ভালো আছি
সিগমন্ড ফ্রয়েডকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, বলুন তো, স্বপ্ন কী? উত্তরে ফ্রয়েড বলেছিলেন, ‘প্রাণীরা কী স্বপ্ন দেখে আমার তা জানা নেই। তবে এ প্রসঙ্গে আমার ছাত্রের কাছ থেকে শোনা একটি প্রবাদের কথা বলতে পারি। সেটাও এই প্রশ্নটিকেই নিয়ে। প্রশ্নটি হলো, হাঁস কি স্বপ্ন দেখে? তার উত্তর, দেখে, ভুট্টা দানার স্বপ্ন। অতএব ব্যাপারটি দাড়াচ্ছে এই যে আমরা যা আকাক্সক্ষা করি, স্বপ্নে তার পরিস্ফুট চিত্রটি দেখতে পাই।
স্বপ্ন নিয়ে বিখ্যাত চিত্র শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মনেও প্রশ্ন ছিল, যে সব ঘটনা স্বপ্নে অত পরিষ্কারভাবে আমরা দেখতে পাই, জাগ্রত অবস্থায় কেন পাই না?
‘স্বপ্ন প্রতি রাতে আমাদের বিচিত্র এক পাগলের রাজ্যে পৌছে দেয়’, বলেছেন মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম ডিমেন্ট। হেনরী ডেভিট থেরোর মতে, মানুষ স্বপ্নে তার নিজস্ব চরিত্রটির সঠিক চেহারা দেখতে পায়। এবং গবেষকদের বক্তব্য, আমাদের বহু সমস্যার মীমাংসার পেছনে স্বপ্ন দায়ী। স্মৃতিশক্তিকে সুসংহত করে,
শোকদুঃখ থেকে মুক্তি দেয়, কখনও শরীরের ক্ষত নিরাময়েও ইন্ধন যোগায়। বলা বাহুল্য, পর্যবেক্ষণলব্ধ অভিজ্ঞতা থেকেই এ সব ধারণার উৎপত্তি।
মূল রহস্যের উৎসমূল এখনও রহস্যাবৃত, ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি রহস্যের মত। নক্ষত্র-গ্যালাক্সি, কোয়াসার, পালসার অথবা ব্ল্যাক হোল তাদের সৃষ্টি নিয়ে যেমন অজস্র তত্ত্ব, সেসব তত্ত্ব কতটা বাস্তব সে সম্পর্কে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যেমন নিশ্চিত নন, আমাদের মস্তিষ্ক জগৎ-এর অবস্থাও দাড়িয়েছে সেই রকম। সেখানে স্বপ্নের সৃষ্টি নাক্ষত্রিক জগতের মতই রহস্যময়, কখনও আলোকের উন্মীলন, কখনও বিক্ষুব্ধ ঝঞ্ছা এবং সব থেকে মজার ব্যাপার, কেন এমন ঘটে তার যথাযথ ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব হয়নি। যদিও স্বপ্ন জীবনের একটি অঙ্গ এবং প্রয়োজনীয়, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিমত নেই।
বিজ্ঞানে স্বপ্ন:
এক পদার্থ বিজ্ঞানীর গল্প: রোদ ঝলমলে দিন ।
মাথার উপর প্রখর সূর্য। তার চারপাশে উত্তপ্ত গ্যাসের কুণ্ডলী। গ্রহগুলো গ্যাসের দড়ি দিয়ে সূর্যের সাথে জোড়া লাগানো। ওই অবস্থায় সূর্যকে কেন্দ্রকরে তারা সূর্যের চারপাশে প্রচণ্ড বেগে ঘুরছে। হঠাৎ সেই গ্যাস শীতল হলো।
সূর্য গ্যাসীয় থেকে পেল কঠিন অবস্থা। গ্রহগুলো দড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হলো। ঠিক এই মুহুর্তে ঘুম ভেঙে গেল পদার্থবিজ্ঞানীর। বুঝতে পারলেন এতক্ষণ যা দেখছিলেন, সেটা স্বপ্নে। স্বপ্নে তিনি যেন পরমাণুর স্বরুপটি দেখছিলেন।
ঘটনাটি ঘটে ১৯১৩ সালে, এবং যে পদার্থ বিজ্ঞানীর কথা আলোচনা করা হলো, তিনি নিলস বর। বর তখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র। তিনি স্বপ্নে যা দেখতে পান, তার সার কথা, সূর্য যেন একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র। গ্রহগুলো ইলেকট্রন, যারা একটি শক্তি ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থান করছে। পরে স্বপ্ন থেকে পাওয়া এই ধারণাটিই ‘কোয়ান্টাম মেকানিকস’-এর সাহয্যে পারমাণবিক গঠন সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যা যোগাতে সাহায্য করেছিল।
শুধু নিলস বর-ই নন, এ ধরনের অভিজ্ঞতা আরও অনেক বিজ্ঞানীর জীবনেই ঘটেছিল। যেমন ধরুন জার্মান রসায়নবিদ ফ্রায়েডরিখ কেকুলে। সেই সময় ‘বেনজিন’ নামক রাসায়নিক যৌগটির আণবিক গঠনটি কেমন হবে, তা নিয়ে নানা রকম বিতর্ক চলছিল বিজ্ঞানীদের মধ্যে। কেকুলেও এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সমস্যাটির সমাধান হয়ে গেল।
তখন শীতকাল। বাইরে প্রচণ্ড হিম পড়ছে। রাতের দিকে নিজের ঘরে চুল্লির সামনে বসে শরীররটা গরম করে নিচ্ছিলেন কেকুলে। উষ্ণতার আরামে কিছুটা ঝিমিয়েই পড়েছিলেন যেন। তন্দ্রা এবং জাগরণের মাঝামাঝি অবস্থা।
ঠিক সেই মুহুর্তে দেখা দিল স্বপ্ন। তিনি দেখলেন, পরমাণুগুলো কেমন যেন পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। সাপের মত। দেখলেন, একটি ‘সাপ’ তার লেজটির ডগা মুখে পুরল। এমন সময় তার তন্দ্রা ছিন্ন হলো।
এবং সাথে সাথে মনে হলো, তিনি সমস্যার সমাধান পেয়ে গেছেন। বুঝলেন, ‘বেনজিন’ বা ওই ধরনের কোন রাসায়নিক যৌগের গঠন ‘আংটি’-র মত, কারন পরমাণুগুলো পরস্পর যুক্ত হয়ে উন্মুক্ত শৃঙ্খল রচনা করে না। পরবর্তীতে যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করে আংটি। যেমন স্বপ্নে লেজের ডগা মুখে পুরে সাপের চেহারা দাড়িয়েছিল। অর্থাৎ স্বপ্ন ‘বেনজিন’ অণুর গঠন জানতে সাহায্য করেছিল কেকুলেকে।
পরবর্তীকালে বন্ধুদের কাছে ওই ঘটনাটির কথা উল্লেখ করে তিনি মন্তব্য করেন, ‘শুনুন ভাইরা, কীভাবে স্বপ্ন দেখতে হয় সেটা শিখে নিন। তা হলে অনেক “সত্য”ই হয়তো আপনারা আবিষ্কার করতে পারবেন। ’
এখানে মজার ব্যাপার এই যে, রাতের স্বপ্ন কখনও কখনও ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’-ও হতে পারে, তেমন উদাহরণও পাওয়া যায়। যেমন ধরুন এলিয়াস হাউ-এর কথা। আবিষ্কারক হিসাবে ভদ্রলোকের খুব নাম ডাক আছে।
এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন তিনি গভীর জঙ্গলে গিয়েছেন। হঠাৎ একদল বুনো মানুষ এসে তাকে বন্দী করে। তারা বলল, একটি শর্তে তোমাকে ছাড়তে পারি, যদি তুমি ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমাদের একটি যন্ত্র বানিয়ে দাও। যেটা সেলাই-এর কাজে আমাদের সাহায্য করবে। দেখতে দেখতে ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেল।
কোন কিছুই করতে পারলেন না হাউ। এল মৃত্যুমুহূর্ত। হাউ দেখলেন, তার মাথার উপর নেমে আসছে বর্শার ফলা। হঠাৎ তার নজরে পড়ল সেই ফলার ডগার কাছে একটি ছিদ্র রয়েছে। ছিদ্রটি দেখতে অনেকটা মানুষের চোখের মত।
অমনি ঘুম ভেঙে গেল হাউ-এর। এতদিন সেই কলের ছুঁচ নিয়ে চিন্তা ছিল তার। কখনও ভেবেছেন, ছুঁচের ছিদ্র মাঝ বরাবর হওয়া দরকার, কখনও ভেবেছেন শেষ প্রান্তে। এবার স্বপ্নে দেখা অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কলের ছুঁচের ডগায় সুতো পরানোর ছিদ্র রাখবার ব্যবস্থা করলেন তিনি। এর ফলে চমৎকার কাজ হলো।
আর এভাবেই স্বপ্নের মাধ্যমে এলিয়াস হাউ আবিষ্কার করলেন কলের ছুঁচ।
সৃজনশীলতার সাথে স্বপ্নের কি কোন সম্পর্ক আছে?
বিশিষ্ট শিল্পী জেফ্রে শ্রিয়ের প্রশ্নটির উত্তর দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার স্বপ্নে দেখা দৃশ্যাবলী এবং ঘটনা, সেই সাথে অলীক কল্পনা আমাকে বহু ছবি আঁকতে সাহায্য করেছে। কখনও এমনও হয়, স্বপ্নে দেখা কোন বিষয় নিয়ে আমি আঁকতে বসেছি, সেই সময় কখনও চলে গেছি অতীতের স্বপ্নজগতে। ’ তার বিখ্যাত ছবি ‘দ্য ড্রিমিং সেলফ’ বা স্বপ্নের আত্মদর্শন’ এভাবেই সৃষ্টি।
স্বপ্ন নিয়ে প্রাচীন চর্চা:
শুধু বর্তমানেই নয়, মানুষ স্বপ্ন নিয়ে অতীত কালের থেকেই চিন্তা করে আসছে।
তাদের সেই চিন্তাভাবনার প্রতিপাদ্য বিষয়, স্বপ্ন দেখবার পিছনে কাজ করে শয়তানের প্রভাব অথবা ঐশ্বরিক শক্তি। কারও মতে, কোন কোন স্বপ্ন কঠিন রোগের ইঙ্গিত বহন করে। কোন কোন স্বপ্ন আবার রোগ উপশমের পূর্বাভাস যোগায়।
আজ থেকে ৪০০০ বছর আগে মিশরের ফারাও মারিকের বিভিন্ন ধরনের স্বপ্নের ব্যাখ্যা সংকলিত একটি বই রচনা করেন। স্বপ্ন নিয়ে এটিই সম্ভবত প্রথম গ্রন্থ।
ম্যারিকের তার এ বইটিতে লিখেছেন,‘যদি কেউ সুখের স্বপ্ন দেখে, তবে বুঝতে হবে তার পতন অবশ্যম্ভাবী এবং সন্নিকট। ’ পশ্চিমী চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রেটস মনে করতেন, কোন কোন রোগী স্বপ্নে গ্রহ-নক্ষত্রের বিচরণ দেখতে পায়। সেই সব গ্রহ-নক্ষত্রের বিচরণ কোন দিক বরাবর ঘটছে তা পরীক্ষা করে জানা যায় রোগের পূর্বাভাস। স্বপ্নে যদি গ্রহ বা নক্ষত্র পুব দিক বরাবর এগিয়ে যায়, তখন বুঝতে হবে রোগীর টিউমার অচিরেই দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এ ধরনের আজব ধারণা সে সময় অনেক চিকিৎসকরাই করতেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।