আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রিক পুরাণের মহাপ্লাবন

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ মহাপ্লাবন বা deluge ; আমরা নূহ (আঃ) নবীর আমলের মহাপ্লাবনের কথা জানি। তবে গ্রিক পুরাণেও এক মহাপ্লাবনের উল্লেখ রয়েছে। এবং বাইবেলের মতো গ্রিক পুরাণের মহাপ্লাবনও ছিল মানবজাতির প্রতি শাস্তি।

এই প্রসঙ্গে একজন গবেষক লিখেছেন: Like the version from the Old Testament, in the Greek version, the flood is a means to punish mankind. বাইবেল বর্ণিত মহাপ্লাবনের মত গ্রিক পুরাণের মহাপ্লাবনেও সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে যায়নি। ডিউক্যালিয়ন এবং পীরা নামে দু’জন পূণ্যবান মানবমানবী বেঁচে গিয়েছিল। তারাও নূহ(আঃ) নবীর অনুরূপ একখানি কিস্তিও তৈরি করেছিল এবং মহাপ্লাবনের পর নতুন মানবপ্রজাতির জন্ম দিয়েছিল । দেবতা জিউস। প্রাচীন গ্রিকরা মনে করত ... গ্রিসের থেসালির মাউন্ট অলিম্পাস-এর চূড়া ছিল দেবতা জিউসের নিবাস ।

দেবতা জিউস সিংহাসনে বসে আছেন। তাকে ক্রোধান্বিত দেখায়। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে স্বর্গীয় দেবদূত হার্মেস । দেবতা জিউস হুঙ্কার ছাড়লেন, পৃথিবী পাপ আর পঙ্কিলতায় পরিপূর্ণ হয়ে পড়েছে! আমি পৃথিবী ধ্বংস করে দেব! জিউসের হুঙ্কারে কেঁপে উঠলেন হার্মেস । সম্পর্কে হার্মিস জিউসপুত্র; তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে পিতাকে বললেন, এপিমেথিউস- এর স্ত্রী প্যান্ডোরা কে আপনি একটি বাক্স দিয়েছিলেন।

সেই বাক্সটি খুলতে আপনি নিষেধও করেছিলেন। কিন্তু, আপনার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্যান্ডোরা বাক্সটি খুলে ফেলেছিল। তারপর থেকেই পৃথিবীতে ঘৃনা ক্রোধ পাপ ছড়িয়ে পড়েছে! এই দুর্যোগ মানবজাতির প্রতি আপনার শাস্তি। বিদ্রোহ প্রোমেথিউস মানবজাতিকে আগুন দিয়েছিল। দেবতা জিউস কিছুটা ক্ষোভের সুরে বললেন, হ্যাঁ।

শাস্তিই বটে! আর ককেশাস পর্বতে টাইটান প্রোমেথিউস তার শাস্তি ভোগ করছে। ইউরেনাস এবং গেইয়ার বারো সন্তান টাইটানরা হিসেবে পরিচিত । এদের গ্রিক পুরাণে প্রি-অলিম্পিয়ান দেবতা বলা হয়। এরা পৃথিবী শাসন করত। জিউস টাইটানদের উৎখাত করে পৃথিবীতে তাঁর শাসন কায়েম করেছিলেন।

প্রোমেথিউস ছিলেন টাইটানদেরই একজন। মানুষ পছন্দ করতেন প্রোমেথিউস । মানবসমাজে ঘৃনা ক্রোধ অসুখ দারিদ্র নেই। (কারণ তখনও প্যান্ডোরার অশুভ বাক্স টি খোলা হয়নি) প্রোমেথিউস মানুষকে যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। তবে তিনি লক্ষ করেছেন মানুষ রাত্রে শীতে কাঁপে, কাঁচা মাংস খায়।

মানুষের দরকার আগুন । আগুন পেলেই সে দেবতা জিউস আগুন দেবে না। কেন ? অপব্যবহার করবে। ধ্বংস করবে। ভালো মানুষ আগুনের সঠিক ব্যবহারই করবে।

স্বর্গ থেকে চুরি করে মানুষকে দেয়। ককেশাস পাহাড়চূড়ায় শেকল দিয়ে বাঁধলেন জিউস। শকুন এসে প্রতিদিন শরীরের মাংস খেত ঠুকরে! হার্মেস বললেন, হ্যাঁ, ককেশাস পর্বতে টাইটান প্রোমেথিউস তার শাস্তি ভোগ করছে। আর প্রোমেথিউস-এর পুত্র ডিউক্যালিয়ন তার পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছে। ওহ! পুণ্যাত্মা ডিউক্যালিয়ন।

দেবতা জিউস উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লেন। হার্মেস বললেন, হ্যাঁ। প্রোমেথিউস-পুত্র ডিউক্যালিয়ন-এর মতো পুণ্যবান মানুষ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। তার স্ত্রীর নাম পীরা। পীরাও ভারি পুণ্যবতী।

পীরা মানে-এপিমেথিউস এবং প্যান্ডোরার কন্যা ? জিউসকে কেমন কৌতূহলী মনে হল। হ্যাঁ। শুনেছি ভারি সতীসাব্ধী স্ত্রীলোক সে। হার্মেস বললেন। হুমম।

তবুও আমি আমি পাপে পূর্ণ পৃথিবী ধ্বংস করে দেব। দেবতা জিউস বললেন। ধ্বংস করে দেবেন? হার্মেস আতঙ্কিত হয়ে বললেন। হ্যাঁ। হ্যাঁ।

ধ্বংস করে দেব! ধ্বংস করে দেব! এক মহাপ্লাবন সৃষ্টি করে মানবজাতি কে সম্পূর্ন ধ্বংস করে দেব । গর্জন করে উঠলেন দেবতা জিউস। তারপর নরম সুরে বললেন, পৃথিবীতে কেবল পুণ্যাত্মা ডিউক্যালিয়ন এবং তার পুণ্যবতী স্ত্রী পীরা বেঁচে থাকবে । দেবদূত হার্মেস এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কম্পন অনুভব করলেন। মানবজাতিকে আগুন এনে দেওয়ার ‘অপরাধে’ ককেশাস পর্বতে প্রোমেথিউস তার শাস্তি ভোগ করছে।

ওদিকে ডিউক্যালিয়ন ককেশাস পর্বতে তার পিতা প্রোমেথিউস-এর সঙ্গে দেখা করে ফিরে এল গ্রিসে। তাঁকে উদ্বিগ্ন দেখায়। তোমাকে উদ্বিগ্ন দেখায় কেন? পীরা স্বামীকে জিজ্ঞেস করে। তার কারণ আছে। কি? বাবার কাছে এক ভয়াবহ সংবাদ জানতে পারলাম।

কি সংবাদ! পীরার বুক ধক করে ওঠে। দেবতা জিউস মহাপ্লাবন সৃষ্টি করে মানবজাতি ধ্বংস করে দেবেন। পীরা আর্তনাদ করে ওঠে। মুখ চাপা দেয়। উদ্বিগ্ন ডিউক্যালিয়ন বলল, বাবা আমাকে মহাপ্লাবন থেকে বাঁচার জন্য একটি কিস্তি তৈরি করতে বললেন।

বাইবেলে কিস্তি কে Ark বলা হয়েছে .... the ship that Noah (নূহ (আঃ)) was instructed to build by God to save his family and the animals from the Flood.... ডিউক্যালিয়ন কিস্তি তৈরি করে। পীরা তাকে সাহায্য করে। কিস্তি তৈরি শেষ হলে কিস্তিতে গম, মধু আর খাবার পানি তুলল ডিউক্যালিয়ন । ডিউক্যালিয়ন এবং তার স্ত্রী পীরা কিস্তিতে উঠল। ধীরে ধীরে পানি বাড়তে লাগল।

পীরা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, দেবতা জিউস এমন সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? ডিউক্যালিয়ন বলল, পৃথিবীতে মানবজাতি পাপে নিমজ্জ্বিত হয়েছে। পীরা আক্ষেপের সুরে বলল, ইস! মা যদি দেবতা জিউস-এর দেওয়া সেই বাক্সটি না খুলত! ডিউক্যালিয়ন বলল, তোমার মা প্যান্ডোরা দেবতা জিউস-এর ইচ্ছাতেই বাক্সটি খুলেছে। কেন? পীরা অবাক। মানবজাতিতে শাস্তি দিতে। বাবা স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে মানবজাতিকে দিলেন।

ডিউক্যালিয়ন বলল। পীরা চুপ করে থাকে। কিস্তির গবাক্ষ পথে তাকায়। বাইরে সন্ধ্যা নামছে আর চারিদিকে থই থই পানি। প্রান্তর নেই, পাহাড় নেই -কেবলই পানি আর পানি।

এভাবে এক এক করে ৯ দিন কাটল। তারপর পানি কমতে লাগল। কিস্তি এসে ঠেকল একটি পাহাড়ের গায়ে। পার্নেসাস পাহাড় না? পীরা অবাক হয়ে স্বামীকে জিজ্ঞেস করল। হ্যাঁ।

ডিউক্যালিয়ন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল। কিস্তিতে থাকতে তার ভালো লাগছিল না। যারা চলচিত্রকার Roland Emmerich পরিচালিত ২০০৯ সালের হলিউডি সায়েন্স ফিকশান 2012 ছবিটি দেখেছেন তারা ওই ছবিটির শেষ দৃশ্যাবলীর সঙ্গে মহাপ্লাবনের পর গ্রিসের পার্নেসাস পাহাড়ে কিস্তির অবতরণের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন। গ্রিসের মানচিত্রে পার্নেসাস পাহাড়ের অবস্থান। কিস্তি থেকে নেমে ডিউক্যালিয়ন এবং পীরা তাকাল।

চারিদিকে কাদা আর ধ্বংসের চিহ্ন । পাইন গাছগুলিকে কেমন মলিন দেখায়। কাদামাখা পাথরের উপর শ্যওলা জমেছে। দূরে কোরিন্থ উপসাগর। সে উপসাগরের জলে মধ্যাহ্নের সূর্যালোকে ঝলমল করছিল।

পীরা বলল, কাছেই তো দেলফির উপাসনায়লয়। তাই না ডিউক্যালিয়ন? হ্যাঁ। ডিউক্যালিয়ন বলল। বুক ভরে শ্বাস নিল। ভালো লাগছে।

কিন্তু মানুষজন নেই। কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। পীরা বলল, চল। আমরা দেলফির উপাসনায়লয়ে যাই। দেবতা জিউসের উপাসনা করি।

তিনি আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন । চল। ডিউক্যালিয়ন বলল। দেলফি। এই উপাসনালয়টি দেবতা অ্যাপোলের নাম জড়িত।

গ্রিক ধর্মজগতে দেরফির উপাসনালয়ের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুর্ত্বপূর্ণ। সাবধানে পার্নেসাস পাহাড় থেকে নেমে ডিউক্যালিয়ন এবং পীরা দেলফির উপাসনালয়ে এল। তারপর একান্তমনে জিউসের উপাসনা করতে লাগল । মাউন্ট অলিম্পাস বসে এ দৃশ্য দেখে দেবতা জিউস সন্তুষ্ট হলেন। তিনি স্বর্গীয় দেবদূত হার্মেস কে বললেন, শোনো, হার্মেস।

তুমি এখুনি ডিউক্যালিয়ন এবং পীরার কাছে যাও। ওদের মনোবাসনা পূর্ণ কর। স্বর্গীয় দেবদূত হার্মেস বিদ্যুতের গতিতে দেলফির উপাসনালয়ের প্রাঙ্গনে এলেন । দেবদূত কে দেখে ডিউক্যালিয়ন এব পীরা অবাক। স্বর্গীয় দেবদূত হার্মেস বললেন, আমাকে দেখে তোমাদের অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আমাকে দেবতা জিউস পাঠিয়েছেন। তোমরা জিউসের আরাধনা করেছে। জিউস তাতে ভারি সন্তুষ্ট হয়েছেন। আমি তোমাদের মনের বাসনা পূর্ণ করব। বল কি তোমাদের মনের বাসনা? পীরা স্বামীর দিকে তাকায়।

তারপর বলল, আমরা মানুষ চাই। পৃথিবী ভরতি মানুষ। পৃথিবী আবার মানুষে- মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক। এই আমার মনের বাসনা। স্বর্গীয় দেবদূত হার্মেস বলল, তোমাদের মনে বাসনা পূর্ণ হবে যদি - যদি? যদি তোমরা তোমাদের মায়ের হাড় পৃথিবীতে ছড়িয়ে দাও।

এই কথা বলেই স্বর্গীয় দেবদূত হার্মেস অদৃশ্য হল। কথাটার মানে অবশ্য ডিউক্যালিয়ন বুঝল না। পীরার মুখের দিকে চাইল। পীরাকেও বিমূঢ় দেখাল ; তবে সে গভীর ভাবে ভাবছিল। পীরা বলল, আমরা টাইটান।

ইউরেনাস আমাদের পিতা এবং পৃথিবীমাতা গেইয়া আমাদের মা। পাথর হল পৃথিবীমাতা গেইয়ার হাড় । বুঝেছি। বলে ডিউক্যালিয়ন একটি পাথর ছুড়ে মারল । চোখের পলকে একটি মানবের জন্ম হল।

এরপর পীরা একটি পাথর ছুড়ে মারল । চোখের পলকে একটি মানবীর জন্ম হল। ডিউক্যালিয়ন যে পাথর ছুড়ল সেটি হল পুরুষ। পীরা সে পাথর ছুড়ল সেটি হল নারী। ডিউক্যালিয়ন এবং পীরা পাথর ছুড়ে মারছে।

ডিউক্যালিয়ন এবং পীরার মনের বাসনা পূর্ণ হল। তারপর? তারপর থেসালি রাজ্যের রাজা হল ডিউক্যালিয়ন । পীরার একটি ছেলে হল। ছেলের নাম রাখল হেলেন (Hellen )। ছেলের নামে দেশের নাম হল: ‘হেলাস।

’ এ কারণে গ্রিসকে হেলাস বলা হয়। এবং গ্রিসের জীবনধারা ও সংস্কৃতিকে Hellenism বলা হয়। তবে ট্রয়ের সুন্দরী রাজকন্যা হেলেন পীরা এবং পুত্র হেলেন কে গুলিয়ে ফেলা ঠিল কনা। আমাদের মনে রাখতে হবে হেলেন লিখতে একটা এল (L) ব্যবহার করা হয়। (Helen)।

আর আমরা Hellenistic Greece কথা শুনেছি; ... সে প্রসঙ্গে একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন: Hellenistic Greece refers to the period in Greek history following Alexander the Great. Egypt, and particularly Alexandria, came to be the center of Hellenism. The end of the Hellenistic World came when the Romans took over Egypt, in 30 B.C., with the death of Cleopatra. Hellenistic Greece বা হেলেনসম্ভুত যুগে ইহুদিরা আলেকজান্দ্রিয়া নগরে বসবাস করত। ওই সময়ে বাইবেল গ্রিক ভাষায় অনূদিত হয়। সে সময়ই মহাপ্লাবনের বিষয়টি হিব্রু বাইবেলে সংযুক্ত হতে পারে বলে পন্ডিতদের অনুমান। একবিংশ শতকের কিস্তি। চলচিত্রকার Roland Emmerich পরিচালিত ২০০৯ সালের হলিউডি সায়েন্স ফিকশান 2012 ছবিটিতে এই কিস্তিতে উঠে মানবজাতির একাংশ বেঁচে থাকে।

ছবি: ইন্টারনেট। তথ্যসূত্র: http://www.theoi.com/Heros/Deukalion.html http://www.paleothea.com/Myths/Pyrrha.html http://www.paleothea.com/Myths/Pyrrha.html  ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।