© এই ব্লগের কোন লেখা আংশিক বা সম্পূর্ণ আকারে লেখকের অনুমতি ব্যতীত অন্য কোথাও প্রকাশ করা যাবে না।
ঘটনা : এখন সময় দুপুর সাড়ে বারোটা। আমরা বন্ধুরা মিলে সবাই হাসাহাসি করছি,ট্রাকের উপরে বসে আছি,রোদে আমাদের শরীর পুড়ে যায়,কিন্তু বাইরের বাতাসটাও না বেশ গায়ে লাগছে !! আমি নিজাম বলছি,আবু তোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র আমি। আমার পাশেই বসে আছে আবু তোরাব উচ্চ বিদ্যালয়, আবু তোরাব ফাজিল মাদ্রাসা ও প্রফেসর কামাল উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের অনেককেই আমি আগে থেকেই চিনি,আবার অনেকের সাথে আজকেই পরিচয় হলো।
আমরা গিয়েছিলাম মিরসরাই স্টেডিয়ামে,ঐখানে আজকে (সোমবার) বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের আবু তোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মগাদিয়া অরফানেজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খেলা ছিল। খেলা দেখেছি। দারুন লেগেছে খেলা দেখতে। যাকে বলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। তবে আমার বন্ধুরা দারুন খেলে ২-১ গোলে জয় ছিনিয়ে এনেছে।
খেলা শেষে অবশ্য প্রাথমিকের খেলোয়াড়রা অটোরিকশায় করে স্কুলে ফিরে যায়। আর খেলা দেখতে আসা আমি এবং অন্যরা ভাড়া করা একটি ছোট ট্রাকে করে আবু তোরাব বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। খেলা শেষে মিরসরাই স্টেডিয়াম থেকেই ট্রাকটি ভাড়া করা হয়। স্থানীয় মেম্বার সঞ্জীব স্যার এটি ভাড়া করে দিয়েছিলেন। আজকে সারাদিনে ভীষণ মজা করেছি।
সেই ভোরবেলায় উঠেছিলাম। খেলা দেখতে দূরে বন্ধুদের সাথে যাবো,এই উত্তেজনায় রাতের ঘুমটাও তেমন ভালো হলো না। তবে সেই কষ্ট দুর হয়ে গেছে সকালেই। আমরা খেলা দেখেছি,ঝাল-মুড়ি খেয়েছি। দুপুরে খাওয়ার ব্যাবস্তাও করেছিলেন সঞ্জীব স্যার।
আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু আজকে আমাদের স্কুলের হয়ে খেলেছে, এবং আমরা জিতেছিও। তাই ফেরার সময় গোটা যাত্রাটা যেনো আলাদা মাত্রা পেলো। সাথে আমার সমস্ত বন্ধুরা,মনে হচ্ছে আমার জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্তটি পার করছি।
দুর্ঘটনা: এখন সময় প্রায় পৌনে একটা। আমার কেনো জানি খুব ভয় করছে, ট্রাকের ড্রাইভার শুরু থেকেই কেমন জানি বেপোরোয়া ভাবে ট্রাকটি চালাচ্ছিলো।
আমাদের কয়েকজন চালককে বারবার অনুরোধ করার পরও তিনি সাবধান হননি। আবু তোরাব বাজার ও বড় তাকিয়া সংযোগ সড়কের দিকে ছুটে চলেছে ট্রাক। আমাদের কিছু বন্ধুরা গান গাইছে। আমি তাদের চেয়ে একটু দূরে বসে আছি। কি গান শুনতে একটু আলাদা করে নজর দিলাম।
হঠাৎ জানি কি হলো,পেটের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। চোখের সামনে দেখলাম আবু তোরাব বাজার ও বড় তাকিয়া সংযোগ সড়কে একটি লোহার ব্রিজ অতিক্রম করে একটি 'ভটভটি'কে সাইড দিতে গিয়ে আমাদের ট্রাকটি তাল না সামলাতে পেড়ে পাশের ডোবায় পড়ে যাচ্ছে। বুকের ভিতরটা কেন জানি অনুভূতিশূন্য হয়ে গেলো। এরপর আর কিচ্ছু মনে নেই। ক্ষণিক সময়ের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলি,তার পূর্বে দেখলাম আমার চেনা অচেনা সবাই সেই ডোবার পানিতে ডুবে যাচ্ছে।
কি ভয়াবহ সেই দৃশ্য। আমি বোধহয় আর কোনোদিন শান্তিতে ঘুমাতে পারবো না। পানির ঝাপটা খেয়ে যেনো শরীরটা আবার জেগে উঠলো। আল্লাহর অশেষ দয়ায় যখন ডাঙায় উঠতে সমর্থ হই তখন দেখি আমাদের বহনকারী সেই ট্রাকটি পানিতে তলিয়ে গেছে। এরপর কিছু সময় পর মানুষ জড়ো হয়।
তারা সবাই মিলে আমাদের বাঁচানোর চেষ্টা করতে থাকে। আস্তে আস্তে ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা আর নৌবাহিনীর ডুবুরিরা আসতে থাকে। তারা ডোবা থেকে সেই ট্রাকটি তুলবার চেষ্টা করতে থাকে। ওদিকে বেঁচে যাওয়া এমরান, বোরহান, বাদশা আর নোমান আমার কাছে আসে দাঁড়ায়। চারিদিকে তখন আরো মানুষ জমা হয়েছে।
আমি তখন বোবার মতো হাঁ করে সবার দিকে তাকিয়ে থাকি। অবশেষে বিকাল পৌনে ৫টার দিকে রাস্তার পাশের ডোবা থেকে ট্রাকটি তুলে আনেন। এরপর নৌবাহিনীর ৬ জন ডুবুরি আরো ঘণ্টাখানেক ডোবায় তল্লাশি চালান। ডুবুরিরা উঠে আসার পরপরই উদ্ধার অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। একে একে ধ্রব নাথ (১৭), রনি (১৫), ইমরান (১৭), ইফতেখার (১৬), আনন্দ দাশ (১২), জাহিদুল (১৩), কামরুল (১৬), টিটু দাশ (১৬), লিটন দাশ (১৭), জাহিদুল ইসলাম (১৬), স্বপন দেবনাথ, রাজু, রাজীব, শুভ, সাজু, রফিকুল, আরিফ, সাজ্জাদ, জুয়েল, মেজবাহ উদ্দিন, জুয়েল, সাইদুল (১৬), শামসুদ্দিন রনি, মেজবাহ উদ্দিন (১৮), সাখাওয়াত হোসেন (১২) ও শামসুদ্দিন (১২) ও আনোয়ার (৩০) সহ আরো নাম না জানা সর্বমোট ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার করে।
আমি তখন নিজেকে কেমন করে হলেও একটু সামলে নিয়েছি। খুব মনে পড়ছে,দুর্ঘটনার কিছু সময় আগেও চালক মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। মিরসরাই সদর থেকেই 'উল্টা-পাল্টা' গাড়ি চালাচ্ছিলেন তিনি। শুধু আমি নই, বেঁচে যাওয়া এমরান, বোরহান, বাদশা, নোমান- আমরা সবাই জানি শুধুমাত্র চালকের অমনোযোগিতার কারণেই এই ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। পরে ওসি স্যারের কাছে শুনলাম , ট্রাকের চালক মফিজ উদ্দিন নাকি দুর্ঘটনার পর থেকেই পলাতক।
দুর্ঘটনার পরপরই আমি দেখেছি আবু তোরাব বাজারে নিহতদের স্বজনদের মাঝে কান্নার,এ শোকের মাতম যেনো কখনোই থামবার নয়। পুরা শহর যেনো একটা মৃত্যুপুরী। এখানে কবর আর শ্মশান মিলেমিশে যেনো একাকার হয়ে গেছে। আমাদের বন্ধুরাতো খারাপ ছিল না। আমরা গিয়েছিলাম শুধুমাত্র খেলা দেখতে।
আমাদের ওপর কেন আল্লাহর গজব পড়লো ? আমরা কি এমন দোষ করেছিলাম। আল্লাহর কাছে আমার ছো্ট্ট অনুরোধ,তুমি তাদের সবাইকে বেহেশতে পাঠিয়ো। তারা যেনো আর কোনোদিন এমন কষ্টের ছিটেফোঁটাও না পায়। ভাগ্যিস দুর্ঘটনার আগে বড়তাকিয়া এলাকায় ১৫ জন নেমে যায়। তা না হলে দুর্ঘটনায় না জানি আরও কতো মারা যেতো।
আর সরকারকে বলছি, আমরা খুব গরীব ঘরের ছেলে। আমাদের বন্ধুদের মৃত্যুর পর আপনারা মৃতদেহ দাফনের জন্য প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যর একটি তদন্ত কমিটিও করেছেন। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের জন্য আর্ঠিক সাহায্য কিংবা বেকারদের চাকরির ব্যাবস্থাও করেছেন। সেজন্য আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আপনারা হয়তো চালক মফিজ উদ্দিনকে ধরেও ফেলবেন। হয়তো তার খুব দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হবে,হয়তোবা আইনের প্যাঁচ পেরিয়ে সে বেরিয়ে আসবে। যাই হোক,আমার সেই নাম জানা- না জানা বন্ধুরাতো কখনোই ফিরে আসবে না। তাদের আ্ত্মা তখনোই শান্তি পাবে যখন এদেশ থেকে সকল মফিজ উদ্দিনরা বিনাশ পাবে। এ ভয়াবহ স্মৃতি যেনো আর কারো জীবনে নতুন করে না আসে---দয়া করে সে ব্যাবস্থা নিন,আপনাদের ক্ষমতা অসীম, চাইলেই আপনারা সব পারেন।
আমাদের অশ্রু যেখানে একমাত্র অবলম্বন সেখানে আপনাদের দিকে মুখ তুলে রাখা ছাড়া আর কি করতে পারি। আর কারো জীবনের সেরা মুহুর্ত যেনো বিভীষিকায় রূপ না নেয়---বিধাতার কাছে সর্বদা সেই প্রার্থনা করি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।