আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিরাজ সিকদার হত্যা মামলার বিবরণী

আমার দেশ আমার মা, নাইজেরিয়া হবেনা ৪ জুন ১৯৯২ সালে সিরাজ সিকদারকে হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও মোহাম্মদ নাসিমসহ সাতজনকে আসামি করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে এই মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলেন : ১. সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ২. আবদুর রাজ্জাক এমপি, ৩. তোফায়েল আহমেদ এমপি, ৪. সাবেক আইজিপি ই এ চৌধুরী, ৫. সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান, ৭. মোহাম্মদ নাসিম এমপি গং। আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২ ও ১০৯ নম্বর ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। আর্জিতে বলা হয়, আসামিরা মরহুম শেখ মুজিবের সহচর ও অধীনস্থ কর্মী থেকে শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও গোপন শলা-পরামর্শে অংশগ্রহণ করতেন এবং ১ নং থেকে ৬ নং আসামি তৎকালীন সময়ে সরকারের উচ্চপদে থেকে অন্য ঘনিষ্ঠ সহচরদের সঙ্গে শেখ মুজিবের সিরাজ সিকদার হত্যার নীলনকশায় অংশগ্রহণ করেন।

তাঁরা এ লক্ষ্যে সর্বহারা পার্টির বিভিন্ন কর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হয়রানি করতে থাকেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার ও হত্যার বিবরণ দিয়ে আর্জিতে বলা হয়, মরহুম শেখ মুজিব ও উলি্লখিত আসামিরা তাঁদের অন্য সহযোগীদের সাহচর্যে সর্বহারা পার্টির মধ্যে সরকারের চর নিয়োগ করেন। এদের মধ্যে ই এ চৌধুরীর একজন নিকটাত্মীয়কেও চর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এভাবে ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে অন্য একজনসহ সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার করে ওই দিনই বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরে নামিয়ে বিশেষ গাড়িতে করে বন্দিদের পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মালিবাগস্থ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানে সিরাজ সিকদারকে আলাদা করে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের অনুগত সদস্যরা গণভবনে মরহুম শেখ মুজিবের কাছে সিরাজ সিকদারকে হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখানে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলীসহ আসামিরা, শেখ মুজিবের পুত্র মরহুম শেখ কামাল এবং ভাগ্নে মরহুম শেখ মনি উপস্থিত ছিলেন। আর্জিতে আরো বলা হয়, প্রথম দর্শনেই শেখ মুজিব সিরাজ সিকদারকে গালিগালাজ শুরু করেন। সিরাজ এর প্রতিবাদ করলে শেখ মুজিবসহ উপস্থিত সবাই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।

সিরাজ সে অবস্থায়ও শেখ মুজিবের পুত্র কর্তৃক সাধিত ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপকর্ম, ভারতীয় সেবাদাসত্ব না করার, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শেখ মুজিবের কাছে দাবি জানালে শেখ মুজিব আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। সে সময় ১ নং আসামি মাহবুব উদ্দিন তাঁর রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। ওই সময় সব আসামি শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলেন। এর পর শেখ মুজিব, মনসুর আলী এবং ২ থেকে ৭ নং আসামি সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১ নং আসামিকে নির্দেশ দেন।

১ নং আসামি মাহবুব উদ্দিন আহমদ আসামিদের সঙ্গে বন্দি সিরাজ সিকদারকে শেরে বাংলানগর রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যান। এর পর তাঁর ওপর আরো নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ২ জানুয়ারি আসামিদের উপস্থিতিতে রাত ১১টার দিকে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ১ নং আসামির সঙ্গে বিশেষ স্কোয়াডের সদস্যরা পূর্বপরিকল্পনা মতো বন্দি অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায় এবং সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে। সিরাজ সিকদারের অদম্য দেশপ্রেম তাঁকে ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত সর্বহারা পার্টিকে শুধু জনপ্রিয়ই করেনি, জনভিত্তিও দিয়েছে রইসউদ্দিন আরিফ সর্বহারা পার্টির বরিশাল অঞ্চলের সাবেক সম্পাদক বামপন্থী প্রবীণ রাজনীতিক ও দল থাকার পরও রোমান্টিক বিপ্লবী চরিত্রের কারণেই কি সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা পার্টি কিছুদিনের মধ্যে দেশব্যাপী একটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়? না, বিষয়টি একদমই সে রকম নয়।

আপনি যদি লক্ষ করেন, তাহলে দেখবেন যে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে সর্বহারা পার্টির যে ভ্রূণ সংগঠন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন, সেই শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস দেখুন। সেখানে সিরাজ সিকদারের প্রজ্ঞা সম্পর্কে অবহিত হবেন। সে থিসিসে তিনি সেই ১৯৬৮ সালেই বলে দিয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব বাংলার সম্পর্ক হলো ঔপনিবেশিক। তাঁকে রোমান্টিক বিপ্লবী হিসেবে চিহ্নিত করে বরং কথিত কমিউনিস্ট ও শাসক শ্রেণী বেঁচে যায়। যদি সিরাজ সিকদারের চিন্তার প্রসার ঘটে, তাহলে ওপরের দুই শক্তিই বিপদে পড়বে।

সিরাজ সিকদারের অদম্য দেশপ্রেম তাঁকে ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত সর্বহারা পার্টিকে শুধু জনপ্রিয়ই করেনি, জনভিত্তিও দিয়েছে। ওই সময় মাত্র ২৮ বছরের একজন তরুণ বড় বড় কমিউনিস্ট নেতাকে ছাড়িয়ে গিয়ে শেখ মুজিবের বিপরীতে একজন কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রধান কারণ ছিল জাতীয় ও শ্রেণী সংগ্রামের বিষয়টি তিনি ধরতে পেরেছিলেন, যা অন্য কমিউনিস্ট নেতারা পারেননি। এখানে মূলত কাজ করেছে দেশপ্রেম, জাতীয় চেতনা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিষয়টি। আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে আপনারা ব্যাংক ডাকাতি করেছেন। এর মধ্য দিয়ে কি বিপ্লবী তৎপরতা বাড়ানো সম্ভব? বিপ্লবী রাজনীতি কোনো সুচিকর্ম নয়।

এটা উগ্র, বল প্রয়োগের ব্যাপার। সেই বল প্রয়োগের সঙ্গে নানা ধরনের আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে। সে প্রয়োজন থেকেই ব্যাংক লুট করা হয়েছে। একটা নিছক ডাকাতি আর বিপ্লবী রাজনীতির প্রয়োজনে ব্যাংক লুটের মধ্যে নিশ্চয় পার্থক্য রয়েছে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীরাও ব্যাংক লুট করেছেন।

আপনারা শ্রেণীশত্রু খতমের নামে প্রতিবিপ্লবের কাজ করেছেন। আমরা কোনো শ্রেণীশত্রু খতম করিনি। আমরা করেছি জাতীয় শত্রু খতম। জাতীয় মুক্তির সময়, আপনাকে তো জাতীয় শত্রুকে মোকাবিলা করতে হবে। শ্রেণীশত্রু খতম করতেন হক-তোহারা।

ব্যক্তিগত খতমের যে কর্মসূচি তা বিপ্লবী রাজনীতি নয়। তাহলে এটা কি প্রতিবিপ্লবী, প্রতিক্রিয়াশীল? আমি বলব, তাও না। আমরা পাঁচজন খতম হয়েছি, তার বিপরীতে আমরা হয়তো একজনকে খতম করেছি। এটা ছিল রাষ্ট্রের চরম নিপীড়নের বিপরীতে পাল্টা খতম। আমাদের হাজার হাজার কমরেডকে মুজিব আমলে হত্যা করা হয়েছে।

নারী কমরেডদের ওপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। সেসব খুনের তথ্য প্রকাশ হলে জাতি শিউরে উঠবে। এ খতম কিন্তু আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালের যুদ্ধ থেকে আমাদের বিরুদ্ধে শুরু করেছে। সর্বহারা পার্টির পাঁচ সদস্য পার্টির নির্দেশে আগস্ট মাসের দিকে সাভারে যায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকে। এ সময় এ পাঁচজনকেই সেখানে বৈঠকের নামে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়।

এ পাঁচ নেতার মধ্যে ছিলেন সামিউল আজমি (যিনি পতাকার নকশা করেছিলেন। পার্টিতে যাঁর নাম ছিল কমরেড তাহের) ও পলাশ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে লড়াই চলছিল সেখানে সর্বহারা পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের প্রস্তাব নিয়ে সাভারে যাওয়ার পর তাঁদের হত্যা করা হয়। সাভারের ঘেষু চেয়ারম্যানের বাড়িতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কমরেড শিখা, ঝালকাঠিতে ভাস্কর পণ্ডিতের হত্যাকাণ্ডগুলো ছিল লোমহর্ষক।

সর্বহারা পার্টি ১৯৭১ সালের যুদ্ধপরবর্তী সময় যেসব খতম করেছে, তা বাধ্য হয়েই করেছে। কারণ কোনো জায়গায় সর্বহারা পার্টির তিনজনকে হত্যা করলে পার্টি বাধ্য হয়েই সেখানে হয়তো একটা খতম করেছে। এ খুন হলো শাসক শ্রেণীর খুনের পাল্টা-খতম। সর্বহারা পার্টির যত সদস্য নিহত হয়েছেন তার দশ ভাগের এক ভাগও সর্বহারা পার্টি খতম করেনি। ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কিভাবে পালন করলেন? শুধু ১৯৭৪ সালে নয়, ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বরও দেশব্যাপী হরতাল পালন করা হয়েছিল।

এ হরতাল পালনের চমৎকার রাজনৈতিক তাৎপর্যও ছিল। আমরা একটা ব্রিজ উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম, তবে আমাদের ভুলের জন্য ব্রিজটি ওড়ানো যায়নি। তখন মাথায় এল, গাছ কেটে রাস্তা ব্লক করা যায়। সেদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমরা, পার্টি সদস্যরা, গাছ কাটতে শুরু করলাম। গ্রামের লোকজন এসে আমাদের বলল, এ গাছ আপনারা কেন কাটেন? আমরা বললাম, আগামীকালের হরতালের কারণে রাস্তা ব্লক করি।

তখন গ্রামের মানুষজন আমাদের হাত থেকে কুড়াল নিয়ে লেগে গেল গাছ কাটতে। এভাবে শত শত গ্রামবাসী গাছ কাটা শুরু করল। এখন যেটা ফরিদপুর থেকে যশোর রোড, কানাইপুর থেকে কামারখালী। এখানে গ্রামবাসী বড় রেইনট্রি কেটে রাস্তা ব্লক করে দিয়েছিল। সে রাস্তা পরিষ্কার করতে সরকারের ১২ দিন লেগেছিল।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : আরিফুজ্জামান তুহিন  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.