munirshamim@gmail.com
১.
কন্যাশিশু দিবসের ঠিক আগের রাতেই আমাদের একমাত্র কন্যাটি অবাক করে বলে উঠে, আমি ছেলে হলেই ভাল হতো। ওর বয়স কতো হবে। মাত্র ছয়। এ কয়েক বছরের জীবনকালে ওকে কখনও এ রকম মন্তব্য করতে দেখিনি। বরং মেয়ে হওয়ার কারণে ওর অনেক গর্ব।
অনেক তৃপ্তি। অনেক উচ্ছাস। এ উচ্ছাস শুধু নিজের ভেতরে নয়, অনায়াসে সে অন্যদেরও বলে বেড়ায়। ওর ছোট্র মনের গভীর প্রকাশে মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠার অপার সম্ভাবনাগুলোই ভেসে উঠে। ওর এ আত্ম-বিশ্বাস আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
আমরা অভিভূত হই। আর সে মেয়ে কিনা বলে- ছেলে হলেই ভাল হতো! শুনে আমি হেসে উঠি। অবাকও হই। আমার কৌতুহল বাড়ে। সাথে আতংকও ।
কেন কি হয়েছে, আমি জিজ্ঞেস করি। ওর সরল উত্তর। মেয়েদের অনেক বেশি কাজ করতে হয়। মৃন্ময়কে অত বেশি কাজ কাজ করতে হবে না। কিন্তু আমাকে করতে হবে।
মৃন্ময় তার মামাতো ভাই। মৃন্ময় চাইলে বাসার বাইরে যেতে পারবে। আমি পারবো না। ওর অল্প বয়সের ছোট্র পর্যবেক্ষণে যেন আপাত এক গভীর সত্যের প্রতিফলন। এ সত্য প্রাকৃতিক নয়, সামাজিক।
চাইলে এ সত্যটাকে মিথ্য করে দেয়া যায়। টুকরো টুকরো করে দেয়া যায়। তবু তা টিকে থাকে। ব্যবস্থার জোরে। বহুবছর ধরে বাঙ্গালী পুরুষতন্ত্র ধর্ম ও আচারের মিশেলে নারীর জন্য যে ব্যবস্থাটি তৈরি করেছে, সেটি যে ন্যায্য নয় একটি শিশুর সরল পর্যবেক্ষণে তা ফুটে উঠে।
তার এ তাৎক্ষণিক পাঠ করবার ক্ষমতা নিয়ে হয়তো গৌরব করা যায়। কিন্তু সে পাঠ থেকে যে আতংকের জন্ম সেটি তো কিছুতেই গৌরবের হতে পারে না। তবু এ সমাজ এ অগৌরবের বিষয় মহাযতনে সৃজন-পুনসৃজন করে। টিকিয়ে রাখে বংশপরস্পরায়।
২.
আমি ভাবি, ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হই।
অল্প বয়সী শিশুর সরল অনুসিদ্ধান্ত আমাকে নাড়ায়। ভীষণভাবে। আমারও মনে হতে থাকে সম্ভবত ওর জগতটা ছোট হয়ে আসছে। একটু একটু করে। আমরা চাই বা না চাই, যে ব্যবস্থার ভেতরে ওর বেড়ে উঠা, চলাচল, সেখানে ওর জগৎটি যে মুক্ত নয়, অনেক সীমাবদ্ধ, তা অস্বীকার করি কি করে! খুব মনে পড়ে প্রথম নিজে খেলনা কিনতে গিয়ে ও পছন্দ করেছিল দোকানের সব চেয়ে বড় ফুটবলটি।
সে ফটবলটি কিনেও ছিল। ফুটবল একটি নিতান্ত খেলার বস্তু নয়। এটি উচ্ছাস, গতিশীল, উদ্যাম ও স্বাধীন জীবনের প্রতিকীও। ফুটবল খেলা মানে ঘরের ভেতরের নয়, বাইরের মুক্ত জীবন। ছুটোছুটি, হৈচৈ করার অপার স্বাধীনতাও।
প্রথম খেলনা হিসেবে ওর ফুটবল পছন্দ করাতে মনে মনে খুশী খুশী হয়েছিলাম। অথচ ফুটবল খেলা সে মেয়েটিই এখন শংকিত! চিন্তিত।
কারণ ও ইতোমধ্যে স্কুলে যেতে শুরু করেছে। খেলতে শুরু করেছে বাইরের বন্ধুদের সাথে। প্রতিবেশিদের সাথে একটু আধুটু যোগাযোগও হয়।
নাটক, সিনেমা, গান, সংবাদপত্রেও মাঝে মাঝে ওর চোখ পড়ে। কিছু বুঝে, আবার কিছু বুঝে না। কিন্তু এ বুঝা না বুঝার মধ্যেও ওর কাছে এ সংবাদটি পৌছে গেছে। ও বুঝে গেছে, ওর জন্ম এমন এক সমাজে, যেখানে নারীর গতিশীলতা অনেক সীমিত। নারীকে বাড়তি কাজ করতে হয়।
এ ছোট্র অথব ভয়াবহ তথ্যটি সে হয়তো পেয়েছে তার বিদ্যালয়, বন্ধু, প্রতিবেশি, অথবা নাটক, সিনেমার গল্প থেকে। সাংস্কৃতিক পুরুষতন্ত্র যেভাবে তৈরি করে তার উপযোগী নারী। খুব ছোট্র বয়স থেকে। হাসিখুশি উচ্ছল শিশুরা মানুষ থেকে নারী হয়ে উঠে। আর হারায় তাদের স্বাধীন সত্ত্বা।
৩.
জাতীয় কন্যা শিশু দিবস এর সংবাদ পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হয়েছে। এটি নিশ্চই মেয়েদের বিদ্যামন প্রান্তিকতার অবসান দূর করার প্রয়োজনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। এ ইতিবাচক স্বীকৃতিকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু পুরুষতন্ত্রকে শক্তিশালী করবার যে সাংস্কৃতিক আয়োজন, এখানে-সেখানে, নাটক, সিনেমা, গল্প, সাহিত্য, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ধর্মের মাধ্যমে, সে প্রক্রিয়াগুলো টিকিয়ে রেখে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস কতটা কার্যকর হবে? কবে, কখন কীভাবে??
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।