আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতির পাতা থেকে-নটরডেম কলেজ (অম্লমধুর নানা অভিজ্ঞতা).........পর্ব ৪ (শিক্ষকদের সাথে টুকরো স্মৃতি)

আমি শুনতে পাই লক্ষ কোটি ফিলিস্তিনীর আর্তনাদ...হাহাকার স্মৃতির পাতা থেকে- নটরডেম কলেজ (১ম পর্ব) স্মৃতির পাতা থেকে- নটরডেম কলেজ (২য় পর্ব) স্মৃতির পাতা থেকে- নটরডেম কলেজ (৩য় পর্ব) নটরডেম কলেজে অনেক শিক্ষকের সান্যিধ্যে এসেছিলাম। এমনকি কেউ কেউ মাত্র একদিনের জন্য এসেছিলেন। এই পর্বে আমি বিভিন্ন স্যার ও ম্যাডামদের নিয়ে আলোচনা করব। শীতল স্যার (শীতল চন্দ্র দে)- “ব্যবসায় শিক্ষা” বিভাগের সবচেয়ে জটিল সাবজেক্ট ছিল হিসাব বিজ্ঞান। স্কুলে থাকতে প্রাইভেট টিউটরের কাছে বিষয়টি পড়েছিলাম।

নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়ে ভেবেছিলাম কোন কোচিং করতে হবে না। তখন হিসাব বিজ্ঞানীর সবচেয়ে নামকরা স্যার ছিলেন ঢাকা কলেজের হুদা স্যার, নটরডেমের শীতল স্যার ও আহসান ঊল্লাহ হাবিব স্যার। আমার অন্যান্য ক্লাস মেট এদের কাছে পড়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিল। কিন্তু “নটরডেম কলেজে পড়লে কোচিং করার দরকার নাই” এই নীতিতে অটল ছিলাম। আমাদের হিসাব বিজ্ঞান ক্লাস নিতেন ফাদার বিমল (তাকে নিয়ে একটি আলাদা পোস্ট লিখব পরে)।

দুদিন পরেই আমার মোহ ভাংলো, এনার ক্লাসে হিসাব বিজ্ঞান ভুলে যাবার আশঙ্কা দেখা দিল। আমি শীতল স্যারের কাছে কোচিং করার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। একদিন ক্লাস শেষে তার সাথে দেখা করলাম। তিনি বাসায় আসতে বললেন। তাঁর বাসা ছিলো আরামবাগে, নটরডেম কলেজের পাশের গলি দিয়ে যেতে হয়।

ওখানে গিয়ে আমার অন্যান্য ক্লাসমেটদের সাথে দেখা হলো। শেখান থেকেই শীতল স্যারের কাছে কোচিং করা শুরু। একদম হিসাব বিজ্ঞান পরীক্ষার আগে পর্যন্ত তাঁর কাছে পড়েছি। শীতল স্যার কোচিং করা প্রসঙ্গে একটা বাস্তব কথা বলে ছিলেন। একটা ক্লাসে যতই ভাল পড়ানো হোক না কেন, ১০০-১২০ জন ছাত্রের জন্য সবকিছু খুঁটিনাটি বোঝা সম্ভব নয়।

স্যার কিন্তু কখনও আমাদেরকে কোচিং করার জন্য চাপ দেননি। বরং আমরাই নিজ গরজে তাঁর কাছে পড়েছিলাম। স্যারের একটা মজার ব্যাপার ছিল। অনেকে বলাবলি করত স্যারের কোচিংএর পড়া ও ক্লাসের পড়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ২য় বর্ষে যখন স্যার ক্লাস করাতে এলেন তখন এই কথার সত্যতা পেয়েছিলাম।

স্যার অনেক মজার মানুষ ছিলেন। একবার একছাত্র তাকে জিজ্ঞেস করলো যে নগদান বইয়ের বাট্টার ঘরে “ক্লোজিং” দাগ দেয়া যাবে না। স্যার বলেছিলেন “আমরা খালি আজাইরা জিনিষ নিয়া চিল্লাচিল্লি করি। আমি বোর্ডেও এই নিয়া অনেক আলাপ আলোচনা করতে দেখেছি। আমার কথা হচ্ছে ওই “নগদান বই” এর প্রব্লেমটা ঠিক মত করা হইসে কিনা সেটার উপর জোড় দেয়া উচিৎ ।

আর দাগ দিতে চাও দরকার হলে পরীক্ষার সময় বাঁশ নিয়ে যাও দাগ দেবার জন্যে। গতকাল নটরডেম কলেজের ওয়েব সাইটে দেখলাম ব্যাবসায় শিক্ষা বিভাগে শীতল স্যার ছাড়া আমদের সময়ের টিচারদের কেউ নেই। যেন যুদ্ধক্ষেত্রের ধ্বংসস্তুপের মাঝখানে শেষ আশার মত একজন সেনাপতি”। ব্যপারটা এমন যে, তিনি যদি কোন কারনে কলেজ ছেড়ে চলে যান, নটরডেম কলেজের “ব্যবসায় শিক্ষা” বিভাগ মুখ থুবরে পড়বে। ফরহাদ মঞ্জুর স্যারঃ সে সময় আরেকটা জটিল বিষয় ছিল, “কম্পিউটার শিক্ষা”।

আমাদের প্রথম বর্ষে তিনি কম্পিউটার ক্লাস নিতেন। প্রথম সেই ক্লাসের কথা এখনও মনে আছে। একজন হ্যাংলা পাতলা লোক ক্লাসে এসে ডায়াসে উঠলেন, চশমাটা ঠিক করে নিলেন। এরপর আবিষ্কার করলাম তাঁর বিরাট গোঁফ। যেন সেটি তাঁর হ্যাংলা পাতলা চেহারাকে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করছে।

আমার এক বন্ধু তাঁর সম্পর্কে বলেছিল “স্যার ক্লাসে ধোকার আগে তাঁর মোছ (গোঁফ) আগে ঢোকে । “ কম্পিউটার শিক্ষার মত একটি জটিল বিষয় খুব সহজে সহজ ভাষায়, বাস্তব উদাহরন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বইয়ের বাইরেও আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে অনেক কথা বলতেন। তার কাছে প্রথম “স্মার্ট টয়লেট” এর কথা শুনে টাশকি খেয়ে গিয়েছিলাম। তিনিও কখনও ক্লাস নেয়া বাদ দেননি।

ভিকারুন্নেসার সাম্প্রতিক ঘটনার জন্য অনেকে কোচিং করাকে দোষারোপ করছেন। তাঁদের প্রতি আমার অনুরোধ, দয়া করে “বেজন্মা পশু” পরিমলের সাথে সবাইকে এক কাতারে ফেলবেন না। কারন অনেক সন্মানিত শিক্ষক শিক্ষিকাই কোচিং করান, দয়া করে তাদেরকে অপমান করবেন না। আমার ভাবি ও তার বোনও ফরহাদ স্যারের কাছে কোচিং করত। আমি নিজেও ভিকারুন্নেসার “ফেরদৌসি ম্যাডামের” কাছে বাংলা বিষয়ে কোচিং করেছিলাম।

আনিস স্যারঃ আনিস স্যার আমাদের আরেক কম্পিউটার শিক্ষার শিক্ষক। তিনিও খুব ভাল পড়াতেন। তাঁর কাছেই আমি কোচিং করেছি। তবে তিনি একটু প্রফেশনাল ছিলেন। তিনি ব্যাচ করে অনেক ছাত্র ছাত্রী পড়াতেন।

আমাদের সময় তাঁর ফিস ছিল মাসে ৭০০ টাকা। এখন কত জানিনা। তবে তিনি কখনও ক্লাস ফাঁকি দেননি। সাবিহা ম্যাডামঃ ২য় বর্ষে আশা করেছিলাম আনিস স্যার ক্লাস নিবেন। কিন্তু প্রথম ক্লাসে তিনি এলেন ঠিকই, তবে সাথে এক ম্যাডামকে নিয়ে।

মনে হয় সদ্য পাশ করে বেরিয়েছেন। আমরা বেশ মনক্ষুন্ন হলাম কেননা আনিস স্যারের পড়ানোর স্টাইল খুবই আকর্ষনিয়। প্রথম ক্লাসে তিনি ১ম অধ্যায়ের একটি টপিকের উপর কিছু লেখার বোর্ডে দিকে ঘুরলেন। ঘুরার সময় তিনি স্টাইল করে তাঁর চুল ঘুরিয়ে নিলেন, আমরা তাই দেখে সবাই মৃদু স্বরে “ওওওওহ” করে শব্দ করে উঠলাম। তবে “টিনা ম্যাডামের” সাথে যা দুষ্টামি করা হয়েছিল (টিনা ম্যাডামের কথা আলাদা পোস্টে দেব) সাবিহা ম্যাডামের সাথে অতটা করা হয়নি।

একবার ক্লাসে মাইক্রোফোনে সমস্যা দেখা দেয়ায় তার লেকচার শুনতে সমস্যা হচ্ছিল। অমনি কিছু ভদ্রছেলেরা চ্যাঁচামেচি শুরু করল “ম্যাডাম....শোনা যায় না”- আসলে শোনা যায় না বলতে তারা কি বোঝাতে চেয়েছিল তা বুদ্ধিমান পাঠক মাত্রই বুঝবেন। এমনকি আমিও ম্যাডামকে সাহস করে বলে ফেলেছিলাম “ম্যাডাম....শোনা যাচ্ছে না”। আমার এক ফাজিল টাইপ বন্ধু ম্যাডামকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিল, কবিতার ভাষা দেখে পুরাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কবিতাটি ছিল “হে বাতাস, তুমি উড়িয়ে দাওনা ম্যাডামের ওড়না।

তাহলে দেখা যাবে হিমালয় থেকে নেমে আসা দুটি সুন্দর ঝরনা” বলা বাহুল্য, এই কবিতা আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কেননা, ম্যাডাম বা স্যার জানলে খবরই ছিল। নির্মল স্যার (নির্মল চন্দ্র দে)- আমাদের সময় নির্মল স্যার ছিলেন একমাত্র ভূগোলের শিক্ষক। তিনি আমাদের “বাণিজ্যিক ভূগোল” নিতেন। তিনি ক্লাসে নানা বিষয় যেমন রাজনীতি, বিশ্ব রাজনীতি, সাম্প্রতিক ঘটনা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করতেন।

একটা কারনে তিনি ভিকারুন্নেসার বাংলা শিক্ষক “ফেরদৌসি” ম্যাডামের উপর খুব ক্ষুব্দ ছিলেন। একবার বললেন “আমি সকালবেলা বাজার কইরা রিকশা দিয়া আইসা আমার বাসার গেইটের সামনে নামতে পারিনা। মহিলার গাড়ি আমার বাসার গেইটের সামনে পার্ক কইরা রাখে। “ এই নিয়ে প্রায়ই স্যার গজ গজ করতেন। আমি যখন ফেরদৌসি ম্যাডামের কাছে কোচিং করি তখন স্যারের বাসার সামনে একটি গাড়ি দেখতে পাই।

পরে আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করি “স্যার, আপনি নতুন গাড়ি কিনলেন নাকি? স্যার উত্তরে বললেন “গাড়ি কিনার টাকা থাকলে নটরডেম কলেজে আর থাকতাম না, ওইটা ওই বেডির গাড়ি, আমার বাসার সামনে রাইখ্যা দেয়, আমি রিক্সা দিয়া নামতে পারিনা.......”। ওয়েব সাইটে দেখলাম স্যারের নাম নেই। জানিনা স্যার এখন কোথায়। হয়ত দেশের বাইরে। কারন, তিনি প্রায়ই বলতেন “দেশে থাকতাম না বাইরে যামুগা” মানিক গোমেজ স্যারঃ এই স্যার বেশ মোলায়েম স্বরে লেকচার দিতেন।

প্রথম ক্লাসে “মা ও মাতৃভাষা” নিয়ে লেকচার দিলেন। প্রথম ক্লাসে তার লেকচার বেশ ভাল লেগেছিল। আমরা জানলাম যে স্বাধীন দেশ স্বাধীন হবার পর তিনিই প্রথম বাইবেল পাঠ করেছিলেন। দু’দিন যেতে না যেতেই তাঁর ক্লাস ভাল লেগে গেল, কারণ তাঁর ক্লাসে আমরা যারা পেছনে বসতাম তাদের, প্রধান কাজ ছিল গল্প করা। তবে স্যার মাঝে মাঝে যারা কথা বলত তাদের ধরতেন।

তিনি কথা বলা দুইজনের একজনকে একদম পেছনে পাঠিয়ে দিতেন, আর আরেক জনের সাথে কথা বলে জেনে নিতেন কি বিষয়ে কথা বলেছিল। এরপর তাকে নিজের সিটে পাঠিয়ে সাথের জনকে ডাকতেন, তার কাছেও শুনতেন কি নিয়ে কথা বলেছিল। দুইজনের কথার সাথে মিল না হলেই তিনি রেগে যেতেন। একবার একছেলে বলল যে সে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলছিল, কিন্তু তার বন্ধু জানায় যে সে তার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে কথা বলছিল। এভাবে অনেক ছেলে কথা বলতে গিয়ে ধরা পড়েছিল।

মারলিন ম্যাডামঃ ম্যাডাম কয়েকদিন মাত্র ক্লাস নিয়েছিলেন। তার ক্লাসে তেমন কোন বিশেষ ঘটনা নেই। একদিন তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “অনেকে টুপি দাড়ি ওয়ালা দেখলেই গোঁড়া মনে করে, কিন্তু তাদের সাথে কথা বলে দেখেছি, তাঁরা অনেক উদার। বরং কেউ কেউ আছে যাদের দেখলে বেশ স্মার্ট মনে হয়, ক্লিন শেভ করে, তারা ভিতরে অনেক ভয়ঙ্কর হয়। “ ম্যাডাম চিটাগাং ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ছিলেন, শিবির প্রসঙ্গে ওই কথাগুলো বলেছিলেন।

ব্রায়ান স্যার- আমাদের ব্যাবস্থাপনা বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন। তার ক্লাসের কোন বিশেষ স্মৃতি নেই। তবে একটা ব্যাপার বেশ মজার ছিল। উনার একটা মুদ্রাদোষ ছিল। উনি প্রতিটা বাক্য বলার সময় বারবার রিপিট করতেন “ঠিক আছে”, “ঠিক আছে” বলতেন।

শেষ করছি আমাদের সময়ের আরেক কম্পিউটার স্যারের কথা বলে। সঙ্গত কারনে তার নাম বলছিনা। তিনি আজও কলেজে আছেন। উনিও ছিলেন সদ্য পাশ করা সিক্ষক। আমি আনিস স্যারের কাছে কোচিং করলেও আমার কিছু বন্ধু তার কাছে কোচিং করতে যেত।

উনি আমাদের ক্লাসও নিতেন। তিনি আমাদের ক্যুইজ পরীক্ষায় অনেক উলটা পালটা প্রশ্ন করতেন। একবার তাঁর কাছে কোচিং করা আমার এক বন্ধু আমাকে জানালো যে ক্যুইজ নিয়ে কোন সমস্যা হবে না, সে আমাকে স্যারের সাজেশন দিয়ে দেবে। পরদিন সে আমার বাসায় আসলো। তার কাছ থেকে ৭-৮ টা প্রশ্ন লিখে নিলাম।

আর আমাকে সে বলল “খবরদার, এই সাজেশন যেন কেউ না জানে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। “ পরদিন ক্যুইজ দিতে গিয়ে দেখলাম সব হুবহু সেই ৭-৮ টা প্রশ্নই এসেছে। সোজা কথায় “প্রশ্নফাঁস”। স্যর কেন এরকম করেছিলেন জানিনা, তবে মনে হয় সেটা ছিল কম বয়সের বুদ্ধিভ্রষ্ট কাজ। শিক্ষকদের সাথে স্মৃতি এখানেই আপাতত শেষ করছি।

তাদের আরও কথা থাকবে আমার অন্যান্য পর্বে। শুধু টিনা ম্যাডাম আর মুখতার স্যারের কথা আলাদা করে পোস্ট করব। আজ এখানেই শেষ করছি। । ....(চলবে) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।