পৃথিবীর মানচিত্রটা বেশ ভালো করে মাপজোখ করলে দেখা যাবে, পাঁচটা মহাসমুদ্র আর ছেষট্টিটা সমুদ্র মিলিয়ে পৃথিবীর প্রায় একাত্তর ভাগ অংশই জলে ঢাকা, আর বাদ বাকীটা স্থল, অর্থাৎ মহাদেশ। সমুদ্র যে কত বড়ো (৩৬১,০০০,০০০ বর্গ কিঃমিঃ) তা অনেকটাই বোঝা যায় সমুদ্রের পাড়ে বসে চোখ দু’টো সামনে মেলে দিলে। শুধু আকারেই বড় নয়, গভীর দারুণ। কোথাও কোথাও এতা গভীর যে সেখানে আমাদের ডাঙার সবচেয়ে উচুঁ পাহাড় হিমালয়কে ছেড়ে দিলে তার কিছুই আর দেখতে পাওয়া যাবে না। তাই মনে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে, এতো বিশাল গভীর সমুদ্র তৈরী হলো কী করে!
এই প্রশ্নটা শুধু সাধারণ মানুষের মনকেই নয়, ভূ-বিজ্ঞানীদের চিন্তাকেও নাড়া দিয়েছে।
এ বিষয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য মতবাদটি বিবর্তন প্রবক্তা চার্লস ডারউইনের ছেলে জর্জ ডারউইনের। আজ থেকে প্রায় একশো ত্রিশ বৎসর আগে ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে জর্জ ডারউইন সৃষ্টির ব্যাপারে এক চমকপ্রদ কথা শোনালেন। তিনি বললেন প্রায় চারশো কোটি বৎসর আগে পৃথিবীর বাইরের খোলস যখন পুরোপুরি শক্ত হয় নি, ভেতরে নরম-গরম অবস্থা, সেই সময়ে সূর্যের টানে পৃথিবীর তরল বুক থেকে খানিকটা অংশ চিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল মহাকাশে। সেই উপড়ে চলে যাওয়া অংশই হলো চাঁদ। ফলে পৃথিবীর বুকে তৈরী হলো এক বিরাট গর্ত, যার নাম প্রশান্ত মহাসাগর।
জর্জ ডারউইনের এই মতবাদ উনিশ শতকে ও বিশ মতকের প্রথম দিকে খুব আলোড়ন তুললেও পরবর্তী কোনো বিজ্ঞানীই তার এই মতবাদে বিশ্বাস করেন নি। এই মতবাদের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীরা যুক্তি দিলেন, ভু-স্তর সৃষ্টির পর, তা যত পাতলাই হোক এমনই কঠিন হয়ে পড়েছিল যে তখন তার পক্ষে আর পৃথিবী থেকে উৎক্ষিপ্ত হওয়া সম্ভব ছিল না। মহাসাগর সৃষ্টির ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তত্ত্বটি হলো জার্মান ভূ-বিজ্ঞানী ওয়গনারের (১৮৮০-১৯৩০)। ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে প্রচারিত ‘চলমান মহাদেশ’ তত্ত্বটিকে তিনি মহাসাগর সৃষ্টির কথা বলেন।
ওয়েগনার বলেছেন, আজ থেকে পচিঁশ কোটি বছর আগেও পৃথিবীর মহাদেশ আর মহাসমুদ্রের চেহারা এইরকম ছিল না।
তখন পৃথিবীর সব মহাদেশগুলি মিলে একটাই মহাদেশ ছিল। সেই আদি প্রাগৈতিহাসিক মহাদেশ ঘিরে ছিল এক আদি মহাসমুদ্র প্যান্থালসা। ভূ-বিজ্ঞানী ওয়েগনারের মতে খুব সম্ভবত । মেসোজোয়িক (Mesozoic) যুগের প্রথম দিকে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় কুড়ি কোটি বছর আগে প্রাকৃতিক কারণে প্যানজিয়া মহাদেশটি দু’টো টুকরোয় ভেঙে গিয়ে সরে গেল একে অন্যের কাছ থেকে। তাদের একটা টুকরোর নাম গণ্ডোয়ানা-মধ্যপ্রদেশের ‘গণ্ড’ আদিবাসীদের নাম অনুসারে।
এতে ছিল দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারত, অষ্ট্রেলিয়া আর কুমেরু। অন্যটার নাম ‘লরেশিয়া’। যাতে ছিল ইউরোপ, এশিয়া গ্রীণল্যান্ড, আর উত্তর আমেরিকা। এই দুই মহাদেশের মাঝখানে রইলো টথিস সাগর। পরে গণ্ডোয়ানা আর লরেশিয়া আরো কয়েকটি টুকরোয় ভেঙ্গে গিয়ে ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে, আর তাদের মাঝখানে আদি মহাসাগর প্যানথালসার রুপ বদল হয়ে জন্ম নিল আজকের মহাসাগর।
দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা ভেঙ্গে সরে গেল গণ্ডোয়ানা থেকে। এদের মাঝে জন্ম নিল দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর।
এ দুটি মতবাদ ছাড়াও আরও বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে মহাদেশ ও সমুদ্র সৃষ্টির ব্যাপারে। তবে আধুনিক প্রযুক্তি বিজ্ঞানের যুগে সেই প্রকল্পগুলি নেহাৎই সেকেলে।
সমুদ্রে এতা জল এলো কোথা থেকে ?
সকল সমুদ্রের জলের পরিমাণ পৃথিবীর আয়তনের তুলনায় কম হলেও, নয় নয় করে এই জল, ১৩৭ কোটি ঘন কিলোমিটার।
এবং তা পৃথিবীর পৃষ্ঠে মাত্র পাচঁ কিলোমিটার পুরু জলের স্তর তৈরী করেছে। বলা বাহুল্য যে, পৃথিবীর আবহমন্ডল থেকে এ জল পাওয়া যায় নি। কারণ আবহমন্ডলের জল ধরে রাখবার যা ক্ষমতা, তাতে পৃথিবীর সমুদ্র জলের উচ্চতা বড়জোর ৫ সেন্টিমিটার বাড়ানো যেতে পারে তার বেশী নয়। কিন্তু পাঁচ কিলোমিটার পুরো জলের স্তর! অসম্ভব ! এরপর ভূ-বিজ্ঞানীরা তাকিয়েছেন ভূ-ত্বকের (Crust) দিকে, যদিও তা থেকে জলের হদিস্ মেলেনি। ভূ-ত্বকের নীচে রয়েছে ম্যাণ্টল (Mantle) যা তরল ও কঠিনের মাঝামাঝি একটা অবস্থান আছে।
ম্যাণ্টলের চরিত্র বিচার করে ভূ-বিজ্ঞানীরা রায় দিয়েছেন, পৃথিবীর এতো জল এসেছে ম্যাণ্টলের পেট থেকে আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে। অগ্ন্যুৎপাতের সময়ে আগ্নেয়গিরি জ্বালামুখ থেকে যে গ্যাস বেরিয়ে আসে তার অনেকটাই জলীয় বাষ্প। এই জলীয় বাষ্প ঠান্ডা হয়েই যে জলের জন্ম তা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু আগ্নেয়গিরির পেটে এতো জলীয় বাষ্প জমে কি করে ? ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে এই জল এসেছে জল (বা হাইড্রকসসিল)- বাহী কিছু খনিজ পদার্থ থেকে। – যা থাকে ম্যাগমার ভেতরে। যেমন অভ্র (Mica) স্যারপেনটিন (Serpentine), অ্যামফিবোল (Amphibole) ইত্যাদি খনিজগুলি যদি ২৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পোড়ে, তবে এই খনিজের জলটুকু বাইরে বেরিয়ে আসে, জলীয় বাষ্পের আকারে।
ম্যান্টলের শিলার মধ্যে এ ধরণের খনিজ যথেষ্টই রয়েছে। এই কারণে পৃথিবীর সমুদ্রগহ্বর পূর্ণ হতে বেশী সময় লাগে নি। পৃথিবীর পিঠে যতো জল রয়েছে, তার চেয়ে কয়েক হাজারগুন জল পৃথিবীর বহু খনিজ পদার্থের মধ্যে এখনো বন্দী অবস্থায় আছে।
পৃথিবীর মোট জলের শতকরা ৯৮ ভাগই সমুদ্রের নোনাজল, বাদবাকি ২ শতাংশ ছড়িয়ে আছে হ্রদ, নদী, হিমবাহ, মেঘ ও পাথরের ফাটলে সঞ্চিত ভূ-জলে।
সমুদ্রে জল লোনা হবার কারণ
মহাসাগর গুলি সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করার প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ জাহাজ ‘চ্যালেঞ্জার’ সমুদ্রের মোট ৭৭টি বিভিন্ন জায়গা থেকে জলের যে নমুনা সংগ্রহ করেছিল, তা বিশ্লেষণ ক’রে ব্রিটিশ রসায়নবিদ ডিটমার (১৮৮৪) দেখেছেন, প্রতি লিটার সমুদ্রের জলে নানা জাতের লবনে র পরিমাণ প্রায় ৩৫ গ্রাম।
অথচ প্রায় একশো বছর পরেও দেখা যাচ্ছে সমুদ্রজলে লবনে র পরিমাণ প্রায় একই আছে। যদিও আটলান্টিক মহাসাগরে জলে লবনে র পরিমাণ (লিটারে ৩৪.৯০ গ্রা), ভারত (লিটারে ৩৪.৭৬ গ্রাম) ও প্রশান্ত (লিটারে ৩৪.৬২ গ্রাম) মহাসাগরের চেয়ে সামান্য বেশি। তবে নদীগুলো যতোই লবন এনে ফেলুক না সাগরের জলে, সমুদ্রের নোনতা ভাব তাতে বাড়ছে না। ভূ-বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বলেছেন, সমুদ্রের জলে মোট ৫ x ১০১৮ কিলোগ্রাম লবন মিশে আছে।
পরীক্ষা করে দেখা গেছে সমুদ্রের জলে সোডিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইডের পরিমাণ নদীর জলের তুলনায় অন্ততঃ ১৭গুণ বেশি।
এসব সত্ত্বেও নিজস্ব প্রক্রিয়ায় সমুদ্রজল তার নোনতা ভাব একই জায়গায় ধরে রাখছে। এই প্রক্রিয়ার একটা ব্যাপার হলো, মহাদেশগুলি থেকে অসংখ্য নদী নালা মারফৎ নানা ধরনের লবন সমুদ্র যতোটা নেয় তার অনেকটাই আবার ফিরিয়ে দেয় মহাদেশকে। যেমন জোয়ারের সময়ে সাগরজলে মিশে থাকা লবনটুকু থিতিয়ে যায় মাটির শরীরে। সমুদ্রের জলকণা বাষ্প হয়ে মহাদেশগুলির দিকে ছুটে যাওয়ার সময়তেও সঙ্গে করে অনেকটা লবন নিয়ে যায়। এই লবনে র কিছুটা অংশ অবশ্য করে আবার নদী জলের সঙ্গে মিশে সমুদ্রে ফিরে আসে।
তবে বেশ কিছুটা পড়ে থাকে ডাঙার মাটিতে। এছাড়া সমুদ্রের জলে বিভিন্ন ধরনের লবনে র মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অধঃক্ষেপ (Precipitate) তৈরী হয়, যা থেকে সামুদ্রিক স্তর অথবা খনিজ নুড়িও (Nodule) তৈরী হতে পারে।
সমুদ্রে লবনের পরিমাণ সব সময়ে মোটামুটি একই রকম থাকলেও মাঝে মাঝে তারতম্য হয়। যেমন বৃষ্টিপাতের অঞ্চলে প্রচন্ড বৃষ্টিপাতের ফলে সমুদ্রের নোনতা ভাব সমসাময়িকভাবে যেমন কমে, তেমনি প্রচণ্ড গ্রীষ্মের সময়ে সমুদ্রের জল বাষ্প হয়ে আকাশে উড়ে গেলে, সমুদ্রের জলে নোনতা ভাব খানিকটা বেড়ে যায়। এছাড়া সমুদ্রের জল ঠান্ডায় জমে হিমশৈল তৈরী হলেও যে সমুদ্রে শতকরা মাত্র ৩০ ভাগ লবনই বরফের ভেতরে যেতে পারে, বাদবাকী ৭০ ভাগই পড়ে থাকে সমুদ্রের জলে।
ডেড সী-তে মানুষ ভাসে
নামেতে সমুদ্র হলেও আসলে ডেড-সী একটি হ্রদ (Lake) এটি ইসরায়েল ও জর্ডানের মাঝখানে অবস্থিত। এর জলের তল সমুদ্র পৃষ্ঠের চেয়েও ৯৩৯ মিটার নীচে। হয়তো আগে কোনো দিন এটি সাগরের সঙ্গে যুক্ত ছিল, আকাবা উপসাগরের মাধ্যমে, এখন কিন্তু এটি অবরুদ্ধ হ্রদ ছাড়াই কিছু আর নয়। এবং এর অবস্থান আরবের শুষ্ক অঞ্চলে হওয়ার ফলে হ্রদ থেকে বাষ্পীভবন-অর্থাৎ জল থেকে বাষ্প হওয়ার প্রবনতা-অনেক বেশী। আর সেখানে বৃষ্টিপাতও নামমাত্র হয়।
তাই প্রতিদিনই নদীবাহিত লবন জমে ডেড-সী-এর জলে লবনের অনুপাত বেড়ে যাচ্ছে। বাড়তে বাড়তে এখন এমন জায়গায় দাড়িয়েছে যে এর জলের অপেক্ষিক গুরুত্ব মানুষের পুরো শরীরের অপেক্ষিক গুরুত্বের চেয়েও বেশি। ফলে কোন মানুষই এর জলে ঝাপ দিলে এখন আর ডোবেনা, ভেসেই থাকে। নামে ‘ডেড-সী’ হলেও এর জলে ঝাপ দিয়ে ডুবে মরা প্রায় অসম্ভব। শুধু ডেড-সী নয়, আমেরিকা যুক্তরাষ্টের গ্রেট সল্ট লেকের ও এখন প্রায় অবস্থা।
সমুদ্রের জলের উপাদান
প্রতি লিটার সাগর জলে নানা ধরনের লবনের পরিমান প্রায় ৩৫ গ্রাম। এর মধ্যে ২৭.২ গ্রাম খাবার লবন বা সোডিয়াম ক্লোরাইড, ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড রয়েছে ৩.৮ গ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেড ১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়ম সালফেড ১.৩ গ্রাম, আর পটাসিয়াম সালফেড ও ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের মোট পরিমান ১ গ্রাম-এরও কম। এ ছাড়া অন্য যেসব পদার্থ খুব অল্প পরিমানে দ্রবীভূত অস্থতায় রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সিলিকন, ফসফরাস, আয়োডিন, লোহা, ব্রোমিন, ফ্লোরিন, ম্যাঙ্গানীজ, গন্ধক, সীসা, ও পারদ। দ্রবীভূত গ্যাসের মধ্যে উলে¬খ করতে হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড (০.০০৯%), নাইট্রোজেন (০.০০১৪%), অক্সিজেন (০.০০৫%) ও হাইড্রোজেন। দ্রবীভূত অবস্থায় সমুদ্রের জলে লবন থাকে আয়নিত অবস্থায়।
রসায়নবিদেরা বলেছেন- ১১টি প্রধান আয়ন রয়েছে সমুদ্রের জলে, যা নীচের তালিকা থেকে বোঝা যাবে।
আয়ন প্রতি লিটার সমুদ্রজলে আয়নের পরিমান (গ্রাম)
ক্লোরাইড ১৮.৯৮০
সোডিয়াম ১০.৫৫৬
সালফেট ২.৬৪৯
ম্যাগনেসিয়াম ১.২৭২
ক্যালসিয়াম ০.৪০০
পটাশিয়াম ০.৩৮০
বাইকার্বোনেট ০.১৪০
ব্রোমাইড ০.০৬৫
বোরিক এসিড ০.০২৬
স্ট্রনশিয়াম ০.০১৩
ফ্লোরাইড ০.০০১
সমুদ্রের তলার গঠন
সমুদ্রের তলদেশ মোটেই সমান বা মসৃন নয়। সমুদ্রের তলাতে অনেক ডুবো পাহার আছে। এ পর্যন্ত যতোটুকু জানা গেছে, সেই তথ্যের ভিত্তিতে সমুদ্রতলকে মোটামুটিভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন বিজ্ঞানীরা। যেমন- (১) মহাদেশের লাগোয়া অঞ্চল (২) সমুদ্রতলের মেঝে (৩) সামদ্রিক শৈলশিরা।
(১) মহাদেশের লাগোয়া অঞ্চল- সমুদ্র এখানে অগভীর। আর এখানে সমুদ্রের তরাটাও মোটামুটি মসৃন। সব উপকূলের মহীসোপান কিন্তু সমান চাওড়া বা গভীর নয়। কোথাও মহীসোপান চওড়ায় মাত্র কয়েক শো মিটার, আবার কোথাও বা কয়েকশো কিলোমিটার। গভীরতা সম্বন্ধেও একই কথা।
কোনো কোনো মহীসোপান মাত্র ২০-৩০ মিটার গভীর, অন্য কোথাও আবার ৬০০ মিটার গভীরতাও দেখা গেছে। তবে মোটামুটি ভাবে মহীসোপান – এর গড় গভীরতা প্রায় ১৫০ মিটার। মহাদেশের নদীগুলো ক্রমাগত যে পলি এনে সমুদ্রে ফেলে তার থেকেই তৈরী হয়েছে মহীসোপান অঞ্চল। সমুদ্রের অংশ হলেও স্থলের চরিত্রের সঙ্গে এর অনেক মিল আছে। এখানে সূর্যের আলো পৌঁছোয় বলে শতকরা ৯০ ভাগ সামুদ্রিক প্রাণী আর গাছপালার ভিড় এখানে।
সমুদ্রের বেশীর ভাগ খনিজ সম্পদও পাওয়া যায় এই অঞ্চল থেকেই।
মহীসোপানের শেষ যেখানে, মহীঢাল বা মহাদেশীয় ঢালের (Continental Slope) শুরু সেখানে। বলতে গেলে আসল সমুদ্রের শুরু এইখানে থেকেই। এরপর সমুদ্রতল অনেকটা গড়ানে ঢালে নেমে যায় ২০০-২৫০ মিটার গভীরে। এই অঞ্চলের গড় পড়তা ঢাল ২০-৩০ ডিগ্রীর মধ্যে।
এখানকার চেহারাটা স্থলভূমির চেয়ে অনেকটাই আলাদা। গাছপালা দেখা যায় না, বালির বদলে পাওয়া যায় ধূসর সবুজ অথবা নীল রং-এর কাদা। মহাদেশীয় ঢাল অঞ্চলের কোথাও কোথাও আড়াআড়িভাবে গভীর পরিখার (Sub-marine Canyons) দেখা মিলেছে। যেমন উত্তর আমেরিকার পূর্বে ও পশ্চিম উপকূল অঞ্চলে, ও আফ্রিকার কঙ্গো নদীর মোহনা অঞ্চলে, জাপানের উপকূলে কিংবা ফ্রান্সের ফিভিয়েরা অঞ্চলে। এই পরিখাগুলোর চেহারা ইংরাজী ঠ অক্ষরের মরো, নদী উপত্যকার সঙ্গে দারুন মিল।
তাই অনেক ভূ-বিজ্ঞানী মনে করেন, এই পরিখাগুলি আগে মহাদেশেরই অংশ ছিল। তুষার যুগে যখন সমুদ্রের জল অনেকটা নীচে নেমে গেছিল, তার তেমন জোরদার প্রমাণ এখনো মেলেনি। অনেকের ধারণা, সমুদ্রের নীচে এক বিশেষ ধরনের ঢেউয়ের ধাক্কায় তৈরী হয়েছে এই সব পরিখা। কেউ কেউ আবার বিশ্বাস করেন, ধ্বস বা ভূমিকম্পের ফলেই এসব পরিখার জন্ম।
কোথাও কোথাও মহাদেশীয় ঢাল ও সমুদ্রতলের মেঝর মধ্যে থাকে সমুদ্রপলিতে তৈরী ভূমি।
এর নাম মহাদেশীয় রাইজ। সব উপকূলে অবশ্য এদের দেখা মেলে না।
(২) সমুদ্রতলের মেঝে- মহাদেশীয় ঢাল ধরে নাক বরাবর নেমে গেলেই পৌছানো সম্ভব সমুদ্রের তলদেশে। কোনো সন্দেহ নেই, এটিই হলো সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর অঞ্চল- গড় গভীরতা প্রায় ৪০০০ মিটার। আর এর মোট বিস্তৃতি সমুদ্রের সাথ ভাগের পাঁচ ভাগ।
সমুদ্র তলদেশে মসৃন সমতল জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু ডাঙ্গার ওপর নদী উপত্যকায় বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি চোখে পড়ে। সমুদ্র তলদেশে রয়েছে অসংখ্য আগ্নেয়গিরি, বগু পাহাড়, শৈলশিরা, বিস্তির্ণফাটল ও গভীর খাত (Trenches) । কোন সন্দেহ নেই, এই গভীর খাতগুলিই পৃথিবীর গভীরতম অঞ্চল। এদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা গভীর খাত হলো প্রশান্ত মহাসাগরে ফিলিপাইনস দ্বীপপুঞ্জের পূর্বদিকে ও নিউ গিনির উত্তরে মারিয়ানা খাত (Mariana Trench) যার সবচেয়ে গভীর বিন্দু ১১,০৩৫ মিটার নীচে।
গভীর সমুদ্র এলাকায় এ পর্যন্ত ২৩ টি খাতের সন্ধান মিলেছে, যার মধ্যে ১৮টি রয়েছে প্রশান্ত মহাগসাগরীয় অঞ্চল। অন্যান্য খাতের মধ্যে যেসব নাম না জানলোই নয়, তারা হলো জাভা (৭৪৫০) মিটার, ফিলিপাইন (১০,২৬৫ মিটার), কারমাডেক (১০, ০৪৭ মিটার), আটাকামা (৮০৬৪ মিটার), কুরিল-কামচাটকা (১০, ৫৪২ মিটার) আ্যলিউসিয়ান (৭৮২২ মিটার) ও পোয়ের্টে রিকো (৮৩৮৫ মিটার)
(৩) সামদ্রিক শৈলশিরা-পৃথিবীর সব সমুদ্রতলেই মাঝের জায়গা জুড়ে রয়েছে দীর্ঘ শৈলশিরা। অবস্থানের কতা বিচার করলে শৈলশিরার আলোচনা বোধ হয় সমুদ্রতলের মেঝের সঙ্গেই করা উচিত ছিল। কিন্ত চেহারার দিক থেকে শৈলশিরা এতো বিশাল যে এর আলাদা শ্রেণী বিভাগ প্রয়োজন।
পৃথিবীর সব সমুদ্র জুড়ে যে দীর্ঘ পর্বতমালা বা শৈলশিরা রয়েছে তার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৫,০০০ কিলোমিটার।
যা পৃথিবীকে প্রায় দেড় বার স্বচ্ছন্দে পাক দিতে পারে। চওড়ায় গড়পড়তা একহাজার কিলোমিটারের বেশী, উচ্চতা সব জায়গাতেই সমুদ্রতল থেকে অন্তত দু-এক কিলোমিটার উচু কোথাও কোথাও সমুদ্রের জলের উপর মাথা তুরে নবীন দ্বীপের চেহারা নিয়েছে।
মহাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ পর্বতমালা যেমন দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ, সমুদ্রের সবচেয়ে দীর্ঘ শৈলশিরা তেমনি মধ্য আটলান্তিক পর্বতমালা (Mid Atlantic Ridge), যা দৈর্ঘ্যে আন্দিজের চেয়েও বেশ কয়েকগুন বড়। এই পর্বতমালা ছড়িয়ে আছে আইসল্যান্ড থেকে কুমেরু পর্যন্ত প্রায় ১৬,০০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য জুড়ে।
আটলান্তিকের কোনো কোনো জায়গায় এই শৈলশিরা মাথা উচু করে দ্বীপের চেহারা নিয়েছে, যদিও এই অধিকাংশ চুড়ার উচ্চতা ১৫০০ থেকে ৩৫০০ মিটারের মধ্যে।
তবে এর সবচেয়ে উচু চূড়া- ‘পিকো’ পর্তুগালের অধীন অ্যাজোর্স দ্বীপপুঞ্জের (Azores) একটি ছোপ দ্বীপ, যা সমুদ্রের তলদেশ থেকে প্রায় ৭০০০ মিটার উচু। দ্বীপটি জলের ওপরেই মাথা তুলেছে প্রায় ২২৮৫ মিটার।
সামুদিক পর্বতমালা মোটামুটি সমুদ্রতল অঞ্চলের মাঝ বরাবর দু’পাশের মহাদেশ থেকে সমান দুরাত্বে রয়েছে, তবে কোথাও কোথাও মহাদেশের ধার ঘেষে যে নেই তা নয়। যেমন, এই শৈলশিরাই দক্ষিণের একটি শাখা আফ্রিকা মহাদেশের পূর্ব দিকের সীমানা ছুঁয়ে দাড়িয়ে আছে। আটলান্তিকের মতো প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরেও বেশ কিছু পর্বতমালার হদিস মিলেছে, যদিও আকারে তারা তেমন বড় নয়।
প্রশান্ত মহাসাড়রের তলার পর্বত মালাও কোথাও কোথাও দ্বীপ হিসেবে জেড়ে উঠেছে। একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সমুদ্রতলের মোট অংশের শতকরা কতোটুকু কোন শ্রেনীতে পড়ে। শ্রেনী বিভাগটি এইরকম-মহাদেশীয় সোপান (৬%), মহাদেশীয় ঢাল (৪%), রাইজ (৪%), সমুদ্রতলের মেঝে (৩০%), শৈলশিরা (২৩%) খাত (১%) আগ্নেয়গিরি (২%)।
সমুদ্রের গভীরতা কী করে মাপা হয়?
যখন ইকো সাউন্ডার (Echo Sounder) আবিস্কৃত হয়নি, সেই বিশ শতকের গোড়ার আগে পর্যন্ত সমুদ্রের গভীরতা মাপা হতো একে বারে সাবেকী প্রথায়। কুয়োর মধ্যে জল কতো নীচে, সেটা দেখতে যেমন দড়ি নামিয়ে দেওয়া হয়, সমুদ্রের গভীরতা মাপতেও জাহাজ থেকে ঠিক তেমনই নামিয়ে দেওয়া হয় সীসে বাধা দড়ি-জলের নীচে ঠেকলেই দড়ি উঠিয়ে মেপে নেওয়া হতো দৈর্ঘ্য টুকু।
এভাবে গভীরতা মাপতে গিয়ে প্রায়ই ভুলচুক হতো। কেননা জলে নামানোর দড়ি এতো লম্বা ও ভারী হতো যে, প্রায়ই বোঝা যেতো না, কখন দড়িটা সত্যিই সমুদ্রতল ছুঁয়েছে। তবে ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে ইকো সাউন্তার আবিষ্কার হওয়ার পরে সমুদ্রের গভীরতা মাপা ব্যাপরটা খুব সহজ হয়ে গেছে। এই যন্ত্রের ব্যাপারটা আদৌ জটিল নয়। জাহাজ থেকে সমুদ্রের নীচে শব্দ তরঙ্গ পাঠানো হয়।
সেই তরঙ্গ সমুদ্রতলে প্রতিফলিত হয়ে আবার ফিরে আলে তা রেকর্ড করা হয় জাহাজের মাইক্রোফোনের মাধ্যমে। জলের মধ্যে শব্দ তরঙ্গের গতিবেগ জানা থাকায়, এবং শব্দ তরঙ্গ ফিরে আসতে কতো সময় নেয়, তা মেপে হিসেব কষে এই পদ্ধতিতে মোটামুটি নিখুঁতভাবে সমুদ্রের গভীরতা মাপা যায়। অবশ্য ১৯১৯ খ্রীস্টাব্দের পর এই ইকোসাউন্তার যন্ত্রের আরও উন্নতি হয়েছে।
সমুদ্রের জোয়ার ভাটা হয় কি ?
নদীর মতো সমুদ্রেও জোয়ার ভাটা হয়। নদীর জোয়ার ভাটা আসলে সমুদ্রের জোয়ার ভাটার প্রভাবেই হয়ে থাকে।
সমুদ্রে বিশাল জলরাশি সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ যখন একই টানের ফুলে ফেঁপে ওঠে। পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যায় সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ যখন একই রেখায় থাকে, টান বেশী হওয়ার সমুদ্রের জল বেশী বেশী ফুলে ওঠে। এর নাম ভরা কোটাল (Spring Tide) আর যখন চাঁদ ও সূর্য পৃথিবীর সঙ্গে সমকোনের সৃষ্টি করে, তখন জোয়ার একটু কমজোর হয়। এই জোয়ারের নাম মরা কোটাল (Neap Tide) সাধারণতঃ কুষ্ণা আর শুল্কা অষ্টমীতেই মরা কোটাল হয়। জোয়ার এলে সমুদ্রের জল মোহনা দিয়ে ভাঙার ভেতর নদীর খাতে ঢুকে পড়ে।
তখন নদীতে জোয়ার হয়। সমুদ্রের জোয়ার বেশী হলে, নদীতেও তার প্রভাব পড়ে। ফলে সে-সময়ে প্লাবিত হয় নদীর দু’পাশের গ্রাম, শহর, প্রান্তর।
পুরীর সমুদ্রের ঢেউ বড়, দীঘার তেমন নয়
সমুদ্রের ঢেউ কতো বড়ো হবে তা মোটামুটি ভাবে নির্ভর করে কয়েকটি কার্যকারণের ওপর। প্রথমতঃ হওয়ার গতি।
তাই সমুদ্রের পর বয়ে যাওয়া হাওয়ার গতি যতো বেশি হবে, ঢেউয়ের আকারও ততো বাড়বে। তারপর কতোক্ষণ হাওয়া বয়েছে আর সমুদ্রের কতোখানি অংশের ওপর দিয়ে হাওয়া বইছে, তাও দেখা দরকার। অর্থাৎ হাওয়ার তীব্রতা বা দাপটের ওপর ঢেউয়ের আকার নির্ভর করে। তবে এ দু’টি ব্যাপারেই দীঘা আর পুরীর মধ্যে তেমনি কোন তফাৎ নেই। এছাড়া আর যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি আছে, তা হলো, গভীরতা।
দীঘায় মহীসোপনের ঢাল পুরীর মহীসোপানের চেয়ে কম। অর্থাৎ দীঘার বেলাভূমি পুরীর বেলাভূমির তুলনায় অগভীর। ফলে দূর থেঙ্গে তটরেখার অনেক কাছে। ফলে পুরীতে তটরেখার কাছে ঢেউয়ের আকার অনেক বড় দীঘার তুলনায়। কারণ ঢেউ ভেঙ্গে পড়ার জায়গা থেকে যতো দূরেই যাওয়া যাবে, ততোই ঢেউয়ের আকারে ছোট হয়ে আসবে।
কে আসা সমুদ্রের ঢেউ দীঘার তটরেখা থেকে বেশ খানিকটা দূরেই ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু পুরীতে ঢেউ ভাঙ্গে তটরেখার অনেক কাছে। ফলে পুরীতে তটরেখার ঢেউয়ের আকার অনেক বড় হয় দীঘার তুলনায়। কারণ ঢেউ ভেঙ্গে পড়ার জায়গা থেকে যতো দূরেই যাওয়া যাবে, ততই ঢেউয়ের আকার ছোট হয়ে আসবে।
সমুদ্রের ধারে এতো বালি কেন ?
পুরী কিংবা দীঘায় গেলেই দেখা যাবে, সমুদ্রের ধার ঘেঁষে প্রচুর বালি।
এর কারণে হলো, সমুদ্র বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মহাদেশের সব নদীগুলি অবিরাম বালি এনে ফেলেছে সমুদ্রে, যা গিয়ে জমা হচ্ছে সমুদ্রের মহীসোপান অঞ্চলে, ফলে এখানে তৈরী হয়েছে বালির এক অফুরান ভান্ডার। মহীসোপান অঞ্চলের এই বালিই ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে সমুদ্রের বেলাভূমিতে বালির ভাগ বাড়ে। অবশ্য সমুদ্র-বেলাভূমিতে ভালো বালিয়াড়ী গড়ে ওঠবার জন্য প্রয়োজন অল্প ঢালের প্রায় সমতলভূমি, যাতে সহজেই বালি জমতে পারে।
হিমশৈলর জলে ভাসার পদ্ধতি
জমে জমে বরফ হয়। পাহাড়ী এলাকায় এই বরফ যখন চলতে শুরু করে, তখন তাকে বলে হিমবাহ বা (Glacier)।
হিমবাহ থেকে বিরাট বরফের চাঙড় সমুদ্রে ভেঙে পড়লে তা হয়ে যায় হিমশৈল (Iceberg)। জলে জমে বরফ হলে, বরপের ঘনত্ব জলের চেয়ে কম। তাই হিমশৈল জলে ভাসে, যদিও ভাসমান অবস্থায় হিমশৈলের দশ ভাগের নয় ভাগ অংশই জলের নীচে ডুবে থাকে। তাই কেবল ভাসমান অংশটুকু দেখে হিমমৈলর আকার কল্পনা করা খুবই কঠিন। সাধারণ অবস্থায় হিমশৈলর দেখামেলে মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে, কিন্তু সমুদ্রস্রোতের ধাক্কায় মেরু অঞ্চলের সমুদ্রছেড়ে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের সমুদ্রে প্রায়ই চলে আসে।
কেবল ভাসমান অংশটুকু দেখে হিমমৈলর আকার কল্পনা করা খুবই কঠিন। সাধারণ অবস্থায় হিমশৈলর দেখামেলে মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে, কিন্তু সমুদ্রস্রোতের ধাক্কায় মেরু অঞ্চলের সমুদ্রছেড়ে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের সমুদ্রে প্রায়ই চলে আসে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।