'জীবন' হলো এক কাপ গরম চা আর একটা জ্বলন্ত বেনসনের মতো। গরম চা একসময় জুড়িয়ে যাবে, বেনসনের তামাকও পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। ৩০ জুলাই, রাত ১১.৩০। আরামবাগ সৌদিয়া এস. আলমের কাউন্টার থেকে যখন বাস ছাড়লো, ঢাকায় তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আমার গন্তব্য চট্রগ্রাম শহর।
লাগেজ বক্সে নিজের ব্যাকপ্যাকটা জমা দিয়ে বাসে উঠে টিকেট দেখে বাসের পিছনের দিকে নিজের সিট খুঁজে নিয়ে বসে পড়লাম।
রাতে চলাচলকারী এসি কোচগুলোর নিয়ম অনুযায়ী ভিডিওম্যান এসে ভিডিও করে গেল। এর কিছুক্ষণ পরেই বাস চলতে শুরু করলো, কানে ভেসে এলো সুপারভাইজরের কণ্ঠস্বর "বিসমিল্লাহি মাজরেহা ওয়া মুরসাহা, ইন্না রাব্বি লা গাফুরুর রাহিম। প্রিয় যাত্রীবৃন্দ, সৌদিয়া-এস আলমের পক্ষ থেকে আপনাদেরকে শুভেচ্ছা। এইমাত্র আমরা রাজধানী ঢাকা থেকে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।
বাসটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিধায় এখানে ধূমপান নিষিদ্ধ। ইতিমধ্যেই আপনাদের প্রত্যেকের সিটের সমনে একটি করে পানির বোতল সরবরাহ করা হয়েছে......। "
সুপারভাইজারকে ডেকে একটা ব্ল্যাংকেট চেয়ে নিয়ে আরাম করে চেয়ারটা পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে এমপিথ্রি প্লেয়ারের হেডফোনটা কানে লাগালাম। কিন্তু পরক্ষণেই পিছনের সিটের যাত্রী আমাকে ডেকে আধো বাংলায় বোঝালেন যে, সিট বেশি পিছনে হেলানো যাবেনা, এতে তার সমস্যা হচ্ছে। অগত্যা আগের অবস্থানে সিট নিয়ে এসে গান প্লে করলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, আমার পিছনের যাত্রীটি বিদেশী এবং বাসে আসলে তিনি একাই নন, আরও একজন বিদেশী উঠেছেন এবং দু'জনেই ভারতীয়। বাসে ওঠার পর থেকেই সেই ভারতীয় দুই ভ্রাতা চিৎকার করে বিরামহীনভাবে তাদের নিজেদের মধ্যে হিন্দীতে কথা বলেই যাচ্ছেন। থামার কোন লক্ষণ দেখছিনা। সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যবশত: হিন্দী চ্যানেলগুলোর বদৌলতে সামান্য কিছু হিন্দী শব্দ শিখেছিলাম কোন এককালে। তাদের কথোপকথোন শুনে বুঝলাম, বাসের ভেতরের নিরবতা ভেঙ্গে নিজেদের মধ্যে তারা ব্যবসায়িক আলাপ করছেন।
এর মধ্যে আবার সেই ভারতীয়দের একজন বাসের সুপারভাইজারকে ডেকে এ.সি. বাড়িয়ে দিতে বললো। এমনিতেই শীতে কষ্ট পাচ্ছি, তার উপরে এসি বাড়ালেতো মারাই যাবো। ভাগ্য ভালো, সুপারভাইজার জানালো, এর বেশি এসি বাড়বেনা।
মাথাটা চরম ধরেছে। চোখে ঘুম, কিন্তু ঘুমাতে পারছিনা।
ভারতীয় জনগণের কথার অত্যাচারে আর সবার মতো আমিও অতিষ্ঠিত। কিছুক্ষণ পর বাসের ভিতরের রিডিং লাইটগুলো নিভানো হলো। অন্ধকারের ভেতরেই তারা আরও কিছুক্ষণ কথা চালালেন। তারপর একটা সময় নীরবতা নেমে এলো।
বাসের সাউণ্ড সিস্টেমে বাজতে থাকা পুরনো দিনের বাংলা গানের আবেশে চোখে তন্দ্রার মতো এসেছিল।
হঠাৎ সেটা ভেঙ্গে গেল একটা ধাক্কা খেয়ে। আমার বাম পাশে জানালার কাছে বসা ভদ্রলোক ঘুমের ঘোরে তার বিশালদেহখানি নিয়ে প্রায় আমার উপরেই এসে পড়েছেন। শুরু থেকেই দেখছিলাম তিনি মুখ হা করে বিকট স্বরে নাক ডাকছেন। কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। আবার কিছুক্ষণ গান শোনার চেষ্টা করলাম।
ছোট বেলায় যে কথাটা শিখেছিলাম, "অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়"। আসলেই মনে হয় শান্তি নাই কোথাও। কারণ এইবার শুরু হলো মোবাইল ফোনের অত্যাচার। না, না, আমার ফোন নয়। আমার ডান দিকের রো-তে যে যাত্রী বসেছেন, সেই চল্লিশোর্ধ ভদ্র মহিলার ফোন।
ফোনে তার অপর প্রান্তের ব্যাক্তির সাথে কথোপকথোনটা অনেকটা এরকম "...কাশেম আসলে ওকে পঞ্চাশ লাখ টাকার চেকটা দিয়ে দিও। আর শোন, আমাদের গুলশানের বাড়ির ভাড়াটা ব্যাংকে মনে করে জমা দিয়ে দিও। ...আর হ্যাঁ শোন, লণ্ডন থেকে ফিরেই আমি আসিফের সাথে রুচির বিয়েটা দিয়ে দিতে চাই ... ওরা অ্যামেরিকাতেই সেটল হোক - এমনটাই আমার ইচ্ছা। ...." ভদ্রমহিলার গেটআপ দেখে মনে হলো, বেশ অবস্থাপন্ন। কিন্তু বাসের ভেতরে উচ্চস্বরে কথা বলা মানে সবাই শুনতে পাওয়া।
এসব কথা যাকেই তিনি বললেন, এখনই কেন তাকে সেই কথাগুলো বলতে হবে, সেটা আমার বোধগম্য হলোনা।
বেশ স্পীডে বাস চলছে। দুলুনিতে আবার ঘুম আসলো। রাত তিনটার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় হাই ওয়ের একটা রেস্টুরেন্টে বিরতির জন্যে বাস থামলো। প্রায় ত্রিশ মিনিট বিরতির পর আবার আমাদের পথ চলা শুরু হলো।
শুরু থেকেই চারিদিকের মোবাইল ফোনের যন্ত্রণায় আমি অস্থির। ক্রমাগত একটা না একটার রিং টোন বেজেই চলেছে। আর সেই মোবাইল ব্যবহারকারীরাও নিজেদের বাড়ি-ঘর মনে করে উচ্চ স্বরে এক মনে কথা বলে চলেছেন। না চাইলেও তাদের সেইসব প্রাইভেট কথা-বার্তা কানে পৌঁছাচ্ছে। এক ভদ্রলোকতো তার ফোনে অপরপ্রান্তের ব্যাক্তিকে রীতিমতো হুমকি দিচ্ছেন।
তার কথাবার্তার ধরণ অনেকটা এরকম "অই তুই পাইছস কি? আমারে চিনস তুই? টেকাকি তোর বাপেরনি রে? দশ লাখ লইছস, অখনে টেকা ফেরতের নাম নাই। কান খুইলা শুইনা রাখ, কাইলকা সকালের মইধ্যে টেকা না দিলে তোরে মির্জারপুলে গাইড়া ফেলামু...."।
এই সব কথাবার্তায় বাসে হালকা একটু ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হলো। আমার বাম পাশের যাত্রীর দেখি ঘুম ভেঙ্গেছে। তিনি বিরক্ত স্বরে সেই 'হুমকি দেওয়া' ভদ্রলোককে বললেন, " ভাই, কি শুরু করছেন? মোবাইলে এরাম চিৎকার করতাছেন ক্যান? একটু ঘুমাইছিলাম, আপনের চিল্লানির জ্বালায় শান্তি মতোন ঘুমাইবারও পারুমনা....।
" এই কথা শুনে সেই 'হুমকি' ভদ্রলোক আমার পাশের লোকটিকে কড়া ধমক দিয়ে বললেন, "ওই মিয়া বেশি তাফালিং কইরেন না, বাস কি আপনের নি? টেকা দিয়া আপনেও চড়ছেন, আমিও চড়ছি.... আমার যা মুনে চায় করুম। কি করবেন, করেন দেহি...ফাউল পাবলিক কুনহানকার...!"
বাসের ভেতরে টান টান উত্তেজনার সৃষ্টি হলো। আরেকটু হলো দুইজনের মারামারি লেগে যায় - এমন অবস্থা। সুপারভাইজার দৌড় দিয়ে দুইজনকে ঠেকাতে এলো। কিন্তু দুইজন 'ডুয়েল ফাইটের' মতো চরম গালাগালি আর হাতাহাতি ফাইট করতে শুরু করলো।
অগত্যা বাস থামিয়ে ড্রাইভার এলেন এবং স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন, বাসের নিয়মকানুন ভাঙলে এই বাস নিয়ে তিনি আর আগাবেননা। কিছু মানুষ তাকে সমর্থন করলো। আর কিছু মানুষ বললো, "ওই মিয়া, যাইবেন না মানে? টেকা দিয়া টিকিট কাটছি, তাড়াতাড়ি ইস্টাট লন...। "
বেশ কিছুক্ষণ পর পরিবেশ শান্ত হলো। বাস আবার চলা শুরু করলো।
ক্লান্ত-বিধ্বস্ত শরীরে আজকে সকালে যখন দামপাড়া মোড়ে এসে সকাল সাড়ে সাতটায় নামলাম, দেখি মুষুলধারে বৃষ্টি। একটা সিএনজি, রিক্সা - কিছুই নেই। উপায় না দেখে হেঁটেই রওনা দিলাম মুরাদপুরের উদ্দেশ্যে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।