আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বপ্নের কাপ্তাই

প্রায় ২৮ বছর আগের কথা। চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই যাচ্ছি। চন্দ্রঘোনা-লিচুবাগান-বরইছড়ি পেরিয়ে উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তার বাঁ পাশে ঘন গাছে ভর্তি ছোট ছোট পাহাড়, ডানপাশে খরস্রোতা কর্ণফুলী নদী; যেন কখনও কখনও মনে হয় রাস্তা আর নদীতীর একটাই। নদীর ওপারে আবারও ঘন বন, পাহাড়। রাস্তায় কোলাহল নেই, চারদিক শান্ত, নিরিবিলি।

দেশের একমাত্র পানিবিদ্যুত্ কেন্দ্রের ছোট্ট এই শহরে প্রবেশের পর আরেক দৃশ্য। একদিকে কর্মব্যস্ত বাজার-জেটিঘাট-বিদ্যুেকন্দ্র-হ্রদ থেকে নদীতে মালামাল পারাপারের রোপওয়ে, অন্যদিকে ঘন সেগুন বনের ভেতর দিয়ে নৌবাহিনীর ঘাঁটিতে যাওয়ার এক অসাধারণ নয়নাভিরাম রাস্তা। গাছে গাছে পাখপাখালির গান আর হালকা বাতাসে পাতার মর্মর শব্দ। এ তো স্বর্গ! স্কুল পেরিয়ে সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া তরুণের চোখে প্রথম দেখাতেই কাপ্তাইয়ের সঙ্গে প্রেম। দীর্ঘদিন শুধু একটাই স্বপ্ন দেখে চলেছি।

সেই সুনসান নীরব রাস্তার পাশে কর্ণফুলী নদীর তীরে ছোট্ট একটা ঘর হবে, সেখানে বসে শুনব নদীর স্রোতের গান। কখনও পাখির গান শুনতে চাইলে ঢুকে পড়ব রাস্তার পাশের পাহাড়ি বনে। কখনওবা নদী পার হয়ে ঢুকে পড়ব গহিন বনে, গাছের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাব বহুদূর। বিকেলে নৌকা নিয়ে নেমে পড়ব হ্রদে, ভেসে বেড়াব ইচ্ছেমতো। আর বর্ষাকাল? সে তো আরও স্বপ্নময়! শ্রাবণের অঝোর ধারায় বৃষ্টির দিন বনের ভেতর কোনো ছোট্ট কুটিরের বারান্দায় বসে শুনব সেগুন পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার গান।

হাতে থাকবে ধূমায়িত কফির পেয়ালা। সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। মাঝে-মাঝে দুয়েক দিনের জন্য কাপ্তাই গেছি, সেই প্রেম আরও বেড়েছে, তবে স্থায়ী পরিণয়ে রূপ পায়নি। কারণ মানুষের হাতের ছোঁয়ায় কাপ্তাই আরও রূপবতী হয়ে উঠেছে। আমি নিশ্চিত, সেখানে গেলে আপনিও কাপ্তাইয়ের প্রেমে পড়বেন।

চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিলে চন্দ্রঘোনার পর বরইছড়ি পার হলেই আপনাকে স্বাগত জানাবে বনবিভাগের জাতীয় উদ্যান। রাস্তার দুই পাশে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর এলাকা জুড়ে এই উদ্যানে আছে অবকাশযাপন আর বেড়ানোর অনেক উপাদান। ভারত উপমহাদেশে সোয়াশ বছর আগে প্রাকৃতিক বনে প্রথম পরিকল্পিতভাবে যেসব গাছ লাগানো হয়েছিল সেসবেরই কিছু এখনও দেখতে পাবেন কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে। এখানে আছে হরিণ, হাতি, বানর, বনবেড়ালসহ হরেক রকম বুনো প্রাণী। আছে নানা প্রজাতির পাখি।

বনবিভাগ এখানে গড়ে তুলেছে পিকনিক স্পট, রেস্টহাউস। জাতীয় উদ্যানের বাইরে রিভারভিউ পার্ক, গিরিনন্দিনী পিকনিক স্পট এবং প্রশান্তি পিকনিক ও অবসর বিনোদন স্পট। অবকাশের জন্য এই স্পটে আছে দুটি কটেজ, তবে রাতে থাকার ব্যবস্থা নেই। এসবের পাশাপাশি নৌবাহিনী এবং বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থাও পিকনিক স্পট গড়ে তুলেছে। প্যানোরামা ঝুম রেস্তোরাঁ গড়ে তুলেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ।

এখানে গাছের ওপর তৈরি করা পাখির ঘর ‘টুনি’ দেখে শিশুরা আনন্দ পাবে। আরও আছে অবকাশের জন্য কয়েকটি কটেজ। কাপ্তাই গেলে অবশ্যই দেখবেন হ্রদ থেকে কর্ণফুলী নদীতে মালামাল পার করার ছোট্ট ‘রোপওয়ে’। বাঁধ দেওয়ার ফলে হ্রদ থেকে কোনো নৌযানই নদীতে যেতে পারে না। তাই রাস্তার ওপর দিয়ে রোপওয়ের মতো ক্রেনে হ্রদ থেকে ছোট ছোট নৌকা, বাঁশের ভেলা বা কাঠের গুঁড়ি নদীতে নেওয়া হয়।

দেশের একমাত্র পানিবিদ্যুত্ কেন্দ্রটি দেখতে চাইলে আপনাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের অনুমতি নিতে হবে। দু-একজন গেলে হয়তো বিদ্যুেকন্দ্রের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও এ অনুমতি পেতে পারেন। তবে এই বিদ্যুেকন্দ্রের ‘ট্রেডমার্ক’ হিসেবে টাকার ওপর যে স্লুইসগেটের ছবি দেখেন তার ওপর ওঠার অনুমতি পাবেন না। অবশ্য কখনও কখনও বিদ্যুেকন্দ্রের চিফ সিকিউরিটি অফিসারের মন নরম হলে সেই সুযোগও পেয়ে যেতে পারেন। কাপ্তাইয়ের পাশেই চিত্মরমে আছে বৌদ্ধমন্দির।

সেটিও দেখে আসুন। একে তো চট্টগ্রামের খুব কাছে, তার ওপর ছোট্ট একটা উপজেলা শহর। তাই কাপ্তাইয়ে রাতে থাকার জন্য ভালো কোনো হোটেল নেই। তাই থাকতে চাইলে বনবিভাগ, বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থা, বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড, চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী পেপার মিল বা স্থানীয় প্রশাসনের রেস্টহাউসগুলোর কোনো একটিতে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। এজন্য ঢাকা থেকে অনুমতি নিয়ে যাওয়া সবচেয়ে ভালো।

কাপ্তাই যাবেন কীভাবে? ঢাকা থেকে এস আলম, শ্যামলী, মডার্ন ও ডলফিন পরিবহনের বাস সরাসরি কাপ্তাই যায়। ভাড়া নেবে ৪২০ টাকা। আর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট থেকে ১৫ মিনিট পরপর ছেড়ে যায় কাপ্তাইয়ের লোকাল ও বিরতিহীন বাস। শাহ আমানত বিরতিহীন সার্ভিসে ভাড়া নেবে ৫০ টাকা। সময় লাগবে প্রায় দেড় ঘণ্টা।

কাপ্তাইয়ে রাত না কাটিয়ে জেলা শহর রাঙামাটিতেও চলে যেতে পারেন, বিশেষ করে হ্রদের পাড় ঘেঁষে তৈরি হওয়া সড়ক দিয়ে। এ আরেক নয়নাভিরাম রাস্তা। চারদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে কাপ্তাই থেকে এক ঘণ্টায় চলে যাবেন রাঙামাটি। বিশাল কাপ্তাই হ্রদের টলটলে পানি থেকে মাঝেমধ্যেই ভেসে ওঠা ছোট ছোট দ্বীপ-পাহাড় দেখতে দেখতেও রাঙামাটি যেতে পারেন। কাপ্তাই জেটিঘাট থেকে লঞ্চ বা ট্রলারে রাঙামাটি দুই ঘণ্টার পথ।

রাঙামাটি গিয়ে কী দেখবেন? সেকথা অন্য একদিন। প্রকাশ: সকালের খবর, ২৯ জুন, ২০১১ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.