অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি
আগের পর্ব
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন গোষ্ঠীর অবস্থান ও তৎপরতা যথাযথ মূল্যায়ন পায়নি। এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিপিকারদেরও দেখা গেছে গা বাচিয়ে চলতে। প্রথাগত লাইনের বাইরে তারা হাটেননি। যে কারণে বিভিন্ন ইতিহাস বইয়ে সিরাজ শিকদার ও তার বাহিনীর জন্য দুই লাইনের বেশী বরাদ্দ হয় না। লেখা হয় : এ ছাড়া সিরাজ শিকদার ও তার বাহিনী পেয়ারা বাগান অঞ্চলে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
একটা কারণ হতে পারে স্বাধীনতার পরও তা মানতে সিরাজের অস্বীকৃতি। দেশের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিজয় দিবসে হরতাল আহবান কিংবা মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে অন্য পিকিংপন্থী কম্যুনিস্টদের আদলেই তার অবস্থান। নির্দিষ্ট করে বললে অক্টোবরে সিরাজ শিকদার নতুন থিসিস দেন এবং আহবান জানান আওয়ামী লীগ, ভারতীয় বাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুগপত লড়াই চালাতে। তার দলের আক্রমণের শিকার হন মুক্তিযোদ্ধারাও।
কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টির (এম-এল) তোয়াহা, হক, মতিনদের এই লাইন কিন্তু সিরাজ শুরুতে একদমই নেননি।
বরং EBWM-এর প্রথম থিসিসে শেখ মুজিবর রহমানকে কৌশলগত মিত্র হিসেবে উল্লেখ করে তাকে সহায়তা করার সিদ্ধান্তই ছিলো তার। ১ মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যথন সংসদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেন, উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা বাংলা। পরদিন ২ মার্চ EBWM-এর এক ইশতেহারে শেখ মুজিবকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার আহবান জানান সিরাজ শিকদার। সেখানে সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অস্থায়ী বিপ্লবী জোট সরকার গঠন এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিষদ গঠনের অনুরোধ ছিলো। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য সেদিনের পত্রপত্রিকায় গোলাম আযম থেকে শুরু করে সবুর খানসহ শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সব রাজনৈতিক নেতাই ইয়াহিয়াকে অনুরোধ জানান মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে।
কিন্তু সিরাজ বুঝেছিলেন যুদ্ধ ভিন্ন পথ নেই। মুজিব প্রত্যাখ্যান করলেন তার প্রস্তাব।
এ ক্ষেত্রে এটাও মনে রাখতে হবে সিরাজ শিকদার তখনও মুজিবের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো রাজনীতিক নন। তার দলও নয়। ৭০ এর সময়কালে আওয়ামী লীগের বেশ কজন উচ্চপর্যায়ের নেতা এবং নির্বাচিত সাংসদ হত্যার জন্য মুজিব খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন চীনাপন্থী কমিউনিস্টদের ওপর।
'৭১এর জানুয়ারিতে মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেও বসেন : এরপর আমার একজন লোক মরবে, আমি ওদের তিনজনকে মারবো। তাছাড়া ভিয়েতনাম স্টাইলে গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনাটাও পছন্দ ছিলো না তার। ১৯৭০ সালের জুনেই তিনি পরিষ্কার করে দেন তার মনোভাব যার উল্লেখ রয়েছে মার্কিন দুতাবাস থেকে পাঠানো টেলিগ্রামে। মুজিবের উদ্ধৃতি দিয়ে সেখানে লেখা হয় : If the army, civil service, and "vested interest" continued to play this game, threatened Mujib, "I will proclaim independence and call for guerilla action if the army tries to stop me. It is primarily fear of communist exploitation a Vietnam type situation which has kept me patient this long. " (Source: The American Papers- Secret and Confidential India.Pakistan.Bangladesh Documents 1965-1973, The University Press Limited, p.367)
অবশ্য বাংলাদেশের পক্ষে এমনিতেও ভিয়েতনাম হওয়া সম্ভব ছিলো না। The scope of Pakistan Army’s military problem can be seen in comparison of Vietnam. There a million man South Vietnamese army plus American troops and massive fire-power must try to control a population of 17 million, many basically sympathetic to the Government. Here only 60,000 West Pakistani troops are trying to control a thoroughly hostile population of 75 million. East Pakistan, moreover, is surrounded on three sides by India, which is giving sanctuaries and supplies to the guerrillas. The Pakistan army’s supply routes from West Pakistan to the East must circumvent by sea and air, 1200 miles of India. Of course, the Mukti Bahini is not Viet-Cong. For one thing the guerrillas are not communists. For another they are not-or not yet-very effective fighters. They have been at it for less than four months. The Wall Street Journal, July 27, ’71.
সিরাজের এই সহযোগী মনোভাব অবশ্য আগস্ট পর্যন্ত ছিলো।
সে মাসের শুরুতে তার ডান হাত সাইফুল্লাহ আজমীসহ ৫জন যোদ্ধাকে সাভারে পাঠিয়েছিলেন মুজিব বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতায় আসতে। কিন্তু তাদের উল্টো হত্যা করা হয়। এ ঘটনাই পুরোপুরি বিগড়ে দেয় সিরাজকে। অবশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্টের সময়ই ভারতীয় সরকারের বিশেষ নির্দেশে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক থাকতে হয়েছে কম্যুনিস্ট অনুপ্রবেশের ব্যাপারে। মঈদুল হাসান তার মূলধারা ৭১ বইয়ে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন : তরুণদের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যাপারে অবশ্য ভারতীয় প্রশাসনের সকল অংশের সমান উৎসাহ ছিল না।
যেমন ট্রেনিং প্রদান এবং বিশেষত ‘এই সব বিদ্রোহী ও বামপন্হীদের’ হাতে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের আপত্তি প্রথম দিকে ছিল অতিশয় প্রবল। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, নক্সালবাদী, নাগা, মিজো প্রভৃতি সশস্ত্র বিদ্রোহীদের তৎপরতা-হেতু পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা সম্পর্কে এদের উদ্বেগ। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত অস্ত্র এই সব সন্ত্রাসবাদী বা বিদ্রোহীদের হাতে যে পৌঁছবে না, এ নিশ্চয়তাবোধ গড়ে তুলতে বেশ কিছু সময় লাগে। মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং-এর ব্যাপারে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাতে এই নিশ্চয়তাবোধ ক্রমে গড়ে ওঠে। প্রথম দিকে রিক্রুটিং সীমাবদ্ধ ছিল কেবল আওয়ামী লীগ দলীয় যুবকদের মধ্যে।
পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে এ ব্যবস্হা ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীরও মনঃপূত। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে আগ্রহীদের বিরাট সংখ্যার অনুপাতে ট্রেনিং-এর সুযোগ ছিল নিতান্ত কম। ট্রেনিং-এর আগে পর্যন্ত তরুণদের একত্রিত রাখা এবং তাদের মনোবল ও দৈহিক সুস্হতা বজায় রাখার জন্য সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ‘যুব শিবির’ ও ‘অভ্যর্থনা শিবির’ স্হাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সব শিবিরে ভর্তি করার জন্য যে স্ক্রীনিং পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, তদনুযায়ী ‘বহির্দেশীয় আনুগত্য’ (Extra Territorial Loyalty) থেকে যারা মুক্ত, কেবল সে সব তরুণরাই আওয়ামী পরিষদ সদস্যদের দ্বারা সনাক্তকৃত হবার পর ভর্তির অনুমতি পেত। পাকিস্তানী রাজনৈতিক পুলিশের এই বহুল ব্যবহৃত শব্দ ধার করে এমন ব্যবস্হা খাড়া করা হয় যাতে এই সব শিবিরে বামপন্হী কর্মীদের প্রবেশের কোন সুযোগ না ঘটে।
"
যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধকারীদের অন্যতম ছিলেন সিরাজ শিকদার ও তার দল। বরিশালের বানারিপাড়া অঞ্চলে অবস্থান নেয় EBWM, ৩০ এপ্রিল গঠন করে জাতীয় মুক্তিবাহিনী যা দখলমুক্ত করে পেয়ারাবাগানের খানিকটা। এই মুক্তিবাহিনী পরিচালনা করতে সিরাজ শিকদারকে প্রধান করে সর্বোচ্চ সামরিক পরিচালনামন্ডলী গঠন করা হয়। ৩ জুন ১৯৭১, পেয়ারা বাগান যুদ্ধক্ষেত্রেই EBWM নতুন নাম নেয় পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি। সিরাজ শিকদার এর আহবায়ক নির্বাচিত হন।
তবে জুনের মাঝামাঝি পাকিস্তানী আক্রমণ প্রবল হওয়ায় সর্বহারা পার্টি পেয়ারা বাগান থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। (সূত্র : স্ফুলিঙ্গ, বিশেষ সংখ্যা মে ১৯৮১, পৃ: ৭১-৮৫)
যুদ্ধক্ষেত্রে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন সিরাজ। কেউ তাকে চিনতো সালাম নামে, কেউবা মতি মিয়া। বানারিপাড়া অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধকারী বেণীগ্রুপের অধিনায়কসহ অনেকের মু্খেই সাক্ষ্য মিলেছে এর। মুক্তিযুদ্ধের মৌখিক ইতিহাসের রেকর্ড ঘেটে এমনি কয়েকজনের সাক্ষাতকার থেকে কিছু অংশ তুলে দেওয়া হলো :
বর্তমানে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত মুজিবল হক মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭-১৮ বছর বয়সী ছাত্র।
তার বক্তব্য ছিল :
প্র: আপনি বলছিলেন যে, ‘পূর্ববাংলা সর্বহারা’ নামে পরিচিত একটি দল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতেছিল। এই দলটিতে কারা নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং তাদের কার্যক্রম কি রকমের ছিল?
উ: প্রথম অবস্থায় যখন মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ সব জায়গায় গঠিত হয়নি, সেই সময় কুরিয়ানায় এবং পরে আলতা, ভিমরুলি এলাকায় ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’ সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন যে দল সেই দলের ক্যাম্প ছিল আতা স্কুলের পিছনে। আমি সেখানে তাদের সাথে লিয়াজো করার জন্য কয়েকবার গিয়েছিলাম বানারীপড়া থানা এটাক করার জন্য। কেননা তখন বানারীপাড়া থানায় অনেক অস্ত্র ছিল। বানারীপাড়া থানায় একটা শক্ত ঘাঁটি ছিল পাক আর্মির।
আমাদের হাতে অস্ত্র কম ছিল, সেই জন্যে তাদের শরণাপন্ন হলাম। তারা আর আমরা একত্র হয়ে বানারীপাড়া থানা কয়েকবার আক্রমণ করেছিলাম। তারা স্বাধীনতার পক্ষেই কাজ করেছিল। পরবর্তীতে কি হয়েছে আমি জানি না। তবে ঐ সময় প্রথম দিকে তারা পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে।
তখন সেই দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা ছিল সেলিম শাহনাজ। সেলিম শাহনাজ তার বাড়ি সম্ভবত ঝালকাঠিতে। তিনি ছিলেন স্থানীয় নেতা। ওখানে একবর সিরাজ সিকদার সাহেবও এসেছিলেন। আমরা তখন পাঞ্জাবি মিলিটারি সহ একটা স্পিডবোট গুলি করে দখল করেছিলাম।
সেই সময় দশ এগারো জন পাক আর্মিকে হত্যা করা হয়। সেই স্পিডবোটে সেলিম শাহনাজ সাহেব অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিলেন। আমি তখন ওখানে ছিলাম।
১৯ বছর বয়সী শোভারাণী মন্ডল এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন, সদ্য বিধবা হয়েছেন। তার কাছে জানা যায় আরো বিস্তারিত :
প্র: আপনি কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন ?
উ: আমার স্বামীকে পাক বাহিনী মেরে ফেলেছে সেই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য।
প্র: আপনি কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে এলেন ?
উ: সিরাজ শিকদার এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলো। সেই আমাকে ট্রেনিং দিয়েছে। সেই আমাকে বুঝাইয়া শুনাইয়া মুক্তিবাহিনীতে নেয়। আমাদের এই বাড়ির পাশের একটা বাড়িতে তারা থাকতো। সেখানে সে ছেলেমেয়েদের ট্রেনিং দিতো এবং বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করতে পাঠাইতো।
প্র: আপনি বলছিলেন যে, একটি বাড়িতে সিরাজ শিকদার আপনাকে ট্রেনিং দিতো। বাড়িটি ঠিক কোথায় এবং বাড়িটির নাম মনে পড়ছে কি ?
উ: এই বাড়িটি আতা গ্রামে। সম্ভবত মিস্ত্রী বাড়ি বলা হতো। এর চতুরপাশে পেয়ারা বাগান, মাঝখানে এই বাড়িটি।
প্র: এখানে আপনারা প্রথম কতজন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিয়েছিলেন ?
উ: বাইশ জন একত্রে।
প্র: ঐ সময়কার আর অন্য কারো নাম মনে পড়ছে কি ?
উ: একজন মনিকা, তারপরে আরো ৪/৫ জনের নাম আমার মনে আসছে, কিন্তু তারা বেঁচে নেই। একজন ছিলো সুনীল, বাড়ি আতা। বাকি নামগুলো মনে পড়তেছে না।
প্র: আপনারা ওখানে এই বাইশ জনের মধ্যে কতজন পুরুষ এবং কতজন মহিলা ছিলেন ?
উ: ১৮ জন পুরুষ এবং ৪ জন মহিলা।
প্র: এরপরে আপনি কিভাবে যুদ্ধে অংশ নিলেন ?
উ: প্রশিক্ষণের পরে যখন আমরা খবর পেতাম যে আর্মি আসছে তৎক্ষণাৎ আমরা সেখানে গিয়া ঝোপঝাড়ের ভিতরে, রাস্তার ধারে, গাছের আড়ালে বা পেয়ারা বাগান থেকে তাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করতাম।
প্র: আপনি কোথায় কোথায় পাক বাহিনীর সাথে লড়াই করেছেন ? সেখানে আপনাদের কি ফলাফল হয়েছিলো ?
উ: প্রথম পাক বাহিনীর ওপর আক্রমণ করা হয় কুরিয়ানা গ্রামের একটু নামায়। একটা স্পীডবোটে ৪ জন পাক বাহিনী আসছিলো একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। মেয়েটিকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পথে আমি গ্রেনেড নিক্ষেপ করি সেই স্পীটবোটের উপরে। তখন বোটটা ডুবে যায়। আরো লোকজন আমার সাথে ছিলো, তারা ওদের ধরে ফেলে এবং বেয়নেট দিয়া কইচ্চা [কেটে] নদীতে ফালাইয়া দেয়।
প্র: পাক বাহিনীর ৪ জনকে হত্যার পরে আপনি আর কোথায় কোথায় গেলেন?
উ: তারপরে গরাঙ্গলে আক্রমণ করেছি। গরাঙ্গলে যে আক্রমণ করেছি সেখানে একটা ছোট লঞ্চে পাক বাহিনী যাইতেছিলো। সেটা আক্রমণ করার পরে পিছন থেকে তিনখানা গানবোট আসায় আমরা পিছাইয়া যাই। কিন্তু তখন যে কয়জন মারা গেছে তা আমি বলতে পারবো না। তবে মারা গেছে।
লঞ্চ থেকে যে রক্ত ঝরছে সেটা আমরা দেখছি।
প্র: আপনি যে দু’টো মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপে অংশগ্রহণ করেছিলেন সেই দু’টো গ্রুপের উচ্চ পর্যায়ে অর্থাৎ লিডিং পর্যায়ে কারা ছিলেন ?
উ: শেষের গ্রুপটায় লিডিং পর্যায়ে ছিলেন বেণীলাল দাশগুপ্ত। আর প্রথম পর্যায়ের লিডিং ম্যান ছিলেন সালাম ভাই ওরফে সিরাজ শিকদার। সেই ছিলো প্রথম ম্যান। দ্বিতীয় ম্যান ছিলো মজিবুল হক, তৃতীয় ম্যান ছিলো ফিরোজ কবির।
কবিতা লেখে যে হুমায়ুন কবির তারই ভাই ফিরোজ কবির। আর কারো কথা আমার তেমন মনে নাই।
২২ বছর বয়সী শ্রমিক ফরহাদের ভাষ্য :
প্র: আপনি বলছিলেন যে, থানার অস্ত্রগুলো একটি পার্টি নিয়ে গেছে? এই পার্টি কি স্বাধীনতার পক্ষে ছিল? না বিপক্ষে ছিল?
উ: স্বাধীনতার পক্ষের পার্টি ছিল। কমরেড সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’ তাদের নেতৃত্বে সেই অস্ত্রগুলো নেওয়া হয়েছিল। তারা দেশের মাটিতে থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করার অঙ্গীকার করেছিল।
তাদের ঘাঁটি ছিল কুরিয়ার পেয়ারা বাগানে।
২৯ বছর বয়সী শিক্ষক বেনীলাল দাশগুপ্ত বানারিপাড়া অঞ্চলে বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে খ্যাতিমান। তারও অভিজ্ঞতা হয়েছে সিরাজ শিকদারের সঙ্গে লড়াইয়ের :
সিরাজ সিকদার তখন এই এলাকায় মতি নামে পরিচিত। সিরাজ সিকদার,সেলিম শাহনেওয়াজ এখন সব বেঁচে নেই। নিজেদের দ্বন্দ্বে ওদের মরতে হয়েছিলো স্বাধীনতা পরবর্তীকালে।
তাদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মিলে আমরা বানারিপাড়া থানা আক্রমণ করেছিলাম। সেদিন আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো বানারিপাড়া থানা আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ওখানে পিস কমিটির মিটিং-য়ে আমরা হানা দেবো। তখন থানার পাশে সাহা বাড়িতে পিস কমিটির মিটিং হচ্ছিলো। কিন্তু এই কথাগুলি কেমন করে যেন ফাঁস হয়ে যায়। আমরা এখনও জানি না এই রহস্যটা।
আমরা যখন থানা আক্রমণ করলাম তখন থানা থেকে আমাদের লক্ষ্য করে প্রতি আক্রমণ করলো। আমাদের অস্ত্র যেহেতু তাদের মতো ছিলো না,এমুনিশন খুব কম ছিলো,তাই আমরা সেখান থেকে রিট্রিট করি। এই আক্রমণে দুইজন পুলিশ মারা যায়। আমার অসিত্বকে সেদিনই ওরা ধরতে পারলো। তারা জানলো যে আমি একটা বিরাট দল নিয়া এখানে একটিভ।
ঐ রাতেই আমরা আমাদের ক্যাম্প থেকে যে ক্যাম্পটি বুড়ির বাড়ির ক্যাম্প বলে পরিচিত ছিলো সেই ক্যাম্প থেকে স্পীডবোটে সিরাজ সিকদারের কাছে চলে যাই আটঘর কুরিয়ানায় নিরাপদ অঞ্চলে। আমরা জানতাম যে,আমাদের ক্যাম্প আক্রান্ত হবে কালকেই। তখন আমার দলের একটা গোয়েন্দা গ্রুপ ছিলো। তারা আমাকে খবর দিয়েছিলো যে পাকিস্তানিরা রাত্রেই হয়তো আক্রমণ করতে পারে। আমি সিরাজ সিকদারকে এই কথাটা বলেছিলাম।
উনি বলেছিলেন যে, এক ডিভিশন সৈন্য ছাড়া এতোবড় অঞ্চলে তারা আক্রমণ করতে পারবে না। কিন্তু দেখা গেলো যে, রাত্র সাড়ে তিনটার সময় আমরা যেখানে ছিলাম তার চারিদিকে অজস্র মানুষ এসে গেছে। তাদের একদল সহযোগী পেয়ারা বাগান সাফ করতে লাগলো। এক সময় পেয়ারা বাগান সব কেটে ফেললো। আখের খেত শেষ করলো।
সমস্ত জায়গা তখন একটা উদাম বা খালি অঞ্চলে পরিণত হলো। পেয়ারা বাগানের দুই পাশে কতকগুলি খাল ছিলো-যেখানে দশ বারো হাত পানি জমা থাকতো প্রায় সব সময়। এই খালের ভিতরে হাজার হাজার মানুষ প্রাণের ভয়ে লুকাতে চেষ্টা করলো। এদিকে শর্ষিনা পীর সাহেবের মাদ্রাসার প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ছাত্র এবং চারিদিকের ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের সরবরাহকৃত অনেক লোকজন নিয়া এই অঞ্চলটাকে পাকিস্তানি আর্মি ঘিরে ফেললো। অসংখ্য মানুষ তারা হত্যা করলো।
পাকিস্তানিরা সেদিনই মেয়েদের ধরলো,যারা অল্প বয়সী মেয়ে বা ৪৫ বছর পর্যন্ত বয়স তাদের ধরে নিয়ে কুরিয়ানা স্কুলে একটা ঘাঁটি করলো। সেই ঘাঁটিতে পাকিস্তানিরা বেশ কয়েকদিন থাকে এবং ধারাবাহিক অত্যাচার করতে থাকে। তারা যাকে পায় তাকেই হত্যা করে। লুটপাট করে। ঐ অঞ্চল তখন এক বিরান ভূমিতে পরিণত হলো।
কয়েকদিন থাকার পর পাকিস্তানি আর্মি এখান থেকে চলে যায়। (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।