"প্রত্যেক সত্ত্বাকে মৃত্যু আস্বাদন করতে হবে। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, নিঃসন্দেহে সে হল সফল। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। " আল ইমরান,আয়াত ১৮৫ ফেইসবুকে যখন বন্ধুদের আপলোড করা নীলগিরির ছবিগুলো দেখতাম তখনই মনে হত কবে যাব, কবে যাব !! যাক, আল্লাহর রহমতে সেই সুযোগ এসে গেল গত ৮ই জুন ২০১১।
মূলতঃ আমার শ্বশুড়ের উদ্যোগেই তার ছেলে, মেয়ে, জামাই এবং নাতি নাতনিদের নিয়ে এই ভ্রমনের আয়োজন। ছোট ছেলের ও লেভেল শেষ হলে সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাবেন, এটা আমার শ্বশুড়ের অনেক দিনেরই পরিকল্পনা। এবার তার বাস্তবায়নের পালা !
একটা বড় মাইক্রোবাস ভাড়া করে নিয়েছিলাম আমরা ঢাকা থেকেই। ভোরে রওনা দিয়ে দুপুর ২ টা নাগাদ আমরা বান্দরবান সেনানিবাসে। আগের এক পোস্টে বলেছিলাম, আমার ভায়রা মেজর সাহেব।
আর নীলগিরি মূলতঃ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরই একটি স্থাপনা, যদিও সেটা জনগণের জন্য উন্মুক্ত। তো থাকা খাওয়ার সকল ব্যবস্থাপনা আমার ভায়রাই করে রেখেছেন। রেস্ট হাউজের রুমগুলোর নাম রাখা হয়েছে বিভিন্ন উপজাতির নামে। আমি আমার পরিবারসহ "তঞ্চঙ্গা"” উপজাতির নামে রাখা রুমে জায়গা পেলাম। প্রথম দিনটি আমরা বান্দরবানেই থাকব।
পরদিন নীলগিরি যাব।
বিকেলে স্বর্ণ মন্দির দেখতে বের হলাম। নীচ থেকে অনেক বেশ খানিকটা উপরে একটা পাহাড়ের চূড়ায় স্বর্ণ মন্দির। আমার ১৬/১৭ কেজি ওজনের ছেলেকে নিয়ে উপরে উঠতে ভালই ব্যায়াম হল ! ১০ টাকা টিকেট কেটে মন্দিরে ঢুকতে হল ! কোন ধর্মীয় উপাসনালয়ে ঢুকতে প্রবেশ ফি দিতে হয় এই প্রথম দেখলাম !! ভারত এবং থাইল্যান্ডে প্রচুর মন্দিরে যাওয়া হয়েছে, সেখানেও দেখিনি। আমাদের বৌদ্ধ মন্দির পরিচালনাকারীদের ঘটে বুদ্ধি আছে বলতে হবে।
স্বর্ণ মন্দির উপরে উঠে বেশ ভাল লাগল। আসলে একটা উচু যায়গা যার চারিদিকেই নীচু, এরকম কোন জায়গায় যেকোন স্থাপনাতে উঠলেই ভাল লাগে। কারণ, দৃষ্টি চলে যায় অনেক দূর, অবারিত...
সন্ধ্যার কিছু আগেই মন্দির থেকে নেমে এলাম। চাইলাম নীলাচল নামক সূর্যাস্ত দেখার পয়েন্টে যেতে, কিন্তু আমার বেরসিক ভায়রার কারণে সেখানে আর যাওয়া হল না। আকাশটাও ছিল একটু মেঘলা।
চলে এলাম সেনানিবাসের রেস্ট হাউজে।
পরদিন সকালে উঠেই নীলগিরি যাত্রা। বলে রাখি এখানে আমরা একটু বিভ্রান্ত হয়েছিলাম। ঢাকা থেকে রেন্ট এ কার এর ওরা বলেছিল ওদের অটো গিয়ার মাইক্রো নীলগিরির পাহাড়ে উঠতে পারবে না। মেনুয়াল গিয়ার গাড়ী লাগবে।
কিন্তু পথে আমি অনেক বড় মাইক্রো যেতে দেখেছি। জানি না সেগুলো অটো না ম্যানুয়াল। আর নীলগিরি গিয়ে এক্স করোলা এবং এফ প্রেমিয়ো গাড়ী দেখেছি, যেগুলো অবশ্যই অটো গিয়ার গাড়ী। এই বিভ্রান্তির কারণে আমরা ৩৫০০ টাকা গচ্চা দিয়ে একটা গাড়ী ভাড়া করে নীলগিরি রওনা দিলাম। আর আমাদের ঢাকা থেকে আনা ড্রাইভার আর্মির রেস্ট হাউজে বৃষ্টির মধ্যে আরাম করে ঘুমাচ্ছে !
সকাল থেকেই খুব বৃষ্টি হচ্ছিল।
চারিদিক মেঘে ঢাকা, আশে পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পুরোই মিস। তবে যতটুকু চোখে পড়ে খুবই সুন্দর। কারণ, বর্ষায় পাহাড় থাকে একেবারে সবুজ, দৃষ্টিনন্দন ! এই বৃষ্টির মধ্যেই শৈলপ্রপাতে নামলাম, শুধু আমি আর আমার শালা। বাকীরা গাড়ীর আশে পাশেই রইল।
শৈলপ্রপাতে আমার শ্যালক
মহিলা মহল উপজাতিদের দোকানে কেনাকাটার পায়তারা শুরু করল।
কি নাকি থামি কিনবে ! বউকে বললাম, জীবনেও পড়বা না, খালি খালি পয়সা নষ্ট করবা। শেষ পর্যন্ত শ্বশুড় সাহেবের ঝাড়ি খেয়ে সবগুলো গাড়ীতে উঠল।
পথে চিম্বুক পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু যেহেতু তুমুল বৃষ্টি এবং চারিদিক মেঘে ঢাকা, তাই আর উঠলাম না। চিম্বুকে রাস্তার উপরেই সেনাবাহিনীর ক্যান্টিনে গরম ন্যাসক্যাফে কফি বেশ ভালই লাগল।
দুপুরের মধ্যেই নীলগিরি পৌছে গেলাম। তুমুল বৃষ্টি অব্যাহত। এর মধ্যেই গিয়ে “মেঘদূত” নামক কটেজে উঠলাম। সম্ভবত “মেঘদূত”ই ওখানকার সবচেয়ে বেস্ট কটেজ (অবস্থান এর কথা চিন্তা করলে) !
আমি, আমার ভায়রা আর শালা, তিনজনে মিলে খালি গায়ে এবং খালি পায়ে বৃষ্টিতে ভিজতে নেমে পড়লাম। সমস্যা হল বৃষ্টির ফোটাগুলো ছিল খুব সরু, তাই মনে হচ্ছিল যেন শরীরে সুই ফুটছে।
খালি পায়ে ঘাসের উপরে হাটছি। এর মধ্যেই হঠাৎ আমার শালার চিৎকার ! মনে হল ও শেষ, আর মনে হয় বাচবে না ! ঘটনা হল ওর পায়ে একটা ছোট্ট জোক ধরেছে। আমাকে কখনো জোকে ধরেনি, তাই আমি আসলে বুঝতেও পারছি না, জোক ধরার অনুভূতি কি। কিন্তু আমার ভায়রা যেহেতু আর্মি, তাই তার কাছে এটা কোন ঘটনাই না ! বলে, “"এটা হলো HK সিরিজের জোক, মানে হল হারামখোর সিরিজের সংক্ষিপ্ত রুপ ! এইগুলা আপনে হাইটা গেলেই চিপা দিয়া গায়ে চলে আসে”। " জোকটা ছিল একটা বাচ্চা জোক, ছোট বেলা যে আমরা হাইড্রা দেখেছি, অনেকটা সেরকম দেখতে।
আমি প্রথমে ভাবলাম টান দিলেই উঠে যাবে। কিন্তু কিছুক্ষণ টানাটানি করার পরও দেখি কোনমতেই ছাড়ানো যাচ্ছে না। ভায়রা বললেন, এভাবে টান দিয়ে ওঠানো যাবে না, সেক্ষেত্রে ছুটে যাওয়ার পর রক্ত ঝরতে থাকবে। সবচেয়ে ভাল হল জোকের উপর “গুল” ছিটিয়ে দেয়া, আর্মিরা যখন টহলে যায় তারা সাথে গুল রাখে। এখন সমাধান হল, সিগারেটের লাইটার! জোকের গায়ের কাছে আগুন ধরতেই সে ছেড়ে দিল।
শালার প্রাণ ফিরে এল !!
দুপুরের খাবার শেষ করার পরই আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। বৃষ্টি বন্ধ হল। আর মেঘও সরে যেতে লাগল। মনটা আনন্দে ভরে উঠল কারণ দূরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দৃশ্যমান হতে লাগল। আকাবাকা সাঙ্গু নদী চোখে পড়ল।
সবচেয়ে ভাল লাগছিল মেঘের খেলাধুলা। ওদের চলাচল একেক সময় একেক রকম অসাধারণ সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা করছিল যা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব।
বাচ্চাদের নিয়ে হেলিপ্যাডের উপর অনেক্ষণ সময় কাটালাম। বাচ্চাদের জন্য একটা পার্কও আছে, সেখানেও ওদের নিয়ে দোলনা চড়লাম। বেশ ভাল সময় কাটল।
রিসোর্ট সাইটটাও একটু ঘুরে ফিরে দেখলাম।
পাহাড়ের খাজে খাজে কটেজ
হানিমুন কটেজও আছে।
ক্যান্টিনে গিয়ে নীলগিরির ব্র্যান্ডিং সম্বলিত টি শার্ট কিনলাম সবাই। সূর্যাস্তের আগে মেঘ আর সূর্যের অপরূপ খেলা উপভোগ করলাম। আপনাদের সাথে কিছু ছবি শেয়ার করলাম।
ঐতো নীলগিরি আসার পথ...
অপরুপ নীলগিরি...
বসনিয়ান রুটি আর গ্রিল চিকেন দিয়ে রাতের ভুরিভোজ ভালই হল। আমার শালা আবার তার গিটার নিয়ে গিয়েছিল। একটা ছোট্ট রেলিং ঘেরা ওয়াচ প্লেস আছে ওখানে। গিটার নিয়ে সেখানে বসে ও সুর তুলতে লাগল। আমি আর আমার ভায়রা হাটছি, ইট-সিমেন্ট এর খোলা চত্বরে, গল্প শুনছি ওনারা যখন গহীন জংগলে পেট্রোলে যায়, কিভাবে জোক মোকাবেলা করে।
একবার নাকি এক সৈনিকের জায়গামত HK সিরিজের জোক ধরেছিল। সে টান দিয়ে তুলে ফেলাতে রক্তপাত শুরু হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হেলিকপ্টারে করে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। বোঝেন অবস্থা ! রোমাঞ্চকর কাহিনী শোনার মাঝেই আবার আমার শালার চিৎকার ! তাকে আবারো HK সিরিজের জোক আক্রমণ করেছে। তবে এবার জোক তখনো তার সাকশন সেট আপ করতে পারেনি, তার আগেই জোকের গায়ে জুতার বাড়ি দিয়ে শালাকে জোকমুক্ত করা হল !!
নীলগিরিতে আরেকটা সুন্দর মুহুর্ত হল সূর্যোদয়।
ভোর সাড়ে চারটায় উঠে গেলাম, ভাবলাম যদি কপাল ভাল থাকে তাহলে সূর্যোদয় দেখতে পাব। কিন্তু বিধি বাম। ফজরের নামাজ পড়ে বাইরে গিয়ে দেখি আমরা মেঘের চাদরে মোড়া। এর মধ্যেই এক সেনা সদস্য পাহারারত। মেঘের মধ্যেই একটু হাটাহাটি করে কম্বলমুড়ি দিয়ে দিলাম আবার ঘুম।
সকালে নাস্তা করেই আবার ফেরার পথ ধরলাম। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। ভায়রা বললেন, নীলগিরির সৌন্দর্য পুরোপুরি দেখতে হলে শীতকালে আরেকবার আসতে হবে। মনে মনে নিয়্যত বেধে নিলাম। পথে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাস্তায় ছবি তুললাম।
বান্দরবানে যখন পৌছালাম, তখন কড়া রোদ। সেনানিবাসে দুপুরের খাবার খেয়েই আমরা ঢাকার পথ ধরব। লাঞ্চের আগে এক ঘন্টা সময় পাওয়া গেল। ভায়রার আইডিয়াতেই সুইমিং পুলে নেমে পড়লাম। বিশাল সুইমিং পুল, আমার বড় ছেলেকে ওর মা যখন আমার সাথে পানিতে নামতে বলল, সে তো ভয়ে কেদে কেটে অস্থির ! তারপরেও জোর করেই পানিতে নামিয়ে দেয়া হল, বেচারা জীবনের মায়ায় আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকল, কিন্তু দেখলে মনে হবে সে কতটাইনা ভালবেসে আমাকে জড়িয়ে আছে !!
অসাধারণ একটা ভ্রমণ এভাবেই সমাপ্ত হল, রয়ে গেল খুব সুন্দর স্মৃতি।
আমার কাছে এটাই আমার দেখা বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ট্যুরিস্ট সাইট !! স্বপ্নের নীলগিরি !!!
বি.দ্র.: যারা নীলগিরিতে যেতে চান এবং রাত্রি যাপন করতে চান তারা এই নম্বরে ০১৭৬৯২৯২৩৩৮ যোগাযোগ করে কটেজ বুকিং দিতে পারবেন। এটা বান্দরবান সেনানিবাসের ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তির একটি নম্বর। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।