বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
এপিকিউরিয়াস
আজ থেকে প্রায় ২৩ ’শ বছর আগে গ্রিসের রাজধানী এথেন্স শহরে ঢাকার শহীদ মিনারের মতো একটি পবিত্র অঙ্গন ছিল । এথেন্স শহরের সেই পবিত্র অঙ্গনটি আসলে ছিল একটি উদ্যান; যে উদ্যানে বসে জীবনজগৎ সম্বন্ধে মতামত ব্যক্ত করতেন এক গ্রিক দার্শনিক; সেই দার্শনিকের নাম এপিকিউরিয়াস । জ্ঞানচর্চা প্রকারন্তরে ভাষারই চর্চা, সে কারণেই ঢাকার শহীদ বেদির মতো গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরিয়াস এর সেই উদ্যানটিকে অত্যন্ত পবিত্র জ্ঞান করি।
সেই পবিত্র জ্ঞানপীঠে এপিকিউরিয়াস এর বক্তব্য শ্রবণ করার জন্য এথেন্স নগরের অনেকেই আসত; এমন কী মেয়েরাও আসত। এ তথ্যটি কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের করে বৈ কী। কেননা, গ্রিসের পুরাকালের ইতিহাসপাঠে আমরা জানতে পারি যে, আজ থেকে ২৩ ’শ বছর আগে এথেন্স নগরের রাস্তায় মেয়েদের প্রকাশ্যে চলাচলের অনুমতি ছিল না। তবে এথেন্সের রাস্তায় রথ চলত। এ থেকে দুটো সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছতে পারি।
(ক) মেয়েরা ঢাকা-রথে চেপে এপিকিউরিয়াস এর বাগানে যেত।
(খ) সেই মেয়েরা ছিল সম্পন্ন ঘরের। কেননা, বাঙালি মুসলিম সমাজের নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে রংপুরের প্রান্তিক খেটে খাওয়া নারী হিসেবে কল্পনা করা কঠিন।
আমি কখনও এথেন্স যাইনি। তবে আমার মনে এই প্রশ্ন জাগে।
এপিকিউরিয়াস এর পবিত্র উদ্যানটি
কোথায় ছিল? প্লাকায় কি? প্লাকা হল এথেন্সের অ্যাক্রোপলিসের কাছে একটি আবাসিক এলাকা।
প্লাকা। এপিকিউরিয়াস ৩০৬ খ্রিস্টপূর্বে এথেন্স যান। এবং There he founded The Garden, a school named for the garden he owned about halfway between the Stoa and the Academy that served as the school's meeting place. এপিকিউরিয়াস পবিত্র বাগানটি কি প্লাকায় ছিল? একদিন এথেন্স যাব এই প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজতে।
গ্রিসের মানচিত্র।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একবার বলেছিলেন গ্রিসের সঙ্গে বাঙালির অনেক মিল আছে। বাঙালিরা যেমন পৃথিবীর নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে প্রাচীনকালে গ্রিকরাও নানান নগররাষ্ট্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করত। আমি গ্রিক ইতিহাস পাঠ করে বাঙালির সঙ্গে গ্রিকদের আরও এক সাদৃশ্য খুঁজে বার করেছি। প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সবাসী বাঙালিদের মতো মাছ খেতে পছন্দ করত বেশি।
এপিকিউরিয়াস এর সময়কাল ৩৪১ থেকে ২৭০ খ্রিস্টপূর্ব; সর্বমোট ৭২ বছর বেঁচে ছিলেন।
৩৪১ খ্রিস্টপূর্বের ফেব্রুয়ারি মাসে এপিকিউরিয়াস-এর জন্ম সামোস নামে একটি দ্বীপে।
মানচিত্রে সামোস দ্বীপ।
সামোস দ্বীপ।
এপিকিউরিয়াস এর কিশোর বয়েসে এক গুরুর কাছে শিক্ষা আরম্ভ। সেই গুরুর নাম প্যামফিলাস।
তিনি ছিলেন প্লেটোবাদী। এপিকিউরিয়াস এর ভাবনার ওপর গ্রিক দার্শনিক ডোমোক্রিটাস এর প্রভাব আছে। অবশ্য এপিকিউরিয়াস তা অস্বীকার করেছেন। নিজেকে স্বশিক্ষিত দার্শনিক বলতেন এপিকিউরিয়াস । যা হোক।
১৮ বছর বয়েসে এথেন্স যান। সময়টা ৩০৬ খ্রিস্টপূর্ব।
এথেন্স । উঁচু পাহাড়টিই অ্যাক্রোপলিস। অ্যাক্রো মানে উঁচু, আর পলিস মানে নগর।
পিছনে বর্তমান কালের এথেন্স নগর; ঐ নগরেই আজ থেকে ২ হাজার ৩০০ ’শ বছর আগে বেঁচে ছিলেন এপিকিউরিয়াস নামে এক ভাবুক যার ভাবনায় উঁকি দিয়েছেন গৌতম বুদ্ধ ...
এথেন্সে নিজের বাড়ির বাগানে জ্ঞানচর্চা করতেন এপিকিউরিয়াস । বিয়ে করেননি। কিন্তু, কী বলতেন এপিকিউরিয়াস বাগানে বসে? বলতেন, দর্শন চর্চা অবাস্তব এবং অপ্রয়োজনীয় কিছু নয়। জীবনে দর্শনচর্চার প্রয়োজন আছে। দর্শনের চর্চা জীবনকে সুখি করে।
অল্প দুঃখ আর বেশি সুখ হলেই জীবন আনন্দময় হয়ে ওঠে। অথচ কিছু চেয়ে না পেলেই জীবনে দুঃখ ঘনিয়ে ওঠে। আপনার ইচ্ছে হল বিকেলে নৌকা বাইবেন হাঁপানি জন্য কষ্ট তো হবেই। তা হলে কি করবেন? বিকেলে নৌকা নৌকা বাওয়ার ইচ্ছে না বিসর্জন দিন। কিছু চাইবেন না।
চাইলেই কষ্ট পাবেন। কিছু চাওয়ার আকাঙ্খাই যন্ত্রণা দেয়। ঘনিষ্ট বন্ধু করবেন না। বন্ধু চলে গেলে কষ্ট পাবেন। প্রেমও করবেন না।
ঐ একই কারণেই । দ্য লেস ইউ ওয়ান্ট, দ্য হ্যাপীয়ার ইউ ইউল বি।
সর্বনাশ! এতো দেখছি ভারতীয় দর্শনের প্রভাব?
হু। এ বিষয়ে পরে বলছি।
এপিকিউরিয়াস আরও বলতেন, লোকে যখন মারা যায় সেই সঙ্গে তার আত্মাও বিনাশপ্রাপ্ত হয়।
কেননা, অণুদ্বারা শরীর ও মন সৃষ্ট। মৃতের শরীরের অণুগুলি ভেঙে অন্য বস্তু তৈরি হয়। কাজেই মৃত্যু ভয় না করাই উচিত। মৃত্যুর পর কী হবে সেসব নিয়েও ভেবে কোনওই লাভ নেই। ঈশ্বর দেবতা নিয়েও ভেবে লাভ নেই।
কেননা দেবতারা মানবজীবনে হস্তক্ষেপ করে না। দেবতারা অনেক দূরের লোকে সুখে শান্তিতে বসবাস করেন। ঘটনা যখন ঘটে প্রাকৃতিক বৈজ্ঞানিক কারণেই ঘটে। ঘটনাপ্রবাহে ইশ্বরের ভূমিকা নাই।
এ তো চাবার্ক দর্শনের কথা।
এর কারণ ব্যাখ্যা করি।
এপিকিউরিয়াস বেঁচে ছিলেন হেলেনিস্টিক সভ্যতায়। হেলেনিস্টিক শব্দটাকে একজন লেখক বাংলা করেছেন হেলেনসম্ভুত । আমরাও তাকে অনুসরণ করে বলি: হেলেনসম্ভুত সভ্যতার সময় কাল ৩২৩ থেকে ১৪৬ খ্রিস্টপূর্ব। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বে ব্যবিলনে আলেকজান্ডারের মৃত্যুবরণ করেন -সেই থেকে হেলেনসম্ভুত সভ্যতার সূচনা আর এবং ১৪৬ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ রোমান সাম্রাজ্য গ্রিক মূলভূমি দখল করে নেয়-হেলেনসম্ভুত সভ্যতার সমাপ্তি।
হেলেনসম্ভুত সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল পূর্বপশ্চিমের সংস্কৃতির বিনিময়। এ প্রসঙ্গে জনৈক ঐতহাসিক লিখেছেন, The spread of Greek culture throughout the Near East and Asia owed much to the development of cities. Settlements such as Ai-Khanoum, situated on trade routes, allowed cultures to mix and spread. The identification of local gods with similar Greek deities facilitated the building of Greek-style temples, and the Greek culture in the cities also meant that buildings such as gymnasia became common. Many cities maintained their autonomy while under the nominal rule of the local king or satrap, and often had Greek-style institutions. Greek dedications, statues, architecture and inscriptions have all been found. However, local cultures were not replaced, and often mixed to create a new culture.ফলে, প্রাচ্যে যেমন গ্রিক তথা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহ সম্ভব হয়েছিল তেমনি পাশ্চাত্য তথা গ্রিসও লাভ করেছিল প্রাচ্যের অপার জ্ঞান-ঐশ্বর্য; বিশেষ করে ভারতীয় দর্শন। এইসূত্রে পশ্চিমের বোদ্ধামহল যে বুদ্ধের বাণীতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন-তাতে আর সন্দেহ কী। এপিকিউরিয়াস এর মতবাদকে বলা হয় এপিকিউরিয়বাদ। দর্শনটি হেলেনসম্ভুত সভ্যতার বলেই এপিকিউরিয়বাদ এর ওপর বৌদ্ধদর্শনের অনিবার্য প্রভাব পড়েছিল।
বুদ্ধ। বুদ্ধের সময়কাল ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্ব। ইনি প্রভাবিত করেছিলেন গ্রিসের এক দার্শনিককে। কিংবা এপিকিউরিয়াস এর কিছু ভাবনাচিন্তার সঙ্গে বুদ্ধের মিল ছিল। সবচে বড় কথা এঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতবাদে অবিচল ছিলেন।
অনেকে অস্তিত্ববাদের জনক হিসেবে বুদ্ধের নাম করেন। এ তালিকায় এপিকিউরিয়াস এর নামও উঠতে পারে।
ইংরেজিতে Epicurean বলে একটি শব্দ আছে। এর অভিধানগত অর্থ:
1. devoted to sensual pleasure: devoted to sensual pleasures and luxury, especially good food
2. pleasing to an epicure: suitable for or pleasing to an epicure
epicurean delicacies
আসলে এপিকিউরিয়াস এর মতবাদ অনৈতিক নয়। আসলে এর ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
এপিকিউরিয়াস বলতে চেয়েছেন অল্প দুঃখ বেশি সুখ হলেই জীবন আনন্দময় হয়ে ওঠে। কিছু চেয়ে না পেলেই জীবনে দুঃখ ঘনিয়ে ওঠে। এপিকিউরিয়াস দুঃখতে এড়াতে চেয়েছেন ঠিকই তবে আনন্দবাদী হয়ে উঠেননি কখনও; ঘনিষ্ট বন্ধু করবেন না, বন্ধু চলে গেলে কষ্ট পাবেন; প্রেমও করবেন না ঐ একই কারণেই; এরকম প্রেমবিরোধী লোক ডেভোটেড টু সেনসুয়াল প্লেজারস অ্যান্ড লাক্সারি ...কী করে হয়?
বরঞ্চ খ্রিস্টধর্মে এপিকিউরিয়াস এর দর্শনের সন্ন্যাসধর্মীতার প্রভাব স্বীকার করা হয়েছে। সন্তরা জগৎ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করবেন, শরীর নিয়ে ভাববেন না, ঘর-সংসার, বন্ধুবান্ধব, বিষয়-আশয় নিয়ে ভাববেন না। এসব এপিকিউরিয়াস এরই নির্দেশ।
তবে এপিকিউরিয়াস এর প্রতি খ্রিস্টীয় ধর্মতাত্ত্বিকগনের রয়েছে প্রবল এক ঘৃণা। কারণ এপিকিউরিয়াস এর দর্শন আত্মার অমরত্ব ও স্বর্গনরক বেমালুম অস্বীকার করে। কাজেই খ্রিস্টধর্মের উত্থানের সঙ্গে মতবাদটিকে গলা টিপে হত্যা করা হয়।
এপিকিউরিয়াস ছিলেন প্রকৃত দার্শনিক। তাঁর কিডনিতে পাথর হয়েছিল।
দীর্ঘকালীন যন্ত্রণা সত্ত্বেও লিখেছিলেন: আমার জীবনের শেষ দিন ঘনিয়ে আসছে। তারপরও খুশিমনে আমি এই কথাগুলি লিখছি। ভয়ানক উদারাময়সহ প্রশ্রাব না হওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করছি। আমার অবস্থা এতই ভয়ঙ্কর যে এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আমার মনে রয়েছে আনন্দের গভীর অনুভূতি; এ আনন্দময় অনুভূতির উৎস আমার দর্শনের সিদ্ধান্তসমূহ।
বুদ্ধও তাঁর অন্তিম বাণীতে বলেছিলেন:‘বয়ধন্মা ভিকখবে সংঘাবা অপপমাদেন সম্পাদেয়। ’ (দ্র.শ্রী শান্তিকুসুম দাশ গুপ্ত, বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম এবং প্রাচীন বৌদ্ধসমাজ। পৃষ্ঠা, ৭৪) এই পালি বাক্যটির বাংলা মানে: অপ্রমত্ত থেকে কর্তব্য সম্পাদন করা। এপিকিউরিয়াস এরও মৃত্যুকালীন আনন্দের কারণ তার দর্শনের সিদ্ধান্তসমূহের ওপর অবিচল আস্থা।
এই প্রসঙ্গে একটি কথা মনে পড়ে।
বিখ্যাত নিরেশ্বরবাদী দার্শনিক ডেভিড হিউম মৃত্যু শয্যায়। সারা জীবন অধিবিদ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। ইঙ্গিত দিয়েছেন অধিবিদ্যা সম্ভব নয়, অর্থাৎ মানবিক ভাষায় ঈশ্বর এবং স্বর্গনরকের জ্ঞান সম্ভব না। জেমস বসওয়েল গেছেন দেখা করতে; ইনি প্রখ্যাত সাহিত্যবিশারদ স্যামুয়েল জনসন এর জীবনী লিখে বিখ্যাত হয়েছেন। তো জেমস বসওয়েল মৃত্যুকে ভয় পেতেন।
তিনি ডেভিড হিউম কে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মাননীয় আপনি মৃত্যুশয্যায়। এখন স্বর্গনরক এবং আত্মার অমরত্ম সম্বন্ধে আপনার মত কি বদলিয়েছেন? ডেভিড হিউম ধমক দিয়ে বললেন, প্রশ্নই ওঠে না।
এপিকিউরিয়বাদী দর্শন রোমান আমল অবধি টিকে ছিল। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের সময়কাল ১০০ থেকে ৪৪ খ্রিস্টপূর্ব; সেই সময়ে রোমান সাম্রাজ্যে লুক্রেটিয়াস নামে একজন এপিকিউরিয়বাদী দার্শনিক বেঁচে ছিলেন। তিনি একটি বই লিখেছিলেন।
তাঁর বইয়ের নাম ডি রেরাম নাটুরা। ইংরেজিতে: অন দ্য নেচার অভ থিংঙ্কস।
আজও এই একুশ শতকে বৌদ্ধধর্ম এবং বৌদ্ধদর্শন টিকে থাকলেও খ্রিষ্টধর্ম এপিকিউরিয়াস এর দর্শনকে ধ্বংস করেছিল এর নাস্তিক্যবাদী বৈশিষ্ট্যের জন্য।
উৎসর্গ: পল্লী বাউল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।