কক্সবাজার ট্যুরের দ্বিতীয় রাত। বারবিকিউ নাইটে ভরপেট খেয়ে কয়েকজন বেরিয়ে গেলাম সমুদ্র তীরে হাঁটতে। আমাদের তিন কন্যার একজন শুরুতেই আলাদা হয়ে গেল। কোন এক লাজুক ছেলের সাথে জানি তার বিশেষ আলাপ আছে। যাক, ওদেরকে ওদের মত থাকতে দিয়ে আমরা দুজন সাগরের পানির রেখা ঘেঁষে হাঁটছি আর সাগর নিয়ে জানা যত গান আছে গাইছি।
মাঝে মাঝে অবশ্য গানে একটু বাধা পড়ছে। আরও দু'তিনজনের ছাড়া ছাড়া দলের সাথে দেখা হচ্ছে আর পটাপট ছবি তোলা হচ্ছে। আবারও দুই কন্যা আলাদা হয়ে হাঁটতে থাকলাম।
হঠাৎ সাগর পাড়ে ঝিনুকের মালা বিক্রী করা একটা পিচ্চি আমাদের কাছে দৌড়ে এল। বলল, আপনাদেরকে ডাকে।
কে ডাকে রে পিচ্চি? ঐ যে ঐখানে বইসা আছে, ওরা। ওরা আবার কারা? একটা বেটি ডাকে তো। ভয়ই পেয়ে গেলাম, অন্ধকারে বোঝাও যাচ্ছে না ঐ দূরে ইজি চেয়ারগুলোতে ছাতার নিচে কারা শুয়ে বসে আছে। পিচ্চিকে বলে দিলাম, আমাদেরকে না রে, অন্য কাউকে ডাকছে মনে হয়, আমরা ওদের চিনি না। পিচ্চি দৌড় দিল ওদের দিকে।
আর আমরা এই ফাঁকে হন হন করে হেঁটে সরে এলাম ওখান থেকে। পরে মনে হল হয়ত আমাদেরই কেউ ছিল, একবার দেখলেও তো পারতাম। আবার গেলাম ঐদিকে। যেন এমনি হাঁটছি এমন ভাব করে ঐদিকটায় গেলাম। দেখলাম সবাই অপরিচিত।
আবার সরে এলাম। ভাগ্যিস তখন ওদের ডাকে সারা দিইনি।
রাত এগারটায় হোটেলের সার্চ লাইটগুলো বন্ধ হয়ে গেল। আমরা তখন ইজি চেয়ার ভাড়া করতে গেলাম। কিন্তু কাউকে দেখলাম না।
এক ছেলেকে পাওয়া গেল অঘোর ঘুমে অচেতন। তাকে ডেকে তুলে বললাম, আমরা সিট ভাড়া নিব, ঘন্টায় কত। সে বেচারা ঘুম থেকে উঠে কিছুই বুঝতে পারছিল না। জড়ানো গলায় কি জানি আবোল তাবোল বকতে লাগল। আমরাই ভয় পেয়ে গেলাম।
সরে এলাম, আর নিজেরাই দুইটা ইজি চেয়ার একসাথে করে নিলাম। এক কন্যা আবার আমাদের মানা করা সত্ত্বেও নিজে মাতবরি করে ছাতা সরিয়ে আনতে গেল। ছাতা উঠিয়ে বুঝল এই ভারী ছাতা উঠানো আমাদের কম্ম নয়। আমাদের উদ্ধার করতে অবশেষে ছাতার মালিকই চলে এল।
আমাদের সুবিধামত জায়গায় ছাতা বসিয়ে নিলাম যাতে মাথার উপর ছাতাও থাকে আবার তারা ভরা আকাশটাও দেখা যায়।
তিন কন্যা শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা গুনছি আর গান গাইছি। আর মাঝে মাঝে আমাদের তোলা ছবিগুলো বের করে দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি। একটু পর আমাদের দলের কয়েকজন পুরুষ সদস্যকে আসতে দেখা গেল। তারাও আমাদের কাছাকাছি আরও তিনটা চেয়ার ভাড়া করে সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নিল। তারপর শুরু হল আমাদের জম্পেশ আড্ডা।
হঠাৎ দেখি আকাশের কোন তারা দেখা যাচ্ছে না। আর সেই সাথে শুরু হল ঝড়ো বাতাস। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও শুরু হল। মজাই লাগছিল আবহাওয়াটা। তখনও কেউ টের পাইনি কী হতে যাচ্ছে।
ছাতাগুলো ততক্ষণে মাথার উপর ভালো করে সরিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়তেই থাকল। ছাতার নিচেও সবাই ভিজে যাচ্ছিলাম। বাতাস ততক্ষণে ঠান্ডা কনকনে হয়ে সুঁচের মত গায়ে বিঁধছে। সাগর কতটা উত্তাল হয়েছে সেটা তার গর্জন শুনেই বুঝতে পারছিলাম, তাকিয়ে দেখার আর সাহস কারও হচ্ছিল না।
কিন্তু কথা হল এখন আমরা হোটেলে ফিরব কিভাবে? এখানে দাঁড়িয়ে থেকেও ভিজে যাচ্ছি, আর হোটেলের উদ্দেশ্যে দৌড় দিলেও ভিজে যাব। কী করা যায় চিন্তা করতে করতেই দেখি পুরুষ সদস্যদের বেশির ভাগ দৌড়ে পালিয়েছে। তিন কন্যার সাথে ছাতার নিচে ছিল এক বিশিষ্ট সাহসী পুরুষ। দেখা গেল সে আমাদের তিনজনের কথা চিন্তা না করে লেজ তুলে দৌড় দিল। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় কয়েকবার উষ্টা খেয়ে পড়তেও দেখলাম।
তিন কন্যার বাকী দুইজন দেখল যে তাদেরও দৌড়ানোই উচিৎ। অতএব আল্লাহ ভরসা বলে তারাও ছুট লাগাল। আমি তখনও ভাবছি কী করা উচিৎ। এদিকে তো চেয়ারগুলোর ভাড়াও তো দেয়া হয়নি। মনে হয় আমার মনের কথা শুনতে পেয়েই কোত্থেকে যেন চেয়ার আর ছাতার মালিক উদয় হল।
বলল, আপা ভাড়া দিবেন না? আমি বললাম, তা তো দিবই, কিন্তু তুমি আমাকে এই ছাতা নিয়ে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দাও।
তখনই আবিষ্কার করলাম, পুরুষদের ছাতার নিচেও দু'একজন হতভাগা আমার মত দাঁড়িয়ে আছে তখনও। তার মধ্যে একজন আবার আমাদের দলের রাজা। সে এবার এগিয়ে এল আমাকে উদ্ধার করতে। ছাতার এক প্রান্ত ধরে আমাকে নিয়ে এল হোটেল পর্যন্ত।
যোগ্য রাজাই বটে। ছাতার মালিককে ছাতা ফেরৎ দিয়ে তার ভাড়া চুকিয়ে দিলাম। রাজামশাই অবশ্য ভাড়া দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ভাংতিজনিত জটিলতার কারণে আমি মানা করে দিলাম। সারাটা রাত হোটেলে শুয়ে ঝুম ঝুম বৃষ্টির শব্দ আর সমুদ্রের গর্জন শুনে কাটিয়ে দিলাম।
পরে শুনেছিলাম ঐ রাতে আমাদের দুই কন্যাকে যে "বেটি" সাগরপাড়ের পিচ্চিকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিল, সে আসলে আমাদেরই এক বড় আপু।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।