আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেখানে যা পড়ে ছিল নেই...

সাপের শরীর হয়ে আঁধারের গাছ/ কুয়াশার বন্যায় ডুবো দেবী মাছ! এক ঝড় বৃষ্টির রাতে আমার প্রথম ভুতের গল্পটা লিখতে বসলাম। গল্প সব ঠিক করায় আছে। আমি শুধু আয়োজন করে বসব। কলম যেদিকে ঘুরতে চায় ঘুরাবো। এইখানে একটু মিথ্যে বললাম, গল্প ঠিক করা থাকলে আমার কলমের উপর নির্ভর করতে হতনা।

আমি জানি আমি একটা ভুতের গল্প লিখব। এটুকুই। শরীরের মধ্যে কেমন জানি করছে। প্রচন্ড পানির পিপাসা। একটু পর পর পাশে রাখা বোতল থেকে এক ঢোক করে পানি খাচ্ছি।

পানি গিলে ফেলার সাথে সাথে গলার ভেতর শুকনা খটখটা হয়ে যায়। কিছুক্ষন চিন্তা করার জন্য চোখ বন্ধ করে আছি। স্পষ্ট ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনলাম। খুব সাবধানে ছাড়া নিঃশ্বাস। আমি হাত বাড়ালাম যে পাশে পানির বোতলটা রাখা।

এবার পানি মুখে নিয়ে থাকব ঠিক করেছি। গলা ভিজিয়ে রাখতে হবে। হাতড়াচ্ছি চোখ বন্ধ রেখেই। বিরক্ত হয়েই চোখ মেললাম। হঠাৎ বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।

আমি চোখে কিছু দেখছিনা। নিশ্চিত হবার জন্যই টুপ করে আবার বন্ধ করে ফেললাম চোখ। হার্টবিট বেড়ে গেছে, বুকের মধ্যে ধ্বক ধ্বক। এখন চোখ মেলে যদি দেখি আমি আসলেই চোখে কিছু দেখছিনা তবে ব্যাপারটা কেমন হবে! হয়ত প্রথম স্টেপ হিসেবে চিৎকার দিয়ে ধাক্কাটা সামলাতে চেষ্টা করব। তাতে লাভ টা কি? চিৎকার দিলেও কেউ শুনবেনা।

আমার স্ত্রী বাসায় নেই। আজ সকালের ট্রেনে সে তার মায়ের বাড়ি গিয়েছে। বাবুকে নিয়ে গেছে। আমার দু'বছর বয়সের পুত্র সন্তান মাকে ছাড়াই দিব্যি থাকতে পারে। আমার স্ত্রী গত দেড় বছর ধরে বেসরকারী একটা কলেজের বাংলার শিক্ষক।

সে সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস নিতে যায়। বাচ্চাটা থাকে কাজের মেয়ের কাছে। মিনু! হুম এই খালি বাসাটায় মিনু থাকলেও হয়ত হত। আমি চিৎকার করে যখন বলব, আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিনা, সে নিশ্চয় পাশের ফ্ল্যাটের সোবহান সাহেব কে ডেকে নিয়ে আসতো। সোবহান সাহেব এমনিতে সামনা সামনি দেখা হলে না দেখতে পাওয়ার ভান ধরে, বিপদের কথা শুনলে নিশ্চয় ছুটে আসবে।

এক হাতে নাকের লোম ছিঁড়বে আর প্রশ্ন করবে,'' কেমন করে হল জাফর সাহেব? কখন থেকে দেখতে পাচ্ছেন না?'' কথা বলার সময় অবধারিত ভাবে মুখ থেকে থুথু ছিটকে আসবে। কেন যেন থলথলে ভুড়ি আর মুখের চেহারাটা এমন যে উনাকে দেখলেই মনে হয় এমনটাই হবে! গত ক'দিন ধরে মিনুর গায়ে নাকি প্রচন্ড জ্বর। সে বাড়ি যেতে চায় বলেই শিরীন অনেক ঝামেলা করে ক'দিনের ছুটি নিয়েছে। আমি এত কিছু খেয়াল রাখতে পারিনা। সারাদিন বসে থাকি চেয়ার টেবিলে।

লিখতে পারি আর না পারি আমি যে লেখক, তা একমুহূর্তের জন্য কাউকে ভুলতে দিই না। মিনু মেয়েটি পাশের ঘরে থাকে বাবুকে নিয়ে। বাবুর টু শব্দটিও এ ঘরে আসা নিষেধ। অন্য এক জগত তৈরী করেছি আমি, এখানে বাস্তবের কিছুর প্রবেশ নিষিদ্ধ। স্ত্রী'র হতাশ চোখ দেখতে আমার ভাল লাগেনা বলে তার কাকচক্ষুর দিকে তাকানো বহুদিন হল বাদ দিয়ে দিয়েছি।

কাক খুবই নিরীহ পাখি। আচ্ছা কাকের কি চোখের পাতা আছে? পাপড়ী নেই নিশ্চয়। থাকতেও পারে। শিরীন ফিরে আসলে জিজ্ঞেস করতে হবে। শিরীন অনেক কিছু জানে।

সব ধরনের বই সে গোগ্রাসে গিলে! সে হিসেবে আমি নিজের লেখা ছাড়া কিছুই পড়তে পারিনা । প্রায় গাধা টাইপের একজন লেখক আমি। বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেছে আমার এখন চোখ মেলা উচিৎ। যদি দেখা যায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা... হুম দেখতে পাচ্ছিতো! বিদ্যুৎ ছিল না নির্ঘাৎ। বাইরে শোঁ শোঁ শব্দ।

বৃষ্টির সাথে বাতাস দিচ্ছে। এক বরষার দিনে শিরীন কে দেখতে গিয়েছিলাম। আমার তখন বিয়ের বয়স হয়নি, চাকরি হয়নি। বন্ধুর সাথে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি,মেয়ে দেখতে তো আর যাচ্ছিনা। তবে বন্ধু মহলের সবার জানা আছে হোঁদলের বোন যাচ্ছে তাই রকমের সুন্দরী।

আমার বেশ ভাল লাগছিল। সন্ধ্যার একটু পরে বাড়িতে পৌঁছুতে পারলাম। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে পারিনি, সারা শরীর ঠক ঠক করে কাঁপছে। এক ধরনের উত্তেজনাও আছে। নতুন জায়গা,নতুন চরিত্র।

ছোট বেলা থেকেই আমার ভেতর এই অদ্ভুত ব্যাপারটা আছে। যা দেখি, সত্য মিথ্যা আরো অনেক কিছু বানিয়ে আমি পরবর্তীতে বন্ধু বান্ধব দের তাক লাগিয়ে দেব, মাথার ভেতর সারাক্ষন গল্প লেখা চলতেই থাকে। এই ঝড় বৃষ্টি জল কাদা সব কিছুকে এক সাথে গুছিয়ে নিচ্ছি মনে মনে। আসার পথে একটা আছাড় খাবার ঘটনাও ঠিক করলাম। হঠাৎ হেরিকেনের আলোয় যে মানবীকে দেখলাম আমি তার চোখ দেখেই একটা দীর্ঘ উপন্যাস লিখে ফেলতে পারব, প্রথম রিফ্লেকশনটা এমন ই ছিল।

পরদিন সারাক্ষন বৃষ্টি। গ্রামের বাড়িগুলোর জানালা খুব ছোট হয়। কেন কে জানে! এক টুকরো একটা জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখার সাধ কি মেটে! আমি প্রচন্ড বিরক্ত। বৃষ্টি দেখি আর মনে মনে চোখের উপমা খুঁজি। সেই চোখ এই দীর্ঘদিন পর হঠাৎ একটা উপমা নিয়ে হাজির হয়েছে! ব্যাপার টা কিন্তু ফেলনা না।

তবে আজ যেহেতু একটা ভুতের গল্প লিখব বলে ঠিক করেছি, সেহেতু আজমিরার কথাটা বলা যেতে পারে। বড় ভাইয়ার মেজ শালী। সুন্দরী শিক্ষিতা বিবাহিত। সুন্দর আর শিক্ষার মত বিবাহ ও একটা গুন। একদিন হঠাৎ শুনলাম মেয়েটাকে ভুতে ধরেছে।

বিভাগীয় শহরে এখনো ভুত গুলো যে ধরার মত কাউকে পেতে পারে সেটাই চিন্তা করা যায়না। আর সত্যি সত্যি ভুতে ধরেছে এমন টা হয় নাকি ধুর! তবে খুব মজার একটা ব্যাপার ঘটলো। যেদিন তাকে দেখতে গেলাম, সে খপ করে আমার হাতটা ধরে ফেলল, যেটা স্বাভাবিক সময়ে প্রায় অসম্ভব ! আমি মজা পেতে শুরু করলাম। এমনিতেই সব কিছুর মধ্যে গল্প খুঁজে বেড়ানো আমার স্বভাব। আমি তো মনে মনে লেখা শুরু করে দিয়েছি।

প্রথম লাইন কেমন হবে তাও ঠিক করে ফেললাম। '' মেয়েটির চোখে আগুন। যখন সে আমার হাত ধরবে বলে ভাবছিল আমি তার উত্তাপ টের পেয়েছি। আর ধরে ফেললো যখন আমি আগুনের আঁচে পুড়ে যেতে লাগলাম। ... গল্পটি নির্ঘাত প্রেমের হবে ।

গল্পটি লেখা হয়নি এখনো আমার। আজ রাতে লিখে ফেললেও হয়! উঁহু আজ একটা ভুতের গল্প লিখব বলে ঠিক করেছি। আজমিরা আমার হাত ধরেছে। আমি ছাড়িয়ে নেবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করিনি। তবু টের পেলাম, তাঁর গায়ে অশুরের শক্তি।

এমন না যে অশুর আমার ছেলেবেলার বন্ধু। যখন তখন হাত ধরত, তাই তার শক্তি সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আসলে একজন আজমিরা নামের সুবক্ষা সুন্দরী তরুনীর গায়ে এত শক্তি থাকতে পারে সেটা আমি কল্পনাও করিনি। যাই হোক, হাত ধরার পরে সে যে কথাটা বললো তা ছিল চূড়ান্ত হাস্যকর। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে ভয়াবহ রকম বিশ্রী মুখ করে সে বলতে থাকলো, '' তুই আমার ছোট বোন কে বিয়ে করবি।

সে তোর জন্য অপেক্ষা করে!'' আমার কানে তখন কিছু ঢুকছেনা, আমি তার মুখের গন্ধে প্রায় পাগল। কতদিন দাঁত মাজেনা আল্লায় জানে! ক'দিন পরেই শুনলাম কোন এক পীর আজমিরার ভুত ছাড়িয়ে দিয়ে গেছে। আমার আর বিন্দুমাত্র আগ্রহ জাগেনি ভূত ছাড়ানোর গল্প শুনতে। রান্নাঘর থেকে খুটখুট আওয়াজ আসছে। গভীর রাত।

বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষন হল। কোথাও কোনো শব্দ নেই! মাঝে মাঝে চিকচিক খুট খুট একটা শব্দ। থেমে থেমে এমন শব্দের একটায় অর্থ হতে পারে, কেউ নিজের উপস্থিতি ক্ষীনস্বরে জানান দিতে চায়। আমি নিশ্চিত সে এ ঘর পর্যন্ত আসবে, তারপর গল্পটা লিখে শেষ করতে পারবো আমি। বোতলের পানি প্রায় শেষ, গলা ভিজিয়ে রাখায় কাজ দিয়েছে,ঘন ঘন আর পানি খেতে হচ্ছেনা।

ভুত টুত গুলো জোছনা পছন্দ করেনা! চারিদিকে যে ঘুটঘুটে অন্ধকার! আজ নিশ্চয়ই অমাবশ্যা! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.