হিসেবে দেয়া জবানবন্দিতে তিনি একথা উলেস্নখ করেন। গত বছরের ২০ জুন তদনত্ম কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দের কাছে তিনি এ জবানবন্দি দেন।
একইদিন এ জবানবন্দি তিনি ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছেও দেন।
জবানবন্দিতে তিনি উলেস্নখ করেন, ২০০২ সালের মে মাসে তিনি ডিজিএফআইয়ে ডিজি হিসেবে যোগদান করেন। ২০০০ সালে ব্রিগেডিয়ার রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী সিআইবিতে ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। রেজ্জাকুল হায়দার ডিরেক্টর সিআইবি হিসেবে সরাসরি তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বিষয়টি আমার খুব ভালো না লাগায় কখনও কখনও তাকে এ ব্যাপারে সাবধান করতাম।
উত্তরে তিনি আমার ও ডিজিএফআই প্রতিষ্ঠানের কোনও ক্ষতি হবে না বলে আশ্বাস দিতেন।
আমি ডিরেক্টর সিআইবি হিসেবে অন্য একজন ভালো অফিসারকে পোস্টিং দেয়ার প্রসত্মাব করলেও লুৎফুজ্জামান বাবর ও তারেক রহমান তাকেই পোস্টিং দিয়েছিলেন।
ফলে সে আমার কথার গুরুত্ব না দিয়ে ওদের তথ্যের গুরুত্ব দিতেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ওইদিন বিকাল সাড়ে ৫টা-পৌনে ৬টার দিকে ঢাকা ডিটাসমেন্ট কমান্ডার কর্নেল ইমাম (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) আমাকে মোবাইল ফোনে জানায়। আমি তখন বাসায় অবস্থান করছিলাম।
আমি ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে জানানোর চেষ্টা করেছিলাম। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী ঢাকার বাইরে নোয়াখালী জনসভায় ছিলেন। তাকে বা তার এডিসিকে না পেয়ে আমি তার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে মোবাইল ফোনে অবহিত করি এবং প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর জন্য অনুরোধ করি। হারিছ চৌধুরী এ ঘটনা জেনে কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন বলে জানান। আমি গ্রেনেড হামলার ব্যাপারে আরো বিসত্মারিত কিছু বলার আগেই তিনি মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
স্বরাষ্ট্র-প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকেও একইভাবে জানালে তিনি অফিসে আছেন এবং শুনেছেন বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
ঘটনার পরদিন সকালে রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী আমাকে জানান যে, ঘটনার রাতেই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর টেলিফোনে তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর লোক পাঠিয়ে ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা অবিস্ফোরিত গ্রেনেডগুলি দ্রুত ধ্বংস করে ফেলতে। নির্দেশ পেয়ে রাতেই দুটি গ্রেনেড ওসমানী উদ্যানে ধ্বংস করা হয়েছে। অবশিষ্ট গ্রেনেড দুটি পরদিন বিকালে ক্যান্টনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড মাঠে ধ্বংস করা হয়।
২২ আগস্ট বিকালে প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য ডিজিএফআইয়ের কয়েকজন অফিসারকে পাঠানো হলে ঘটনাস্থল কর্ডন করে রাখা পুলিশ তাদের ঢুকতে দেয়নি।
ওইদিন ১২টার দিকে আমি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে ডিজিএফআইয়ের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালানোর অনুমতি চাই। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেন, এ ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য একটি কমিটি করে দেয়া হবে, আপনাদের অনুসন্ধানের প্রয়োজন নাই। এ ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে মিটিং হত সেখানে যদি রেজ্জাকুল হয়দার ডিজিএফআইয়ের পক্ষ থেকে উপস্থিত থাকতেন।
একইবছর সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজারে ব্রিটিশ হাই-কমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলাসহ বেশকয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর ২০০৫ সালে ১৭ আগস্ট সারাদেশে বোমাহামলার ঘটনা ঘটে।
তখন সরকার দেশি-বিদেশি চাপের মুখে তৎপর হয়ে ওঠে।
আমি রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীর বিভিন্ন কাজে অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে অন্যত্র বদলির জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করি। তখন তাকে কমান্ডার এয়ার ডিফেন্স ব্রিগেড মিরপুর ঢাকায় বদলির আদেশ দেয়া হয়। বদলির আদেশের দিনই সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ওই বদলির আদেশ বাতিল করে ২-৩ দিন পর তাকে এনএসআইয়ের একটিং ডিজি হিসেবে বদলির আদেশ দেন। মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতির যোগ্যতা ছাড়াই ২-৩ মাস পর তাকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে এনএসআইয়ের ডিজি হিসেবে স্থায়ী করা হয়।
মেজর জেনারেল হতে গেলে তাকে কোনও ব্রিগেড কমান্ড করতে হয় কিন্তু তিনি কোনও ব্রিগেড কমান্ড করেন নাই।
রেজ্জাকুল হায়দারকে এনএসআইয়ের একটিং ডিজি হিসেবে বদলির পর সিআইবির ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন ব্রিগেডিয়ার বারী। ওই সময় সিআইবিতে ডিরেক্টর হিসেবে এটিএম আমিনও কর্মরত ছিলেন। ওই সময় সিআইবিতে (কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স বুরো) জিএসও-১ ছিলেন লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়াদ্দার। আমি ব্রিগেডিয়ার আমিন ও সাইফুল ইসলাম জোয়াদ্দারকে সারাদেশে বোমাহামলায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে নির্দেশ দেই।
তারা তখন আফগান ফেরত যোদ্ধা হুজি নেতা আব্দুস সালাম ও শেখ ফরিদসহ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে এ ঘটনা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে।
তারা কয়েকবার তাদের (সালাম ও ফরিদ)-এর সঙ্গে বৈঠক করে। এ রকম একটি বৈঠকে আমিও উপস্থিত থেকে তাদেরকে সহযোগিতা করতে বলি। তারা তখন রীতিমত ডিজিএফআইয়ের সোর্স হিসেবে কাজ করতে থাকে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে শরীফ শাহেদুল ইসলাম বিপুল ও মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২০০৬ সালের আগস্ট মাসে মুফতি হান্নান ও বিপুলকে টিএফআই সেলে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারা স্বীকার করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ অনেক হামলার সঙ্গে জড়িত। মুফতি হান্নান স্বীকার করে যে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সে পরিচালনা করেছে এবং ২১ আগস্টসহ ইতিপূর্বের সব হামলায় তাকে মাওলানা তাজউদ্দিন সহযোগিতা করেছে। সে আরও জানায়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় হুজি ছাড়া তাজউদ্দিনের ভাই আব্দুস সালাম পিন্টু ও লুৎফুজ্জামান বাবরও জড়িত। তারা হামলার সর্বপ্রকার প্রশাসনিক সহায়তার নিশ্চয়তা দিয়েছে।
ডিজিএফআই প্রতিনিধি টিএফআই সেল থেকে এসব তথ্য এটিএম আমিন ও সাইফুল ইসলাম জোয়াদ্দারকে জানায়। বিষয়টি আমি জানতে পেরে পুরো ঘটনার সঠিকতা সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে নির্দেশ দেই। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দুই মন্ত্রী জড়িত থাকার কথা উলেস্নখ থাকায় আমি তা টকিং পয়েন্ট হিসেবে লিখে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দেই এবং মুখেও বলি। তিনি কিছু না বলে টকিং পয়েন্ট তার কাছে রেখে দেন। পরবর্তীতে তিনি আমাকে এ বিষয়ে কোনও নির্দেশ দেন নাই।
এরমধ্যে ডিজি র্যাব আব্দুল আজিজ সরকার তাজউদ্দিনকে ধরতে টেলিফোনে আমার কাছে সহায়তা চান। আমি তাৎক্ষণিক আব্দুস সালামের মাধ্যমে সাইফুল ইসলাম জোয়াদ্দারকে বলি তাজউদ্দিনকে পাওয়া যায় কিনা দেখার জন্য। তাকে এও বলি যে, র্যাবও তাজউদ্দিনকে খুঁজছে। সাইফুল ইসলাম জোয়াদ্দার বলেন, তাজউদ্দিনকে র্যাবের হাতে তুলে দিলে অসুবিধা আছে। অসুবিধার কথা জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়, এতে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারে।
এর ২-১ দিন পর এটিএম আমিন আমাকে জানায় যে, সালামের মাধ্যমে তাজউদ্দিনকে পাওয়া গেছে। তাকে আমাদের গুলশান সেফ হাউজে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এর ২-১ দিন পর এটিএম আমিন ও সাইফুল ইসলাম জোয়াদ্দার আমাকে জানায়, তাজউদ্দিন মুফতি হান্নানের দেয়া বক্তব্য পরোপুরি স্বীকার করেছে। তারা আরো জানায়, তাজউদ্দিনের দেয়া বক্তব্য তারা লুৎফুজ্জামান বাবর ও প্রধানমন্ত্রীর পিএস-২ সাইফুল ইসলাম ডিউককে জানিয়েছে এবং বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নলেজে দিতে বলেছে।
এটিএম আমিন ও সাইফুল ইসলাম জোয়াদ্দার আমাকে পরবর্তীতে জানায়, লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাইফুল ইসলাম ডিউক বলেছেন তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
তারা আমাকে আরও জানায়, তাজউদ্দিন পাকিসত্মান যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। সে মোতাবেক তাকে পাকিসত্মান পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তখন আমি ওদের বলি তোমরা যখন সব ব্যবস্থা করেই ফেলেছ তখন আমাকে না জানালেই পারতে।
তবু আমি তাদের এ বক্তব্য যাচাই করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যাই এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাজউদ্দিন, এটিএম আমিন ও সাইফুল ইসলাম জোয়াদ্দারের বক্তব্য তুলে ধরি। আমার কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অনেকটা ক্ষুব্ধ হন এবং বিরক্তির সুরে বলেন যে, সিআইডি এ মামলা ইতিমধ্যে উদ্ঘাটন করে ফেলেছে।
আপনি কোথা থেকে এসব আজগুবি নতুন তথ্য নিয়ে এসেছেন। মাওলানা তাজউদ্দিন পাকিসত্মান যাবে না কোথায় যাবে তাতে আপনার মাথা ব্যথা কেন? এ বলে তিনি আমার সঙ্গে আর কথা বলেন নাই। আমি তখন বুঝতে পারি যে, প্রধানমন্ত্রী পূর্ব থেকেই সব কিছু জানেন। ফলে আমিও আর কথা না বাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিস ত্যাগ করি। এর ৩-৪দিন পর এটিএম আমিন ও সাইফুল ইসলাম জোয়াদ্দার আমাকে জানায় যে, তাজউদ্দিনকে পাকিস্তান পাঠানো হয়েছে।
মূল লিংক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।