নিজেকে খুঁজে ফিরি আর সবার মাঝে
ঘুম ভাঙে খুব ভোরে। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি। দূরে সূর্য উঠছে সমুদ্রের বুক থেকে। সমুদ্রে সূযোর্দয় দেখার জন্য কতজনই না সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যায়। সেটা এখন দেখতে পাচ্ছি অনায়াসে।
কাপড় পড়ে বাইরে যাই। অবাক হয়ে তাকাই। চারদিক শুধু জল আর জল। পানি এতো নীল হবে ভাবিনি। কোথাও কোন স্থল নেই।
নীল জলে সাদা ফেনার সৃষ্টি করে আমাদের জাহাজ এগিয়ে চলছে সামনে। জাহাজের রেলিঙের ধার ঘেষে দাঁড়াই। নিচে দেখার চেষ্টা করি। না, কোন কিছু নজরে পড়ছে না, হাঙড়, তিমি দূরে থাক একটা মাছ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। এত সব বিচিত্র প্রাণী সবাই কি এখনও ঘুমুচ্ছে? নাকি মানুষ নামক এই হিংস্র প্রাণীটির সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছে তাদের নেই? সমুদ্রদর্শন শেষ করে কেবিনে ফিরে আসি।
হাতমুখ ধুই। তারপর বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকি চেয়ারে।
ডিউটির সময় হয়ে আসে। বয়লার স্যুট পরে ডিউটি মেসে যাই। নাস্তা সারি।
দুই ডিমের অমলেট, দু' টুকরো টোস্ট, কর্নফ্লেকস আর একটা কলা। এত কিছু খাওয়ার পর পেটে আর জায়গা থাকে না। আটটা থেকে শুরু হয় ডিউটি। চলবে বারটা পর্যন্ত। ইঞ্জিনরূমে ঢুকতেই কানে তালা লাগার উপক্রম।
মেইন ইঞ্জিন চলছে ফুল স্পীডে। খটাস খটাস শব্দ। এগজস্ট ভাল্ব ওঠানামা করছে দ্রুত। নেমেই গোটা ইঞ্জিনরূমে রাউন্ড দিতে হয়, দেখতে হয় কোন যন্ত্র কেমন আছে, তাপ, চাপ, তেল-পানি সব ঠিক আছে কিনা। ইঞ্জিনরূমের তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।
সর্বত্র আগুনের হলকা। কোথাও দাড়াবার জায়গা নেই।
দুপুরে সেলুনে খেতে গিয়ে বাইরে তাকাই। সমুদ্র পুকুরের মতো শান্ত, একটুও ঢেউ নেই কোথাও। খাওয়া দাওয়ার পর কেবিনে ফিরে আসি।
ঘুমুনোর চেষ্টা করি। কিন্তু ঘুম আসছে না। কী করা যায় ভাবছি। বই আছে একগাদা। কিন্তু সবই পড়া।
জাহাজ ছাড়ার আগের দিন কয়েকটা বই কিনেছি। তার মধ্যে আছে পুতুল নাচের ইতিকথা, পথের পাঁচালী, অপরাজিত। পথের পাঁচালী ও অপরাজিত কয়েকবার পড়েছি। এখন কি পুতুলনাচের ইতিকথা শুরু করব নাকি? না, থাক এখনই যদি সব শেষ করি তাহলে সামনে দুই মাস কী পড়ব! সেই চিন্তায় বইটা হাতে নিয়েও রেখে দিই। তাহলে কি লিখতে বসব? পর্যাপ্ত কাগজ কলম আছে।
লিখে শেষ করতে পারব কিনা সন্দেহ। কিন্তু কি লিখব? চিঠি? না, চিঠি লিখতে ইচ্ছে করছে না। কারণ, এখনও অভিজ্ঞতা তেমন কিছু জমেনি। যদি একটা তিমি দেখতে পেতাম কিংবা সিন্দবাদের মতো কোন অচেনা দ্বীপে পৌঁছে যেতাম তাহলে না হয় বেশ ফলাও করে লেখা যেত; বন্ধুদের কাছে, বান্ধবীদের কাছে। সেই শুনে তারা আফশোস করত- আহা! কী ভাগ্য।
কিন্তু কেমন করে লিখি একটা শান্ত পুকুরের সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছি, যেখানে ঢেউ নেই, মাছ নেই, পাখি নেই।
আমার সঙ্গে আছে আরেক বন্ধু সৌরভ। বেশ মজার ছেলে। বাকপটু। সারাক্ষণ বকবক করছে।
কেউ কেউ তার নাম দিয়েছে 'রসরাজ' বা 'রসের ভান্ডার'। কথা বলে কৌতুক ভরে। স্বাস্থ্য বেশ মোটাসোটা। মাথার চুল অর্ধেক উধাও। সে বিষয়ে তার কোন উদ্বেগ নেই।
বুদ্ধিমান লোকদের মাথায় চুল থাকে না, এটাই ওর উত্তর। তার সাথে দেখা হচ্ছে খুবই কম। আমি ডিউটি শেষ করলে সে নামে ডিউটিতে। আর অন্য সময়ে থাকে ঘুমের ঘোরে। স্মোকরূমে বসে হয় টিভি দেখছে, না হয় গল্প করছে।
বেশিরভাগই আষাঢ়ে গল্প। পথের পাচাঁলী দেখেই সে বলেল, 'কি পড়িস? পথের পাচাঁলী পড়িসনি?' 'পড়েছি, বহুবার পড়েছি। ' 'তাহলে আবার কেন?' সত্যিই তো, তাহলে আবার কেন? নিজেকেই প্রশ্ন করি, কেন পড়ি বারবার? ভাল লাগে বলে? কেন ভাল লাগে? উত্তর খুঁজতে বেশি দূর যেতে হয় না। সহজেই পেয়ে যাই। ভাল লাগে এজন্য যে ওর মাঝে খুঁজে পাই নিজেকে, নিজের শৈশবকে।
অপু তো আমিই, হরিহর আমার বাবা, সর্বজয়া আমার মা, দুর্গা আমার বোন। কোন পার্থক্য নেই, হুবহু মিলে যায়। নিজেকে একাত্ম করে ফেলি ছোট অপুর সাথে। আম আঁটির ভেঁপু বাজানো আমার প্রিয় খেলা। মাঠে মাঠে ঘোরা, পাখির বাসা থেকে ডিম চুরি কিংবা চুপচাপ বসে থেকে গাছপালা দেখা, চুপিচুপি খাতা ভর্তি গল্প লেখা- সবই মিলে যায়।
বোন দুর্গা ছিল দু'বছরের বড়। দুজনে মাঠের মাঝে হারিয়ে গেছি, রাত হয়ে গেছে, ভয়ে গা শিউরে উঠেছে। তারপর আছে বাবা হরিহর। আর মা তো সর্বজয়াই। সবকিছুকে জয় করেছে যে- অভাব- অনটন- দুঃখ- কষ্ট সবকিছুকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।