ফয়সল ইসলাম,সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক গ্রামের কাগজ,যশোর। মোবাইল : +৮৮০১৭১৩৪০৫১৫৭ ফয়সল ইসলাম : ভিটামিন এ ক্যাপসুল খেয়ে শিশু মৃত্যুর গুজব কি শুধুই গুজব নাকি রাজনীতি ? এমন প্রশ্ন তুলেছেন বিদগ্ধজনেরা। কারণ ইতিমধ্যে ফাঁস হয়েছে এ গুজবের নেপথ্যের তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অপপ্রচার মূলতঃ শুরু হয়েছে ফেসবুক স্টাটাস থেকে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘ডয়েচে ভেলে’ প্রকাশ করেছে জামায়াত শিবির পরিচালিত ‘বাঁশের কেল্লা’সহ সমমনা কয়েকটি ফেসবুক পেজে ভিটামিন এ ক্যাপসুল সম্পর্কে ভীতিকর তথ্য প্রচার করা হয়েছে।
জামায়াত-শিবিরের অনুসারীরা প্রচার করেছেন ভারত থেকে আমদানিকৃত ভিটামিন এ ক্যাপসুল খেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে৷ একই সময় ১২ মার্চ রাতে চট্টগ্রামে একটি মসজিদের মাইক থেকে পর্যন্ত এ অসুস্থতার খবর ছড়ানো হয়েছে।
এই প্রচারণা ছড়ানোর পর দেশব্যাপী এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বিপাকে পড়ে সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগ। প্রাথমিক খোঁজ-খবর নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ নিশ্চিত হয়েছে, কুচক্রী মহলের অপপ্রচারে দেশের সফল একটি স্বাস্থ্য কর্মসূচি বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
এদিকে, ভিটামিন এ ক্যাপসুল খেয়ে শিশু মৃত্যু ও অসুস্থতার গুজবের প্রভাব পড়েছে যশোরেও।
গত ২৪ ঘন্টায় এ জেলায় এক হাজার চারশ’ ৩১ শিশুকে চিকিৎসা দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর মধ্যে এক হাজার তিনশ’ ২২ শিশু প্রাথমিক চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছে। বাকি একশ’ ৯ শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তবে কোন শিশুর মৃত্যুর খবর এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত দেশের কোনো স্থান থেকে পাওয়া যায়নি।
মঙ্গলবার ছিল জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন।
এদিন ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কর্মসূচি সফলভাবে পালন করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। যশোর স্বাস্থ্য বিভাগ টার্গেট অনুযায়ী ৯৯.৪ ভাগ সফলতা দেখিয়েছে। সফলতার ঝুলিতে বদনাম রটাতে সংঘবদ্ধ একটি চক্র দেশজুড়ে গুজব ছড়ায় ভিটামিন এ ক্যাপসুল খেয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সেই গুজবের প্রভাবে অনেক অভিভাবক শিশুকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়াতে বিরত থেকেছেন। একই সাথে যারা খাইয়েছেন তারা ছিলেন দুঃশ্চিন্তায়।
এরফলে ঘটেছে নানা ভোগান্তির ঘটনা। মঙ্গলবার সকালে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর পর গুজবে কান দিয়ে অভিবাভকদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এ গুজব বেশি ছড়ায় ‘জামায়াত’ অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত সাতক্ষীরায়। ১২ মার্চ রাতে রটে যায় সেখানে এ ক্যাপসুল খেয়ে ১৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মুহূর্তে এ গুজব ছড়িয়ে পড়ে মনিরামপুর ও কেশবপুরে।
সন্তান যাতে সুস্থ থাকে সেজন্য সেখানে অনেকেই তেতুল পানিতে গুলিয়ে শিশুকে খাইয়েছে। এতেই ঘটেছে বিপত্তি। যেসব শিশুকে তেতুল গোলানো পানি খাওয়ানো হয়েছে তারা বেশি অসুস্থ হয়েছে। বমি ও পাতলা পায়খানায় আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে আসা হয়েছে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে। সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় ঘটেছে যশোরের কেশবপুর উপজেলায়।
সরকারি হিসেব মতে, মঙ্গলবার দুপুর থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫শ’২৪ শিশুকে বর্হিঃবিভাগ থেকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। অথচ ভর্তি হয়েছে মাত্র ২ শিশু। অনুরূপভাবে শার্শা উপজেলায় ৪৬৪ শিশু বর্হিঃবিভাগে ৩৫ শিশু ভর্তি, মণিরামপুরে ১০১ শিশু বর্হিঃবিভাগে, ৩ শিশু ভর্তি ঝিকরগাছায় ৭৯ শিশু বর্হিঃবিভাগ, ৯ শিশু ভর্তি, চৌগাছায় ৩৯ শিশু বর্হিঃবিভাগ, ৬ শিশু ভর্তি, অভয়নগরে ২৫ শিশু বর্হিঃবিভাগ, ১শিশু ভর্তি, বাঘারপাড়া উপজেলায় ১০ শিশু বর্হিঃবিভাগ, ৬ শিশু ভর্তি থেকে এবং সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিভিন্ন সাব সেন্টারে ৪৯ শিশু প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছে। এছাড়াও যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩১ শিশু বর্হিঃবিভাগে ও ৪৭ শিশুকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এখান থেকে দুপুর ২ টার মধ্যে ৪৫ শিশুকে সুস্থ অবস্থায় ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।
হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মাহাবুবুর রহমান জানিয়েছেন, পাতলা পায়খানার জন্যে ওরস্যালাইন ও বমির জন্য জোপরা সিরাপ দিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তাতেই শিশু গুলো দ্রুত সুস্থ হয়েছে। অপপ্রচার ও অজ্ঞতার কারণে অভিভাবকরা তেতুল গুলিয়ে পানি খাইয়ে শিশু গুলো অসুস্থ করে তুলেছেন। তাছাড়া বড় ধরণের কোন ঘটনা ঘটেনি।
যশোরের সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডাক্তার আতিকুর রহমান খান দাবি করেছেন, অপপ্রচার প্রভাবমুক্ত রাখতে যশোরের স্বাস্থ্যসেবীদের সজাগ রাখা হয়েছিল।
যশোর স্বাস্থ্য বিভাগ সফল হয়েছে। অসুস্থ শিশুদের তাৎক্ষণিক সেবা দিয়ে সুস্থ করা হয়েছে। যশোরবাসীর প্রতি তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন কোন গুজবে কান না দিয়ে শিশুদের স্বাস্থ্যের প্রতি যতœবান হওয়ার জন্যে।
এদিকে, গ্রামের কাগজ দপ্তরে অভিযোগ এসেছে ভিটামিন এ ক্যাপসুল নিয়ে গুজব রটানোর পিছনে বিএনপি ও জামায়াত পন্থী স্বাস্থ্যসেবীরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন। যশোর শহরের পুরাতন কসবা কাজীপাড়ার বাসিন্দা ডক্টরস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সক্রিয়কর্মী ঢাকায় বসবাসরত এক চিকিৎসক তার অনুসারী কয়েকজনকে ফোন করে বলেছেন তাদের সন্তানদের যেন ভিটামিন এ ক্যাপসুল না খাওয়ানো হয়।
এমনকি তিনি এ প্রচারও করেছেন ভারত থেকে আমদানীকৃত এ ক্যাপসুল মেয়াদ উত্তীর্ণ এবং নিম্নমানের। এ খাওয়ালে শিশুর মৃত্যু হতে পারে। এ গুজবটি বোমার মতো বিষ্ফোরণ ঘটেছে। ফোন পাওয়ার পর গুজবটি চারদিকে ছড়িয়ে দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে।
এদিকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দেশের কোথাও কোনো শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি দাবি করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মজিবুর রহমান ফকির কোনো ‘গুজবে’ কান না দিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
বুধবার সচিবালয়ে নিজ কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই গুজব ছড়াচ্ছে। ”
তিনি জানান, যারা গুজব ছড়িয়েছে তাদের চিহ্নিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে এই কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বুধবার মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানোর কর্মসূচি নিয়ে সরকারের বক্তব্য তুলে ধরেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী।
তিনি ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশকের গুণাগুন তুলে ধরে জানান, ভিটামিন ক্যাপসুল খাওয়ার কারণে কোনো শিশুর অসুস্থতার কোনো প্রমাণ কোথাও মেলেনি।
মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল পর্যন্ত দেশজুড়ে ৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়। এই বয়সী ৯০ শতাংশ শিশুকেই ক্যাপসুল ও ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়েছে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
স্বাস্থ্য সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন আহমেদ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডাক্তার খন্দকার মোহাম্মদ সিফায়েত উল্লাহ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে মঙ্গলবার রাতে এক বিবৃতিতে ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন নিয়ে গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত আন্তর্জাতিক গবেষণাগারে পরীক্ষা দ্বারা মানসম্পন্ন, জীবাণুমুক্ত এবং সম্পূর্ণ নিরাপদ ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল দেশব্যাপী খাওয়ানো হয়েছে। এ নিয়ে দেশে একটি কুচক্রীমহল বিভিন্ন স্থানে অপপ্রচার ও গুজব ছড়িয়ে জনগণকে আতঙ্কিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
জনগণকে এ গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ও কৃমিনাশক ট্যাবলেট খেলে অনেক শিশুর বমি বমি ভাব হতে পারে। এছাড়া বাচ্চাদের একটু ঘুম ঘুম ভাব হতে পারে।
এতে মৃত্যুর কোনো ঝুঁকি নেই। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।