সিআইডির পরিদর্শক মনিরুজ্জামান বলেন, ধর্ষণের পর দোররার আঘাতেই কিশোরী হেনার মৃত্যু হয়। মাহবুব ও তার আট সহযোগীকে ধর্ষণ মামলায় আসামি করা হয়েছে। হেনার মৃত্যুর পেছনে গ্রাম্য ফতোয়াবাজদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল।
শরীয়তপুরের নড়িয়া থানাধীন চামটা গ্রামে এ বছরের ২৩ জানুয়ারি ধর্ষিত হয় ১৫ বছরের কিশোরী হেনা আক্তার। পরে গ্রাম্য সালিশে ফতোয়ার শিকার হয়ে দোররার আঘাতে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।
ওই ঘটনার পর ধর্ষণ ও হেনার শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন গোপন করে থানায় মামলা করা হয়। ফতোয়াবাজদের রক্ষায় প্রথমে সাজানো মামলা নেয় পুলিশ। পরে এ ঘটনা জানাজানি হলে দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। আদালতের নির্দেশে ফের মামলা নিতে বাধ্য হয় পুলিশ।
ঘটনার ছয় মাসের মাথায় চাঞ্চল্যকর এ হত্যার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।
গত ৫ জুলাই শরীয়তপুরের আমলি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। হত্যা ও ধর্ষণের দুটি পৃথক মামলায় ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলার আসামি ২৬ এবং ধর্ষণ মামলার ৯ জন। দুটি মামলার প্রধান আসামি ধর্ষক মাহবুব। আসামি করা হয়েছে গ্রাম্য সালিশ বোর্ডের অন্যতম সদস্য ইদ্রিস ফকিরকেও।
এদিকে মৃত্যুর পর হেনার ময়নাতদন্ত রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। চিকিৎসকদের প্রভাবিত করে আলামত গোপন করে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট তৈরি করা হয়।
সিআইডির পরিদর্শক মনিরুজ্জামান বলেন, ধর্ষণের পর দোররার আঘাতেই কিশোরী হেনার মৃত্যু হয়। মাহবুব ও তার আট সহযোগীকে ধর্ষণ মামলায় আসামি করা হয়েছে। হেনার মৃত্যুর পেছনে গ্রাম্য ফতোয়াবাজদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল।
বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রাশিদুল হাসান মাসুম বলেন, চার্জশিটের কপি এখনও হাতে পাইনি। আমরা শুনেছি, ধর্ষণ মামলায় ৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত ছিল ১৮ জন। অনেক আসামি বাদ পড়ায় চার্জশিট নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
শরীয়তপুরের জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান রওশন আরা বেগম বলেন, ধর্ষণ মামলায় দেওয়া চার্জশিটে না-রাজি পিটিশন দাখিল করতে আমরা এরই মধ্যে সময়ের আবেদন জানিয়েছি।
হেনা হত্যার বিচার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন স্থানীয় এমন কয়েকজনকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। হত্যা মামলার চার্জশিটের কপি হাতে পেলে আমরা পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেব। যারা ঘটনার সময় এলাকায় উপস্থিত ছিলেন না_ এমন ক'জনকেও আসামি করা হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
যারা আসামি :
হেনার মৃত্যুর পরদিন তার বাবা দরবেশ খাঁ বাদী হয়ে নড়িয়া থানায় একটি মামলা করেন। এ মামলায় ধর্ষক মাহবুব খানকে প্রধান আসামি করে ১৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
অন্য আসামিরা হলো_ মাহবুবের স্ত্রী শিল্পী বেগম, জাহানারা বেগম, মোর্শেদা বেগম, ইদ্রিস শেখ, আক্কাস মীরমালত, ইয়াছিন মীরমালত, দীন মোহাম্মদ মীরমালত, আলা বক্স করাতি, জয়নাল মীরমালত, লতিফ মীরমালত, আবদুল হাই মীরমালত, হাফেজ মোঃ মফিজ তালুকদার, সাইফুল ইসলাম, জাহানারা বেগম, রবিউল খান, হাসান মীরমালত এবং জামাল সিকদার। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ধর্ষণ ও ধর্ষণ আড়ালের উদ্দেশ্যে ফতোয়া এবং হত্যার অভিযোগে হেনার মা আকলিমা বেগম বাদী হয়ে অন্য একটি মামলা করেন। এ মামলায়ও ওই ১৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তদন্ত শেষে সিআইডি হেনার মায়ের করা মামলায় মাহবুবসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে। অন্যদিকে হেনার বাবার করা মামলার এজাহারভুক্ত ১৮ আসামিসহ নতুন আরও আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
আসামিদের মধ্যে ধর্ষক মাহবুব, তার স্ত্রী শিল্পী বেগম, দোররা বোর্ডের প্রধান ইদ্রিস ফকির ও স্থানীয় মসজিদের ইমাম হাফেজ মফিজউদ্দিনসহ ১০ জন কারাবন্দি।
সেদিন যা ঘটেছিল :
হেনার পরিবার, এজাহার ও মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২৩ জানুয়ারি রাতে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামি মাহবুব খান হেনা আক্তারের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এ সময় মাহবুবের স্ত্রী শিল্পী বেগমসহ কয়েকজন মিলে মাহবুব খান ও হেনাকে আটক করে। একপর্যায়ে মাহবুবকে ছেড়ে দেওয়া হলেও হেনাকে আটক করে মাটিতে ফেলে কিল, ঘুষি, লাথি মেরে জখম করা হয়। তাকে মারধর করেই ক্ষান্ত হয়নি, নির্দোষ মেয়েটির বিচার করতে স্থানীয় প্রভাবশালী ইউপি মেম্বার ও মামলার আসামি ইদ্রিস ফকিরের কাছে বিচার দেয় মাহবুবের স্ত্রী।
স্থানীয় মসজিদ ও মাদ্রাসার দু'শিক্ষকের সমন্বয়ে ইদ্রিস মেম্বার গঠন করে দোররা বোর্ড। ২৪ জানুয়ারি রাতে হেনাদের বাড়িতেই তৎকালীন স্থানীয় ইউপি মেম্বার ইদ্রিস ফকিরের নেতৃত্বে বসে দোররা বোর্ড। বোর্ডের নেতৃত্ব দেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম হাফেজ মোঃ মফিজ উদ্দিন ও স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক সাইফুল ইসলামসহ স্থানীয় মাতবররা।
যেভাবে দোররা মারা হয় :
হেনার বাবা দরবেশ খাঁ ও মা আকলিমা বেগমসহ সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দোররা বোর্ডের প্রধান হাফেজ মোঃ মফিজ উদ্দিন, সাইফুল ইসলাম ও ইদ্রিস ফকির কিশোরী হেনাকে দোষী সাব্যস্ত করে। অসুস্থ মেয়েটিকে ১০১টি দোররা মারার ফতোয়া দেওয়া হয়।
তাদের দেওয়া ফতোয়া অনুযায়ী সালিশ বোর্ডের অন্য সদস্যরা একটি বড় গামছা পেঁচিয়ে 'প্রতীকী' দোররা তৈরি করে। পরে ফতোয়াবাজদের রায় কার্যকর শুরু করে মামলার এজাহারভুক্ত ৩ নম্বর আসামি জাহানারা বেগম। হেনার মা আকলিমা বেগম জানান, হেনাকে যখন দোররা মারা শুরু হয় ব্যথায় মেয়েটি কুঁকড়ে যাচ্ছিল। একসময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে পাশের ঘরের (১৬ নম্বর আসামি রবিউল খানের ঘরে) দরজা আটকে দোররা মারা হয়।
চোখের সামনেই হেনার শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
হেনার বাবা দরবেশ খাঁ বলেন, দোররা মারার পরদিন হেনাকে শরীরয়তপুর জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করি। হাসপাতালে নেওয়ার খবর পেয়ে হুমকি দেয় সালিশ বোর্ডের সদস্যরা। তাদের ভয়ে পাঁচ দিন চিকিৎসা দিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে আসি। এরপর হেনা আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে ৩১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তাকে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর সে মারা যায়।
ময়নাতদন্ত ও মামলা নিয়ে নানা নাটক :
৩১ জানুয়ারি রাতে হেনা মারা যাওয়ার পরদিন স্থানীয় থানা পুলিশ হেনার মরদেহের সুরতহাল তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। নড়িয়া থানার এসআই আসলাম উদ্দিন তৈরি করেন অসংলগ্ন সুরতহাল প্রতিবেদন। এ ঘটনায় হেনার বাবা ধর্ষণ ও দোররার আঘাতে মেয়ের মৃত্যুর অভিযোগে থানায় মামলা করতে যান। পুলিশ কৌশলে ধর্ষণ ও দোররার বিষয়টি এড়িয়ে যায়। হেনার মৃত্যুর পর নাটক এখানেই থেমে ছিল না।
শরীয়তপুর জেলা হাসপাতালের চিকিৎসকরা ময়নাতদন্ত রিপোর্টে বলেন, 'হেনার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। ' এ ঘটনাটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে হেনার মরদেহের দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করা হয়। দ্বিতীয় রিপোর্টে হেনার শরীরে একাধিক স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এরপর উচ্চ আদালতের নির্দেশে হেনার মৃত্যুর ঘটনায় ধর্ষণ ও দোররা মারার পৃথক মামলা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। মামলার বাদী হন হেনার মা আকলিমা বেগম।
(সাহাদাত হোসেন পরশ/আতাউর রহমান, সমকাল)। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।