আমি শুনতে পাই লক্ষ কোটি ফিলিস্তিনীর আর্তনাদ...হাহাকার (আমি ২০০২ ব্যচের নটরডেম কলেজের এক গর্বিত ছাত্র। ষ্টার/স্ট্যান্ড গ্রুপের মধ্যে শেষ গ্রুপ। প্রায় দুই বছরের এক অসাধারন এক অধ্যায়। আমি একজন সাধারন মানের এবং গোবেচারা টাইপ ছাত্র হিসেবে আমি বিভিন্ন ছোটখাট স্মৃতির কথা বলবো, বলবো কিছু কালো অধ্যায়ের কথা। একজন আনাড়ি লেখক হিসেবে আমার লেখার ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ করছি।
)
আমি ২০০০ সালের ব্যবসায় শিক্ষা শাখার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের এস.এস.সি’র ছাত্র। তখন ব্যবসায় শিক্ষা শাখার জন্য কমার্স কলেজ আর সিটি কলেজ ছিল এক নম্বরে। কিন্তু ঐতিহ্য আর আব্বা আম্মার প্রবল ইচ্ছার কারনে নটরডেম কলেজে ভর্তি হতে হয়েছিল। আমারও ইচ্ছা ছিলো নটরডেম কলেজে পরার, তার একটা কারন কলেজটি আমার বাসা থেকে হাটা পথে মাত্র ৭/৮ মিনিট।
ভর্তি কোচিং এর জন্য “ক্লাসিক কোচিং সেন্টার” নামে তখনকার বিখ্যাত কোচিং এ ভর্তি হয়েছিলাম।
তখন কোচিং এর ভাইয়াদের কাছে কলেজের বিভিন্ন বর্ননা ও ক্লাব কার্যক্রমের কথা শুনে কলেজ সম্পর্কে আরো আগ্রহী হয়ে উঠলাম। ক্লাসিক কোচিং এর আরেক আকর্ষণ ছিল সদ্য ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া কিছু সুন্দরী আপুদের ক্লাস করা। আপুদের চোখের দিকে তাকালেই হৃদয়ে কেমন যেন দোলা দিত। বিশেষ করে পল্লবী আপু আর উশ্রি আপুর কথা এখনও মনে আছে। যাদের দেখলে তখন আমার বুকের মধ্যে একটা ঠান্ডা অনুভুতির সৃষ্টি হতো।
আমার ফ্রেন্ডের অনেকেই তখন এই কোচিং এ ভর্তি হয়েছিল। তখন তাদের সাথে ওইসব আপুদের শারিরীক গঠন নিয়ে আলোচনাও ছিলো আমাদের প্রধান কাজের মধ্যে একটি।
কোচিং করার মাঝে এক ভয়াবহ রকমের গুজব শুনলাম। যেটা শুনে আমার আত্মা প্রায় যায় যায় অবস্থা। শুনলাম যে আইডিয়াল স্কুলের কমার্সের এস.এস.সি পরীক্ষার্থির প্রায় ৫৬% ফেল করেছে।
বাকিদের মধ্যে অর্ধেকই সেকেন্ড ডিভিশন। তখন আমরা ব্যপারটিকে হেসে উড়িয়ে দিলেও আমার মনের মধ্যে একটা কু রয়ে গেল। এর মধ্যে সপ্ন দেখলাম যে বাংলা প্রথম পত্রে ফেল করেছি।
রেজাল্ট দেবার কথা ছিল কোন এক বৃহষ্পতিবার। কিন্তু পরে বলা হলো হলো দেয়া হবে শনিবারে।
আমার কাজিনের বিয়ে উপলক্ষ্যে আমি ও আমার ফ্যামিলি সহ শুক্রবার গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম। আমার মধ্যে তখন একটা অজানা ভয় কাজ করছিল। সবাই বিয়ে বাড়িতে আনন্দ করছে আর আমি মনমরা হয়ে বসে রয়েছি। শনিবার বিয়ের দিন ইঞ্জিন নৌকায় বিলের উপর দিয়ে বরযাত্রীর সাথে কনের বাড়িতে গেলাম। চারপাশে ছিল অসাধারন প্রাকৃতিক দৃশ্য।
কিন্তু সেটা উপভোগ করার মত আমার মনের অবস্থা ছিলনা। ঢাকায় আমার সব ফ্রেন্ডরা রেজাল্ট দেখছে আর আনন্দ করছে আর আমি নৌকার ছৈ এর উপর বসে রয়েছি।
তখন (২০০০ সালে) সবার কাছে মুড়ি মুড়কি’র মত মোবাইল ফোন ছিল না যে ফোন করে রেজাল্ট যানা যাবে। ঢাকায় যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিলো বাজারের টি.এন.টি ফোন। বিয়ে বাড়িতে সবাই বেশ ভালো করে খাওয়া দাওয়া করল।
আমি কোন রকমে খেয়ে উঠে পড়লাম। অন্য সময় হলে কবজি ডুবিয়ে খেতাম। কনে নিয়ে ফেরার পথে আবার সেই ইঞ্জিন নৌকা দিয়ে বিল পাড়ি দেয়া। বিশাল বিল, আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামছে, পাখিরা ঘরে ফিরছে, চিরিদিকে এক অদ্ভুত মায়াময় আলো ছড়িয়ে রয়েছে। এই অপরূপ দৃশ্য বর্নলা করে বোঝানো সম্ভব হবে না।
তবে আমি সেই দৃশ্য উপভোগ করার মত উপায় ছিল না। আমার বুকে ক্রমাগত যেন হাতুড়ি পেটা হচ্ছে।
বাড়িতে ফিরেই আম্মু মামার বড় ভাই কে পাঠিয়ে দিলেন বাজারে গিয়ে ফোন করে আমার রেজাল্ট জেনে আসার জন্য। তখন আমি এক কোনায় ঊঠানে মোড়ার উপর বসে অপেক্ষা করছিলাম রেজাল্টের জন্য। তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টা কি সাতটা হবে।
চারিদিক অন্ধকার, আকাশে অসংখ্য তারা দেখা যাচ্ছে, বাড়ির ভেতর থেকে হৈ চৈ, হাসাহাসির শব্দ আসছে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। এমন কি “চিনিনা চিনিনা আবার চিনি চিনি” এই টাইপের মানুষও আছে। রেজাল্ট যদি অন্য রকম কিছু হয় তাইলে তো পুরা বেইজ্জতি!! আমি অন্ধকার উঠানে চুপচাপ বসে রয়েছি। বুকের হাতুড়ি পেটা ক্রমাগত বাড়ছে....প্রচন্ড টেনশন।
স্কুলে থাকতে “টাইটানিক” সিনেমায় জ্যাক ও রোজের সেই বিশেষ ছবি আঁকার দৃশ্য দেখার সময়ও এত টেনশন হয় নাই।
হঠাৎ সদর দরজার সামনে এক সাদা অবয়ব দেখা গেল। আমার ভাই ফিরে এসেছে (তার পরনে ছিল সাদা টি শার্ট ও প্যান্ট)। সে আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। আর আমার গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে গেল।
আম্মু আমার ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেএন। আমার বড় ভাই আম্মুর সামনে দাঁড়িয়ে ডানে বামে মাথা নাড়লো। আমার তখন মাথার চুল প্রায় দাঁড়িয়ে যায় অবস্থা। তারপর সে একগাল হেসে বলল “ফার্স্ট ডিভিশন আর দুইটা লেটার”। সেটা শুনে আমার গা থেকে যেন ১০০ মন পাথর নেমে গেল।
বাংলা বাগধারা “মাথা থেকে পাথর নেমে যাওয়া” এর মর্মার্থ সেদিন বাস্তবে বোধ করতে পেরেছিলাম। রেজাল্ট শুনে সবাই শুভেচ্ছা জানালো। আব্বু বাজার থেকে মিষ্টি আনতে পাঠালেন।
বেড়াল থেকে যেন সিংহ হয়ে গেলাম। তখন আনন্দের চোটে মাথাও কিছুটা আউলা হয়ে গিয়েছিল।
ঘরের দরজা বন্ধ না করেই কাপড় বদলানোর সময় আমার চাচাতো বোন তার বান্ধবী সহ ঘরে ঢুকে পড়ল। আমি তথন শুধু একটা লুঙ্গি পড়ে আমার বিশাল দেহে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছি। তারা ঢুকে লজ্জা পেয়ে “পরে আসব বলে” বের হয়ে গেল। অন্য সময় হলে খুব লজ্জা পেতাম। কিন্তু ওইদিন আমার রেজাল্টের খুশির কারনে তেমন গা করলাম না।
বাকি দুইদিন বেশ ফুর্তি করে করে কাটালাম। আর বৌ-ভাতের দিন কব্জি ডুবিইয়ে খেয়ে, বিয়ের দিনের খাওয়ার আবসোস পুষিয়ে দিলাম।
ঢাকায় ফিরে গিয়ে আবার সেই কোচিং, পাশের সারির মেয়েদের সাথে টাংকি মারা, আপুদের ক্লাস উপভোগ করা, ইত্যাদি চলতে লাগল। এরই মধ্যে নটরডেম কলেজ, সিটি কলেজ ও কমার্স কলেজের ফরম কিনে আনলাম। কিন্তু ফরম কেনার সম্য নটরডেম কলেজের পরিবেশ দেখেই ভর্তি হতে ইচ্ছে হয়েছিল।
বাস্কেট বল কোর্ট, বিশাল খেলার মাঠ, গাছ গাছালিতে ঢাকা এক স্নিগ্ধ পরিবেশ। সব কিছু মিলিয়ে নটরডেম কলেজে ভর্তি হবার এক প্রবল ইচ্ছা জাগলো।
ভর্তি পরীক্ষার দিন কলেজের গেইটে গিয়ে দেখলাম অভিভাবকদের বিশাল ভিড়। এর মধ্যে আমি কলেজে ঢুকে নিজের যায়গা খুজে বসে পড়লাম। পরীক্ষা শুরু হবার আগে ঘোষনা করা হলো কেউ পরীক্ষার সময় কথা বলবেন না।
বললে আপনাকে হয়ত কিছু বলা হবে না। কিন্তু আমারা মার্ক করে নিব এবং পরীক্ষা বাতিল হয়ে যাবে। এই পদ্ধতিকে তারা “সাইলেন্ট এক্সপেল” বলে। পুরো প্রশ্নপত্র তারা একসাথে দিল না। ভাগে ভাগে দিল।
কারো ভাগ্যে প্রথমে পড়ল বাংলা, কারো ইংরেজী। সেদিনের ইংরেজী প্রশ্নপত্রের একটা একটা বেশ বড় বাক্য বাংলা থেকে ইংরেজী ট্রান্সলেশন করতে দেয়া হয়েছিল। বাক্যটি এখনও মনে আছে।
“যখন বেদে কাঠি দিয়ে সাপটিকে নাড়া দিলো, তখন সাপটি গর্ত থেকে হিস্ হিস্ করে বের হয়ে আসলো। “
পরীক্ষা শেষে বলা হল রেজাল্ট কিছুদিনের মধ্যে “জনকন্ঠঃ পত্রিকায় দেয়া হবে।
রেজাল্ট দেয়ার দিন আম্মু ঘুম আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললেন। এবং আমাকে “জনকন্ঠ” পত্রিকায় রেজাল্টে আমার রোল নম্বরটি দেখালেন। .........ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড উল্লাসে ফেটে পড়লাম। কেমন যেন হঠাৎ বড় হয়ে যাবার অনুভুতি। কোন ইউনিফর্ম পড়তে হবে না, সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে কলেজে যাব, বাস্কেটবল খেল্ব, আড্ডা দিব, ভিকিদের (ভিকারুন্নেসার ছাত্রী) সামনে ভাব দেখাবো.....একদম অন্য রকম অনুভূতি।
মনের মধ্যে একটা বিশেষ ভাব “আমি কলেজে পড়ি”, “আমি নটরডেম কলেজে পড়ি”। (চলবে)
(প্রিক্যুয়েল এখানেই শেষ.......এরপরে বলব নবীনবরণের কথা, মানিক গোমেজ স্যার , টেরেন্স পিনেরো স্যার, শীতল স্যার, মুখতার স্যার, হাবিব স্যার, জাহাঙ্গীর কবির স্যার, নুরন্নবী স্যার (তবলা), ফাদার বকুল, ফাদার কস্তা, ফাদার বিমল......এবং আরও অনেকের কথা, আর ইংরেজী টিচার টিনা ম্যাডামের কথা তো বলবোই। আরও বলবো বিভিন্ন অম্লমধুর স্মৃতি, কলেজ পলিটক্স, ক্যন্টিনের আড্ডা ইত্যাদি বিভিন্ন ঘটনা। অপেক্ষায় থাকুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।