মানুষ বড় সংবেদনশীল। পেশাজীবনে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পাওয়ার হতাশা, সৃষ্টিশীল কাজে উত্সাহ হারিয়ে ফেলায় এক ধরনের শূন্যতার অনুভূতি, কিংবা মনের মানুষের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় এখন পর্যন্ত বিশ্বের অনেক তারকাই আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ বেছে নিয়েছেন।
বিনোদনজগতের চাকচিক্য আর তারকাখ্যাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো কাজের প্রচণ্ড ব্যস্ততা আর অতিরিক্ত মানসিক চাপ। প্রায় সব তারকাই জনপ্রিয়তা অর্জনের পর খ্যাতি ধরে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। জনপ্রিয়তার এ ইঁদুরদৌড়ে হাঁপিয়ে উঠে কিংবা পিছিয়ে পড়ে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন তাঁদের কেউ কেউ।
হতাশার জালে আটকে বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে কখনো কখনো নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করেন তাঁরা। নিজেকে সঁপে দেন ইচ্ছামৃত্যুর কোলে। বিশ্বের অনেক নামীদামি তারকার মধ্যে বলিউডের বেশ কয়েকজন তারকাও ইচ্ছামৃত্যুর এ মিছিলে যোগ দিয়েছেন।
গুরু দত্তের প্রস্থান
পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে বলিউডে রাজত্ব করেছেন ‘সাহেব বিবি আউর গোলাম’ তারকা গুরু দত্ত। ১৯৬৪ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান তিনি।
মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল ও ঘুমের বড়ি সেবনের কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন প্রখ্যাত এ অভিনেতা ও নির্মাতা। তাঁর সেই অস্বাভাবিক মৃত্যু দুর্ঘটনা, নাকি আত্মহত্যা, তা নিয়ে সংশয় আজও কাটেনি। তাঁর পরিবারের সদস্যরা বরাবরই দাবি করেছেন, দুর্ঘটনাবশত মৃত্যু হয়েছিল গুরু দত্তের। কিন্তু মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে তাঁর জীবনের ঘটনাপঞ্জি ঘাঁটলে বোঝা যায়, তিনি মানসিকভাবে নিদারুণ বিপর্যস্ত ছিলেন। এমন মানসিক অবস্থায় আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পদক্ষেপ নেওয়ার নজির আছে আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের মধ্যে।
মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে থেকে স্ত্রী গীতা দত্তের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না গুরু দত্তের। সহ-অভিনেত্রী ওয়াহিদা রেহমানের সঙ্গে প্রেমের খবর চাউর হওয়ার পর স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে এমনিতেই বিচলিত ছিলেন গুরু দত্ত। এ অবস্থায় ওয়াহিদা রেহমানও তাঁর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলা শুরু করেন।
একদিন গুরু দত্তকে ছেড়ে চলে যান তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা। নিজের বাড়ি বিক্রি করে দক্ষিণ মুম্বাইয়ে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন গুরু দত্ত।
তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ভি এম মারথি বলেন, ‘আমি বেঙ্গালুরুতে থাকার জন্য চলে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার আগে চলচ্চিত্রনির্মাতা আবরার আলভিকে সঙ্গে নিয়ে গুরু দত্তের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন গুরু দত্ত বলেছিলেন ‘‘আমি অনাথ হয়ে গেছি। ঘরে কেউ নেই। তুমি চলে যাচ্ছ বেঙ্গালুরু।
আবরার চলে যাচ্ছে মাদ্রাজে। এখন আমি কী করব?’’ তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন গুরু দত্ত। প্রথম দুবার ফোন পেয়ে দ্রুত তাঁর বাসায় গিয়ে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু তৃতীয়বার তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শেষের দিনগুলোতে তিনি খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকতেন।
সবাই তাঁকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত। মৃত্যুর মাত্র আট দিন আগে এক পানশালায় তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি বারবার তাঁকে শান্ত থাকতে বলেছিলাম। ’
১৯৬৪ সালের ১০ অক্টোবর রাতে মৃত্যুর কিছু সময় আগে আবরার আলভির সঙ্গে কথা হয়েছিল গুরু দত্তের। আবরার আলভি বলেন, ‘গুরু দত্তের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় আমি স্পষ্ট উপলব্ধি করেছিলাম, প্রচণ্ড দুঃখবোধ ভর করেছে তাঁর ওপর।
তাঁর কণ্ঠে তীব্র হতাশার সুরও শুনতে পেয়েছিলাম আমি। ’
সিল্ক স্মিতার ঘুম
জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেত্রী সিল্ক স্মিতাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় ১৯৯৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সকালে। চেন্নাইয়ে নিজ বাসার শোবার ঘর থেকে তাঁর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন এই দক্ষিণী তারকা অভিনেত্রী। একটি চিরকুটে আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে তেলেগু ভাষায় সিল্ক লিখেছিলেন, জীবনের ৩৫টি বছরে একের পর এক ব্যর্থতায় হাঁপিয়ে উঠেছিলেন তিনি।
প্রচণ্ড হতাশা থেকে মুক্তি পেতেই এমন ভয়ংকর পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল তাঁকে। সিল্ক স্মিতার বাস্তব জীবনের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ ছবিটি মুক্তি পায় ২০১২ সালে। বক্স অফিসে ঝড় তোলা ছবিটির নামভূমিকায় অনবদ্য অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন এ সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী বিদ্যা বালান।
দিব্যা ভারতীর পতন
১৯৯০ সালে বলিউডে পা রাখার পরপরই রাতারাতি তারকাখ্যাতি পেয়ে গিয়েছিলেন দিব্যা ভারতী। ‘দিওয়ানা’ ছবিতে শাহরুখ খানের বিপরীতে দিব্যার অনবদ্য অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছিল অগণিত দর্শক।
নব্বইয়ের দশকের অন্যতম প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন দিব্যা। বলিউডে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের পথেই এগোচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাফল্যের শীর্ষবিন্দু আর ছোঁয়া হয়নি তাঁর। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই মাত্র ১৯ বছর বয়সে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় এ তারকা অভিনেত্রীর। ১৯৯৩ সালের ৫ এপ্রিল মধ্যরাতে নিজের ছয়তলা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের জানালা থেকে নিচে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন দিব্যা।
বলিউডের ইতিহাসে অন্যতম মর্মান্তিক ও হূদয়বিদারক মৃত্যু হিসেবে আজও বিবেচিত হয় দিব্যার সেই অকালপ্রয়াণ। তাঁর মৃত্যু নিয়ে রহস্যের জট এখনো খোলেনি। ধারণা করা হয়, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। আবার দুর্ঘটনাবশত তাঁর মৃত্যুর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হয়নি।
জিয়া খানের আত্মহত্যা
বলিউডের উঠতি অভিনেত্রী জিয়া খান আত্মহত্যা করেছেন গত ৩ জুন।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে জিয়ার এ চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি তাঁর বন্ধু, সহকর্মী ও আত্মীয়স্বজন। ‘নিঃশব্দ’ ছবিতে তাঁর সহ-অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন থেকে শুরু করে বলিউডের অনেক তারকাই জিয়ার এ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। যথেষ্ট যোগ্যতা থাকার পরও বলিউডের মায়াবী জগতে নিজেকে ঠিক মেলে ধরতে পারছিলেন না জিয়া। কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ছুঁতে না পারায় হতাশা ভর করেছিল তাঁর ওপর। এ ছাড়া প্রেমিক সুরজ পাঞ্চোলি আরেক নারীর সঙ্গে প্রণয়ে জড়িয়ে প্রতারণা করার পাশাপাশি জিয়ার ওপর নানাভাবে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালাতেন।
বলিউডে ডুবন্ত ক্যারিয়ার ও প্রেমিকের এমন আচরণ সইতে না পেরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন সম্ভাবনাময়ী এ অভিনেত্রী। নিজ বাসায় ওড়না গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। মৃত্যুর কয়েক মাস আগেও একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন জিয়া। কবজির রগ কেটে মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করলেও সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।