সময়টা সেপ্টেম্বর, প্রচণ্ড গরম। এ সময়ই টেকনাফ বেড়ানোর প্রস্তাব দিলেন দৈনিক সংবাদের চিফ রিপোর্টার সালাম জুবায়ের। নাকের সামনে ঝুলল মিয়ানমারের মংডু ঘুরে আসার মুলা। আমার কাছে গরম আর শীত কী? সঙ্গে সঙ্গে রাজি।
ঢাকা থেকে রাতে রওনা দিয়ে ভোরে পৌঁছে গেলাম কক্সবাজার।
সেখান থেকে পৌনে দুই ঘণ্টায় টেকনাফ। কক্সবাজার-টেকনাফ রাস্তার আসল সৌন্দর্য শুরু টেকনাফ শহরে (যদি শহর বলতে চান) প্রবেশের মুখ থেকে। শহরের প্রায় ১০ কিলোমিটার আগে পথের বাম পাশে সামান্য দূরে আমাদের সমান্তরালে সঙ্গী হল নাফ নদী। রাস্তাও হয়ে ওঠল খানিকটা পাহাড়ি গোছের। আরও কয়েক কিলোমিটার পেরুনোর পর প্রায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রাস্তা আর নদী, আরেক পাশে ছোট পাহাড়-যেন নদী থেকে ওঠে এসেছে পাহাড়।
নদীর অন্য পাড়ে মিয়ানমার। এই পথেই ছোট্ট ‘টেকনাফ স্থলবন্দর’। এক জায়গায় নদীর তীরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের রেস্ট হাউস। আরেকটু এগুলে পাহাড়ের গায়ে পর্যটন করপোরেশনের হোটেল ‘ন্যে ট্যং’। শহরে ঢোকার প্রায় ৫ কিলোমিটার আগে কয়েকটি বেসরকারি জেটিঘাট, এখান থেকে ছেড়ে যায় সেন্ট মার্টিনের জাহাজ।
অসাধারণ সুন্দর এই পথটুকু পেরিয়ে টেকনাফে প্রবেশ করা মাত্রই আপনার মন খারাপ হয়ে যেতে পারে মানুষের কোলাহলে। একটা বাজারকে ঘিরে ছোট্ট একটা বসতি, মানুষ গিজগিজ করছে।
টেকনাফে পৌঁছে উঠলাম মাঝারি মানের এক হোটেলে। বিকেলে রওনা দিলাম শাহ পরীর দ্বীপে। নামে দ্বীপ হলেও এটি আসলে টেকনাফের সঙ্গে যুক্ত পৌর এলাকার বাইরে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের আলাদা একটা অঞ্চল।
এর একদিকে বঙ্গোপসাগর, আরেকদিকে নাফ নদী। গেলাম নাফ নদীর তীরে জেটি ঘাটে, এখানেই বেড়াতে যায় বেশিরভাগ মানুষ। এই জেটিঘাটে শুধু মাছ ধরার ট্রলার আর নৌকাগুলো নোঙর করে থাকে। গোধূলিলগ্নে ডুবন্ত সূর্যের সোনালী রশ্মিতে সোনা রং হয়ে গেছে নদীর পানি। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট জেলে নৌকা এসে ভিড়ছে নদী তীরে এবং দেখা যায় নৌকা ভর্তি মাছ।
ওই দূরে নদীর অপর পাড়ে দিগন্ত রেখায় মিয়ানমার জনপদের সবুজ ছায়া। দক্ষিণপাড়া শাহ পরীর দ্বীপের শেষ বিন্দু, একই সঙ্গে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডেরও শেষ সীমানা।
সালাম জুবায়ের ভাই মংডু যাওয়ার লোভ দেখিয়েছেন। পর দিন সকালে গেলাম বাজারের পাশে নদীর ঘাটে, যেখানে এসে ভিড়ে মিয়ানমার যাওয়া-আসা করার নৌকা। ধারণা ছিল সেখানে গেলেই মিয়ানমার যাওয়ার পাস পেয়ে যাব।
কিন্তু কপাল মন্দ। আসলে এখান থেকে শুধু মিয়ানমার যাওয়ার জন্য এক বছরের ‘বিজনেস পাসপোর্ট’ দেওয়া হয়। এই পাসপোর্টেই মিয়ানমার যাওয়ার অনুমতি দেয় বিজিবি। অর্থাত্ ব্যবসায়ী হিসেবে মিয়ানমার যেতে হয়, তবে মংডু শহরের বাইরে যাওয়া যাবে না। সাধারণত এক দিনের বেশি অবস্থানও করা যাবে না।
এই ‘বিজনেস পাসপোর্ট’ করার জন্য দরকার দুটি দিন, এক দিন কাগজপত্র জমা দিলে পর দিন পাসপোর্ট। আমরা যেমনটি চাই, অর্থাত্ ঘাটে গিয়ে নৌকার টিকেট কাটার মতোই সঙ্গে সঙ্গে পাস, সেটি সম্ভব নয়। অগত্যা মাঠে মারা গেল মংডু যাওয়ার পরিকল্পনা।
তবু নদীর ঘাটে দেখলাম সকালবেলা মিয়ানমার থেকে দল বেঁধে নারী-পুরুষ আসার দৃশ্য। সঙ্গে বিভিন্ন রকম পণ্য।
এরাই আবার বিকেলবেলা বাংলাদেশের পণ্য নিয়ে মিয়ানমার ফিরে যাবে।
এরপর টেকনাফ সাগর-সৈকত। যারা কোলাহল পছন্দ করেন না তাদের জন্য এরচেয়ে আদর্শ সৈকত কমই আছে। আপনার চারপাশে লোকজন প্রায় নেই। অবশ্য ছুটির দিনের বিকেলে আশপাশে অল্প বিস্তর সঙ্গী পাবেন।
টেকনাফে আছে গেম রিজার্ভ। শহর থেকে ১৫ কিলোমিটারের মতো দূরে এর অবস্থান। পাহাড়ি এলাকায় এই গেম রিজার্ভে উপভোগ করবেন নানা রকম পশুপাখির সঙ্গ। ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখবেন বঙ্গোপসাগর।
ও হ্যাঁ, টেকনাফে অবশ্যই দেখবেন মাথিনের কূপ।
থানা কমপ্লেক্সের ভেতরে এই কূপের পাশেই লেখা এর করুণ ইতিহাস, কীভাবে এক ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তার প্রেমে পড়ে শেষ পর্যন্ত এই কূপে আত্মাহুতি দিয়েছিল স্থানীয় এক রাখাইন তরুণী।
যাদের ট্যাকের জোর একটু বেশি তারা নিরিবিলি ও অসাধারণ সুন্দর পরিবেশে থাকার জন্য বেছে নিতে পারেন পর্যটনের ‘ন্যে ট্যং হোটেল’। এখান থেকে পুরো টেকনাফ ঘুরে দেখতে হলে নিজেদের গাড়ি থাকতে হবে অথবা কম টাকায় স্কুটারও ভাড়া করতে পারেন।
প্রকাশ: দৈনিক সকালের খবর, ১৫-০৬-২০১১ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।