Quazi Hassan’ World of Writings (গল্পটা পড়তে আনুমানিক ১২ মিনিট লাগবে, মন্তব্য লিখতে ২ মিনিট, সব মিলিয়ে ১৪ মিনিট। চরিত্রের সংখ্যা কিছুটা বেশী হলেও মুল গল্প কয়েক জনকে কেন্দ্র করে। তবে গল্পটা, বলতে পারেন, অনেকটা অনেকের জীবন থেকে নেয়া)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর মার্কিন কাপড়। এই দুই জায়গাতে সম্ভবত বাংলা ভাষায় ‘মার্কিন’ শব্দটার ব্যাবহার বেশী। শব্দটার প্রকৃত অর্থ জিজ্ঞাসা করলে অনেকে হয়তো মাথা চুলকাবে।
যাই হোক মার্কিন শব্দের অর্থ নিয়ে পরে কোন এক সময়ে মাথা ঘামানো যাবে। তবে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাকে ইংরেজীতে দি ইউনাইটেড স্টেট্স অফ এমেরিকা বলে, সেখানকার গল্প বলি। তবে গল্পের প্রেক্ষাপট পৃথিবীর অনেক দেশে বসবাসকারি বাঙ্গালীদের জীবনের সাথে মিলে যেতে পারে।
আজ শনিবার। জামান সাহেবের মেয়ে টুনটুনির জন্মদিনের পার্টি।
গোটা পঞ্চাশেক মানুষ এসেছে। আসলে জন্মদিন ছিল গত মঙ্গলবার। কিন্তু উইকেন্ডে পার্টিটা করা হচ্ছে, যাতে বন্ধু-বান্ধব সবাই আসতে পারে। সবাইকে বলা হয়েছে সন্ধ্যা সাতটার দিকে আসতে। আশা করা হচ্ছে, নয়টার মধ্যে বেশীর ভাগ মানুষ চলে আসবে।
তার পর খাওয়া দাওয়া, কেক কাটা, আড্ডা--সব কিছু শেষ হতে হতে অনায়াসে রাত বারটা বেজে যাবে।
জামান সাহেবের স্ত্রী সেলিনা গত কয়েক দিন ধরে, বলতে গেলে দিনে পনের ঘণ্টা করে কাজ করেছে। অনুষ্ঠানটা যাতে ঠিক ঠাক ভাবে হয়। এতগুলো মানুষকে বাসায় খাওয়ানো তো আর চাট্টিখানি কথা না। কাঁচা বাজার করা, রান্না করা, বাচ্চাদের গুডি ব্যাগের জন্যে খেলনা কিনে তার মধ্যে ঢোকানো, কেক অর্ডার দেওয়া, ঘর বাড়ি পরিষ্কার সব নিয়ে মেলা কাজ।
এর মধ্যে সেলিনা ঠিক করেছে সারা বাড়ির জানালার পর্দা বদলানোর। কিন্তু যেই রঙের পর্দা সেলিনা খুঁজছিল, তা কয়েক জায়গা ঘুরে কিনতে হল। মেসিসে (Macy’s) সেলে ছিল। কিন্তু ঠিক রঙটা পাওয়া গেল না। পরে মলের আরও চার পাঁচটা দোকান ঘুরে পুরো দাম দিয়ে ডিলারড’স (Dillard’s) থেকে কিনতে হল ।
এতে মেজাজটা বেশ খারাপ। সময় আর টাকার দুটোর একটা বড় অপচয় হল। তার পরে পুরো দিন এইটার পিছনে। সেলিনা আর জামান সাহেবের নাভিঃশ্বাস অবস্থা। কখন যে পার্টিটা শেষ হবে, আর মানুষরা বাসায় যাবে।
পুরুষ মহলে রাজনীতি নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। তাও আবার বাংলাদেশের রাজনীতি। অনেকে দেশ ছেড়ে এসেছে প্রায় ১৫-২০ বছর। তার পরেও বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে প্রিয় বিষয় তাদের কাছে আর নাই। এর আগে কিছু সাধারন কিছু আলোচনা হলেও, আসল আলোচনা এখন জমে উঠেছে।
উত্তপ্ত কথা বার্তা হচ্ছে, হাসিনা আর খালেদাকে নিয়ে।
মহিলারা মহল তিন দলে ভাগ হয়ে আছে। এক দল সনাতনী বাঙ্গালী মহিলাদের প্রিয় বিষয় শাড়ি-গহনা নিয়ে গল্পে মশগুল। এই দলটাই বড়। এই দলের শেলির এক সময়কার প্রিয় বান্ধবী রুমা, অন্য দু জনের ছোট আরেকটা দল বানিয়ে গল্প করছে।
শেলি আর রুমার মধ্যে এখন শাপে-নেউলে সম্পর্ক। কেও কারোর সাথে কথা বলে না। সুযোগ পেলেই একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নানা কথা বলে। তৃতীয় দলটা, ছেলে মেয়েদের কি করে ধর্মের দিকে মনোযোগী করা যায়, সেটা নিয়ে চুল চেড়া বিশ্লেষণ করছে।
ছোট ছেলে মেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করছে।
অরেকটু বড় যারা, তারা সম বয়স্কদের সাথে কি যেন একটা নিয়ে গল্প করছে। তাদের কয়েকজনের হাত আইটাচ ধরনের বিভিন্ন রকমের চার কোনা স্ক্রিনের যন্ত্রপাতি।
পুরুষদের আড্ডা একটা বেমক্কা টার্ন নিল। ডঃ ইউনুসকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। এক সময়কার ছাত্রদলের নেতা সিরাজ হাসিনাকে নিয়ে একটা অশালীন মন্তব্য করে ফেলল।
শেষে বলল, সে বাংলাদেশেকে বাপের সম্পত্তি মনে করে। ফাইভ পাস অন্য যে কেও দেশ চালালে এর থেকে ভাল করতে পারতো। আওয়ামী লীগের এক সময়কার সক্রিয় সদস্য ইসমাইল এই কথা গুলো মেনে নিতে পারল না। সিরাজ সাহেবকে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে একটা কথা চিৎকার করে বলে, সার্টের হাতের দিকটা গুটিয়ে মারমুখি হয়ে এগিয়ে আসতে আরম্ভ করলো। ।
বাড়ির মালিক জামান আর কয়েকজন ছুটে এসে দুজনকে কোন রকমে থামাল, করেন কি, করেন কি। আপনাদের বয়স কি কমে গেল না-কি।
মহিলা, শিশুরা সব ছুটে আসলো এত হৈ চৈ শুনে। দুই বীর বাঙ্গালির প্রায় যুদ্ধাংদেহীবস্থা, চোখ চোখ বড় করে দেখল। সাত বছরের রায়েন বলল, call 911 before they start hitting each other ।
পরিবেশ শান্ত হওয়ার পরে, কোনার থেকে আব্দুল গনি বলল, এক বাঙ্গালী থাকলে নো সমস্যা, দুই জন হলেই দলা-দলি। আর তিন জন মারামারি। অন্য সময় হলে, এ রকম কথায়, হাসির বন্যা বয়ে যেতো। কিন্তু, প্রায় বিশ জন প্রাপ্ত বয়স্ক বাঙ্গালী নীরব রইলো।
থম থমে মুখে জামান-সেলিনা এক এক করে সবাইকে বিদায় দিল।
কাচু মাচু হয়ে সবার কাছে এই অনাকাংখিত ঘটনার জন্যে সরি বলল। তার পরে বাড়ির সবাই বসলো গিফট বক্সগুলো খুলতে। জামান লাল রঙের একটা পুতুল দেখে হাতে নিল। তার পরে একটা অট্ট হাসি দিয়ে তাকাল সেলিনার দিকে। পুতুলটা তাদের খুবই পরিচিত।
গত বছর একই পুতুল ওরা দুটো পেয়েছিল। সেলিনা একটা পুতুল উঠিয়ে রেখেছিল। তার মাস দুয়েক পরে পুতুলটা ওরা নিয়ে গেল সিদ্দিক সাহেবের মেয়ের জন্ম দিনে। কিন্তু জামান দেয়ার আগে পুতুলের বক্সের নীচে লাল কালি দিয়ে ছোট একটা ক্রস চিহ্ন একে দিল। ওই পুতুলটা আজকে সেলিম সাহেবরা দিয়ে গিয়েছে।
তার মানে, পুতুলটা জামানের বাসা থেকে সিদ্দিকের বাসা, সেখান থেকে সেলিমের বাসা। ন-কি আরও কিছু বাসা ঘুরেছে। জামানের বাসার আগে হয়তো পুতুলের এই ধরনের এর একটা ভ্রমনের ইতিহাস থাকলেও থাকতে পারে। প্রবাসী বাঙ্গালিরা আমন্ত্রিত হলে এখন আর খালি হাতে কারো বাসায় যায় না। মনের মত না হলে, সুযোগ পেলে গিফটকে কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়; পরের অনুষ্ঠানে।
যাকে বলা যেতে পারে গিফট রিসাইক্লিনিং।
২
জামানের বড় ভাই কামরুল থাকে প্রায় শ দেড়েক মাইল দূরে আরেক শহরে। শনিবার সকালেই তারা চলে এসেছে। রোববার দুপুর নাগাদ বাড়ির দিকে রওয়ানা দিবে। সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছে যাবে।
কামরুলের এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলের বয়স ১৫, নাম শ্যাম। মেয়ে শ্যামা বড়, বয়স সতের হতে চলল। কয়েকদিন পরে ও ইউনিভারসিটিতে যাবে। ছেলে মেয়েরা সাধারণত বাবা-মায়ের সাথে কোন অনুষ্ঠানে যায় না।
বলে ওদের বয়সে কেও সেখানে থাকবে। ওরা “বোর ফিল” করবে।
কামরুল আর তার স্ত্রী রুপা ছেলে মেয়েকে রেখে এসেছে। মাত্রতো এক রাতের ব্যাপার। জোর করে সাথে আনলে, মুখটা বেজার করে রাখতো।
অন্য মানুষদের বুঝে ফেলার সম্ভবনা থাকত। তার থেকে, জামান-সেলিনাকে বললেই হবে, ওরা তো হাই স্কুলে যায়। অনেক হোম ওয়ার্ক। সোমবারে আবার প্রোজেক্ট জমা দেয়ার একটা ব্যাপার আছে।
শ্যাম আর শ্যামাকে বাঙ্গালী মুসলমান হিসাবে মানুষ করার সব চেষ্টাই কামরুল-রুপার আছে।
দু জনে আরবী স্কুলে গেছে। শ্যামা প্রায় বছর পাঁচেক রবীন্দ্র সংগীত শিখেছে পশ্চিম বঙ্গের এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে। একবার কাদেরী কিবরিয়ার সাথে ষ্টেজে যেয়ে পর পর তিনটা গান করে পুরো শহর মাত করে দিয়েছিল। শ্যাম কিবোর্ড বাজায়। এ পর্যন্ত বেশ কিছু বড় বড় বাংলাদেশের শিল্পীদের সাথে বাজনা বাজিয়েছে।
অনেকে তার খুব প্রসংশা করেছে। অন্যান্য কাজের সাথে সাথে আরবী স্কুল, গানের মাস্টার আর মিউজিক স্কুলে বাচ্চাদের আনা নেওয়া করতে করতে বাবা মায়ের প্রাণান্ত অবস্থা। তার পরেও, তাদের বাবা মা হিসাবে একটা আত্মতৃপ্তি কাজ করে। তার নিজেরা জীবনে যতটুকু পেয়ে থাকুক না কেন, ছেলে মেয়ে দুটোকে মানুষের মত মানুষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কামরুল সুযোগ পেলেই শ্যাম, শ্যামা সাথে বসে সময় কাটায়।
তাদেরকে বলে বাংলাদেশে ফেলে আসা জীবনের কথা। সেই ছোট বেলায় ছুটিতে নানার বাড়িতে যেয়ে ধান ক্ষেত, আকাশ আর চাঁদ দেখা, আর দুরন্ত নদীতে সাঁতার কাটার ভীষণ একটা আনন্দ পাওয়ার কথা। মনে মনে একটাই আশা, এ সব শুনে ছেলে মেয়েরা যেন বাংলাদেশকে তার মতই ভালবাসে। রুপাও সুযোগ পেলে অনেকটা একই কাজ করে। ছোট বেলায় বৃষ্টিতে ভিজতে কি আনন্দ লাগত, কাঁচা আম কুঁড়িয়ে চাটনি বানিয়ে খেতে কি ভালই না লাগত, তাই বুঝানোর চেষ্টা করে।
কামরুলের মত তারও ইচ্ছা, ছেলে মেয়েরা যাতে তাদের শেখর থেকে দূরে চলে না যায়।
৩
বাসায় ফিরতে বেশ রাত হল। এর মধ্যে, শ্যাম, শ্যামা ঘুমিয়ে পরেছে। কামরুল কাছে বাসার চাবি ছিল। তাই দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।
কেমন যেন একটা বোটকা গন্ধ। রুপার ঠিক বুঝতে পারল না, কি হতে পারে। একবার চিন্তা করলো, হয়তো কোন ইঁদুর মরে এমন গন্ধ বানিয়েছে। কিন্তু পরে মনে হল, গন্ধ তো মিলছে না। কামরুল শুধু একবার বলল, কিসের যেন একটা গন্ধ।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠতে হবে। ক্লান্ত কামরুল আর দেরি করলো না। সরাসরি বিছানায় চলে গেল। একবার মাথায় আসলো, উঠে যেয়ে কিসের গন্ধ সেটা বের করতে।
রুপা এ ঘর ও ঘর যেয়ে দেখতে লাগল গন্ধটা কিসের সেটা বের করা যায় কিনা।
ছেলে, মেয়েদের যেয়ে দেখে আসলো। ওরা নিজেদের মত ঘুমাচ্ছে। রান্নাঘর, বাথরুম, শোবার ঘর, লন্ড্রি রুম-- কোথাও কিছু দেখল না। কার্পেটের কিছু কিছু জায়গা ভেজা ভেজা মনে হল। ঠিক বুঝতে পারল না, বিষয়টা কি হতে পারে।
মনে হচ্ছে গন্ধটা সব জায়গাতেই। মনে হল, ঘরদোর কেও খুব মনোযোগ দিয়ে পরিস্কার করেছে। কার্পেট ভ্যাকুম করা, প্রতিটা জিনিস জায়গা মত রাখা। কিন্তু ছেলে, মেয়েরা একান্ত বাধ্য না হলে ঘর বাড়ি পরিষ্কার করে না। বরং, ওরা বাসায় থাকলে বাসার সব জিনিস ওলট পালট করে রাখে।
ঘুমের আগে রুপার মনে আরেকটা কথা আসলো। কথাটা খারাপ। মায়ের মন ওইটা বিশ্বাস করতে চাইল না। তার ছেলে-মেয়েরা কোন খারাপ কাজ করতে পারে না।
পরের দিন সকালে পাশের বাসার মিস পামেলার সাথে দেখা গ্রোসারি ষ্টোরে।
মিস পামেলার সাথে রুপার বেশ অন্তরঙ্গতা। মোটামুটি সব ধরনের কথা হয়। সে জানত, রুপারা শনিবারে শহরের বাইরে থাকবে। দু একটা কথার পর একটু রহস্য করে মনে হয় বলল, বাসায় শনিবারে যে পার্টি ......। , কথাটা শেষ হওয়ার আগেই, সেল ফোনটা বেজে উঠলো।
মিস পামেলা ব্যাস্ত হয়ে পরলো ফেনে কথা বলতে।
রুপা তার সন্দেহের কথাটা কামরুলকে জানাল না। তার আগে আরো নিশ্চিত হওয়ার দরকার। সন্দেহটা যদি সত্যি হয়, কামরুলের যে কি রি-একশান ভাবতেই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। হার্ট এ্যটাক না করে বসে।
শ্বশুর সাহেব অল্প বয়সে হার্ট এ্যটাকে মারা গিয়েছিল। এর মধ্যে কামরুল কোলাষ্টোরেলের ওষুধ খাওয়া আরম্ভ করেছে। একজন স্ত্রী তার স্বামী থেকে সংসারের খুব দরকারি একটা ব্যাপার প্রথম বারের মত গোপন করলো।
৪
শ্যাম আর শ্যামা প্রায় মাস খানেক আগের থেকে জানত, বাবা মা টুনটুনির জন্ম দিনে যাবে। এক শনিবার রাত তারা একা থাকবে।
শ্যামা একবার বলেছিল, সেও যাবে চাচার বাসায়। কিন্তু, শ্যাম কোন ভাবেই যাবে না। ওখানে তার বয়সের কেও নাই, এমনকি ছেলেও নাই। রুপা বেশ অস্বস্থিতে পড়লো। পনের বছরের ছেলেকে তো আর একা বাসায় রেখে যাওয়া যায় না।
ব্যাপারটা শুনে শ্যামা নিজের থেকেই বলল, মা তা হলে আমিও থাকি। শ্যাম কি করে একা থাকবে? মায়ের মনটা ভরে উঠলো। তার খুব একটা সমঝদার মেয়ে হয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে, মা চলে যাওয়ার পরে, শ্যাম আর শ্যামা জোরে জোরে হাসতে হাসতে বলল, YES!! We did a perfect drama!!! ওরা আগেই প্ল্যান করে রেখেছিল। এক জন যেতে চাবে, আরেকজন যেতে চাইবে না।
শেষে মায়ের সাথে অভিনয় করা হবে। পরিনতিতে, দু জন এক রাতের রাজত্ব পাবে। শ্যামা বলল, let’s finalize our party plan.
শ্যাম, শ্যামা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে অনেকবার পার্টিতে গেছে। টিন এজারদের খুব একটা প্রচলিত রেওয়াজ আছে। যে খানে খালি বাসা পাওয়া যায় সেখানেই পার্টির ব্যাবস্থা করা।
যেহেতু তাদের বয়স কম, বার-নাইট ক্লাবে তারা ঢুকতে পারে না। বয়স একুশ হয়ে গেলেই আকাশ সমান অনন্ত স্বাধীনতা। যেখানে ইচ্ছা যাওয়া যায়, যা ইচ্ছা তাই করা যায়।
শ্যাম, শ্যামা ভাই বোন হলেও, তাদের সম্পর্ক একেবারে বন্ধুদের মত। দু জন পরিকল্পনা করতে লাগল, তাদের নিজের বাসায় প্রথম পার্টিতে কোথা থেকে কি আসবে।
প্রায় এক শ জন কনফার্ম করলো তারা আসবে। ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধুদের দাওয়াত দেয়া হল। শর্ত একটাই, জন প্রতি এক বোতল মদ আনতে হবে। কারো কাছে যদি ড্রাগ থাকে তাও নিয়ে আসতে পারে। শ্যামার বন্ধু রণ্ডার বড় ভাই এমিট, পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে চারটা বিভিন্ন দোকান থেকে বীয়ার আর মদ কিনে নিয়ে আসবে।
শ্যাম স্পীকার ভাড়া করে আনবে। কান ফাটানো মিউজিক সব রুম থেকে শোনা যাবে। খুব সহজেই সবাই, বাজনার তালে তালে নাচবে, কিছু গল্প আর এলকোহল গিলতে গিলতে নেশার পৃথিবীতে পৌঁছে যাবে। শুধু একা না, তাদের বয়সের সবাই থাকবে এক সাথে। ভাবতেই ওরা মহা excited হয়ে পড়লো।
Dance, dance, dance; this is party time. Drink, drink, drink; this is party time. Booz, booz, booz; this is party time.
৫
কামরুল-রুপার বাসায় একটা নিয়ম চালু আছে। বাসায় সবাইকে বাংলায় কথা বলতে হবে। শ্যাম, শ্যামা কখনে যদি ইংরেজিতে কিছু বলেছে, বাবা মা বাংলায় উত্তর দিয়েছে, তার পরে বলেছে বাংলায় কথা বলতে। এখন দুই ভাইবোনের স্পষ্ট আর শুদ্ধ বাংলা শুনে অনেকে অবাক হয়ে যায়। রুপাকে জিজ্ঞাসা করে, ভাবী, ওদের কি বাংলাদেশ থেকে বাংলা শিখিয়ে এনেছেন।
রুপার গর্বে বুকটা বড় হয়ে উঠে। সবাইকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয়, না আমি আর কামরুল মিলে ওদেরকে বাংলা শিখিয়েছি। বাবা-মা’র মনে হয় বাচ্চাদের জন্যে শ্রম হয়তো সার্থক হবে। কিছু প্রবাসী বাঙ্গালীর বাংলা ধরে রাখার কঠিন সংগ্রাম অনেকে হয়তো বুঝে না। শুধু বাংলা ভাষা বললে কম হবে, বাঙ্গালী সংস্কৃতি আর তার মুল্যবোধকে ধারন করার প্রতিটা মুহূর্তের চেষ্টা।
কিন্তু, যারা বিদেশে এসে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের একটা বড় অংশের মত, ইংরেজি ভাষা আর পাশ্চাত্যে সংস্কৃতির চটুল দিক গুলো নিয়ে নিমগ্ন থাকে তাদের কথা অবশ্য অন্য ।
ছোট বেলায় শ্যামাকে বাংলা শেখাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। শ্যামা যখন দশ বছরের, তখন সব কিছু বাংলায় আক্ষরিক ভাবে অনুবাদ করা আরম্ভ করলো। Hotmail হয়ে গেল গরম চিঠি, Walmart হল দেওয়ালের দোকান। সে ফোনে বাংলাদেশে বড় চাচাকে কামরুলের ইমেল এডরেস দিল, কামরুল@গরমচিঠি. কম।
আরেকবার, সেলিনা চাচী ফোনে জানতে চাইলো, তোমার মা কোথায়? উত্তরে শ্যামা বলল, দেওয়ালের দোকানে গেছে। শ্যাম সে হিসাবে বেশ সহজেই বাংলা বলতে শিখে নিল। সমস্যা একটা থেকে গেল। ওরা বাবা, মা কিংবা বয়স্ক মানুষদের সাথে বাংলায় কথা বলে। কিন্তু নিজেরা এক জন আরেকজনের জনের সাথে বাংলায় কখনই কথা বলে না।
কামরুল, রুপা এরকম হওয়ার ভাল কোন কারন খুঁজে পায় না। ভাই বোন নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলে না। তার মানে ওরা যখন নিজের পায়ে দাঁড়াবে, কিংবা বাবা-মা সামনে থাকবে না, তখন কি তাদের কাছ থেকে বাংলা হারিয়ে যাবে। ওরা কি আর বাঙ্গালী থাকবে না? ওরা বাঙ্গালী বিয়ে করবে তো? নিদেনপক্ষে মুসলমান ধর্মের কেও? ভাবতে গেলে, মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। নিজেদের খুব স্বার্থপর মনে হয়।
সোনার হরিনের খোঁজে এসে এই কি মস্ত ভুল তারা করলো। নিজেদের ছেলে মেয়েকে হারিয়ে ফেলবে। ভিতর থেকে আপনা আপনি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।
৭
শ্যাম, শ্যামা বেশ তাড়াতাড়ি বুঝে নিল, বাবা মাকে খুশী করার সহজ উপায় হল তাদের সাথে বাংলায় কথা বলা। কিন্তু ওরা নিজেরা নিজেদের বলে, বাবা মা বাংলা বাংলা করে বেশী বাড়াবাড়ি করে।
শ্যামা শ্যামকে একদিন বলল, যতদিন বাবা মার বাসায় থাক তত দিন ওদের কথা শুনতে হবে। একবার বাসা থেকে বের হলে, we will be out of their sight.
ভাই বোন সব সময় দেখে, বাবা মা তাদের যা শিক্ষা দিতে চাচ্ছে, তা অনেক বাঙ্গালিই মানে না। বাবা, মা কঠিন ভাবে এলকোহল খাওয়ার বিরুদ্ধে। এক দিন রহমান আঙ্কেলের বাসায় দেখল, রহমান, ইসলাম, খান আঙ্কেলরা পাল্লা দিয়ে বীয়ার খাচ্ছে। বাবার থেকে শ্যাম জানতে চাইল, আঙ্কেলরা মুসলমান, তা হলে ওরা ড্রিঙ্ক করছিল কেন।
বাবা প্রশ্ন শুনে প্রথমে থতমত খেয়ে গেল। পরে কিছুটা রাগ করে বলল, ওরা violator । আল্লাহ ওদেরকে শাস্তি দিতে পারেন। এর পরে ওরা আর রহমান আঙ্কেলের বাসায় যায় নি।
আরেকবার, নয়ন আঙ্কেলদের ছেলের সাত বছরের জন্ম দিন হল একটা বড় হোটেলের ব্যানকুয়েট (banquet) হলে।
আঙ্কেল অনেক পয়সা ওয়ালা মানুষ। ওরা শুনেছে, , নয়ন আঙ্কেল পড়ালেখা বেশী না জানলেও, তার সাতটা গ্যাস ষ্টেশান আছে। পার্টিতে খাওয়া দাওয়ার পরে আরম্ভ হল বাংলা গান, তার পরে হিন্দি আর ইংরেজী গান। কয়েকটা আঙ্কেলের সাথে সাথে বেশ কিছু আন্টি যেয়ে নাচতে লাগল। কিন্তু এ গুলো তো বাংলা নাচ না।
এখানকার মানুষদের মত করেই নেচে যাচ্ছিল। বাংলা স্কুলের টিচার ফাহমিদা ম্যাডামও সেখানে ছিল। বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়ে সারাক্ষণ কথা বলে। বাঙ্গালীদের অনুষ্ঠানে পুরনো বাংলা দিনের গান করে। আন্টিরা শাড়ি পরলেও, নাচের জন্যে তাদের শরীরের ভিতরের অংশগুলো হয়তো স্পষ্ট হচ্ছিল।
তা ছাড়া প্রায় তারা এক জন আরেকজনের খুব কাছে চলে যাচ্ছিল। অন্য মানুষদের শরীরগুলোর ছোঁয়া কি লাগছিল, না কি লাগছিল না। বাড়িতে ফেরার সময়, গাড়িতেই শ্যাম গম্ভীর ভাবে বাবা, মাকে বলল, Are you guys trying to teach us something which no body follows? You told us you Bengali guys are conservative, you told us….. কামরুল, রুপা ছেলের কথায় কোন উত্তর দিল না। এমনকি মনেও হল না, ছেলে তাদেরকে ইংরেজিতে প্রশ্ন করছে।
শ্যামার স্কুলের এক কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধু টম।
এক বার জানতে চাইলো, তোমারা না বাংলাদেশের? শ্যামা বলল, হ্যাঁ। ও বলল, তার বড় ভাই এক বাংলাদেশী মেয়ে বিয়ে করেছে। শ্যামা বলল, না সেটা সম্ভব না। কারণ বাংলাদেশীরা শুধু বাংলাদেশী বিয়ে করে। পরে দেখা গেল, টমের কথাই ঠিক।
আর শ্যামা ভূল। টমের ভাইয়ের বৌ আসলেও বাংলাদেশের মেয়ে।
বাংলাদেশের সেই মেয়েটার নাম বাবলী। এমেরিকায় পড়তে এসেছিল রিচমোণ্ড কলেজে। সেখানেই পরিচয় টমের ভাই বিলের সাথে।
ভালো লাগা কোন ধর্ম বর্ণ মানল না। বছর দুই ডেট করার পরে তার পরে ওরা বিয়ে করেছে। এক দিন বিল আর বাবলী এসেছিল, টমকে স্কুল থেকে উঠাতে। টম শ্যামাকে খুঁজে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিল বাবলীর সাথে। তার পরে বাবলী নিজের মুখে তার সব গল্প বলল।
তাও আবার বাংলায়।
তার কিছু দিন পর, টম এসে আরেকটা আশ্চর্য কথা জানালো। বিলের কলেজে এক বাংলাদেশের ছেলে আছে তার নাম জামাল। বছর খানিক হল এসেছে। এর মধ্যে একটা সাদা গে ছেলের সাথে থাকতে আরম্ভ করেছে।
বাবার এক ছোট বেলার বন্ধু রায়হান। বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে আসলো সপরিবারে। তার এক মেয়ে অঞ্জনা, এক ছেলে রঞ্জন। বয়স শ্যাম, শ্যামার মতই। তারা ঢাকায় ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে।
সারাক্ষণ ইংলিশ বলে। ওদের থেকে বাংলাদেশের যে গল্প শুনল, তাতে শ্যাম, শ্যামার চক্ষু চরক গাছ হওয়ার অবস্থা। প্রায় ওদের পার্টি হয়। এলকোহল, ড্রাগ, যোগার করা কোন কঠিন কাজ না। ছেলে, মেয়েদের ডেট করার অনেক ব্যাবস্থা আছে।
অঙ্গনা আবার ফ্যাসান শো’র মডেল। যেই ছবি দেখাল, মনে হল ঢাকা না প্যারিসের কোন ফ্যাশন শো। শ্যাম খুব অবাক হয়ে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই তোমাদের বাবা-মাকে লুকিয়ে এগুলো কর। ওরা বলল, না বাবা, মা এসব নিয়ে কিছু মনে করে না। বরং, ফ্যাশন শো’তে অঞ্জনার performance ওদের parents রা খুব proud.
শ্যামা শ্যামের সাথে ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা করলো।
ওদের কাছে পরিষ্কার হল, বাবা-মা বাঙ্গালী আর বাংলাদেশ সম্পর্কে যে চিত্র এতো দিন দিয়ে এসেছে, তার মধ্যে কোথায় একটা বড় গরমিল আছে। ওরা বাবামাকে কিছু আর প্রশ্ন করলো না। শুধু একটা জিনিস বুঝল না, বাবা- মা কেন চায় তারা বাবা- মায়ের মত করে ভাববে, সেই হিসাবে কাজ করবে। শ্যামা শ্যামকে একবার বলল, We really have a huge generation gap here. Our parents don’t look at the world through our eyes. They want to impose everything on us.
American Born Confused ছেলে মেয়েরা আরও বেশী Confused হল। সিদ্ধান্ত নিতে পারল না, কোনটা ঠিক আর তাদের কি করা উচিৎ।
৮
বাবা কামরুল বাংলাদেশের বড় কোন খবর হলে ছেলে, মেয়েদেরকে জানাত। এক বার মহা উৎসাহে বলল, জানো জানো বাংলাদেশ, ক্রিকেট খেলায় ইন্ডিয়াকে হারিয়ে দিয়েছে। তার পরে, বুঝানো আরম্ভ করলো ক্রিকেট কি করে খেলে। শ্যাম কয়েক বার হাই তুলে ঊঠে গেল।
বাবা কামরুল একবার খাবার টেবিলে বলল, সেফ ক্যারীয়ারের জন্যে হয় ডাক্তার, ইঙ্গিনীয়ার কিংবা আইনজীবি হওয়ার দরকার।
বাবা হাসতে হাসতে বলল, অফিসের লোকরা তাকে বলছিল তোমার ছেলেমেয়েরা কি DELL( Doctor, Engineer, Lawyer or Life is nothing) ফর্মুলা follow করে আগাচ্ছে কি না! শ্যাম-শ্যামা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলল, আমারা এইটার কোনটাই হতে চাই না। বাবার মনে হলে, ছেলেমেয়েরা এই প্রথম বারের মত মুখের উপর সরাসরি না বলে দিল।
কয়েক বছর আগের কথা। বাবা কামরুল একটা কাজ করলো, যা সে আগে কখন করে নি। শ্যামা তখন স্কুলে।
তাকে একটা টেক্সট ম্যাসেজ পাঠাল, আমাদের ডঃ ইউনুস নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। শ্যামা ভাবল, ডঃ ইউনুস হয়তো তার কোন আঙ্কেল হবে। কয়েকজন বন্ধুকে বলল, তার এক আঙ্কেল নোবেল প্রাইজ পেয়েছে। কথাটা কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো স্কুলে ছড়িয়ে পড়লো। বেশ কিছু ছেলে মেয়ে তার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাল।
বাবাকে দেখা মাত্র শ্যামা উত্তেজিত হয়ে বাংলা ভুলে, ইংরেজীতে বলতে লাগল, you never told me that we have an uncle named Dr. Yunus। পরে বাবা যখন উত্তরে বলল, সব বাংলাদেশী আসলে kith and kin, he is, matter of fact like cousin to me.। সবাই সবার আত্মীয়। একটা বেলুনের বাতাস বের হয়ে গেল যেমন হয়, শ্যামা মুহূর্তেই দমে গেল। বাবাকে বলল, Do you know, how many people from the United States get Nobel Prize every year? You never told that they were your cousins too . রাগে শ্যামার মুখ ফুলে গেল।
ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে উঠে গেল। একটু পরেই দড়াম করে দরজা বন্ধের শব্দ শোনা গেল।
৯
জেরিন রুপার ছোট বেলার বন্ধু। ওর মেয়ে ছন্দাও শ্যামার বন্ধু। আগে ওরা এই শহরে থাকত।
এখন চলে গেছে অন্য জায়গায়। অনেক দিন পরে জেরিন আজ ফোন করলো। এ কথা, সে কথার পর জানতে চাইল, তোমার দেবরের মেয়ের জন্মদিন কেমন হল। রুপা ভেবে পাচ্ছিল না, সে তো জেরিনকে টুনটুনির জন্মদিনের কথা কিছু বলে না। জেরিন বলতে থাকলো, বাসাতে ঢুকে কি কোন গন্ধ পেয়েছিলে।
রুপা বুঝতে পারছিল না। জেরিন ১২০০ মাইল দূর থেকে গন্ধের ব্যাপারটা জানল কি করে। এমনকি বিষয়টা নিয়ে সে কারোর সাথে আলাপ পর্যন্ত করে নি।
রুপাকে জিজ্ঞাসা করতে হল না। জেরিন এক নাগারে বলতে লাগল, আমি মাঝে মাঝে ছন্দার ফেস বুকে যেয়ে চেক করি কি হচ্ছে।
সেখান থেকেই পেলাম শ্যাম শ্যামার কাণ্ডকারখানার খবর। শ্যামা ফেস বুকে লিখেছে, বাবা,মা আউট অফ টাউন ছিল। বাসায় বড় পার্টি হয়েছে। শ খানিক মানুষ মদ পান করে মাতাল হয়েছে। বেশ কিছু মানুষ আবার গাজাও টেনেছে।
কয়েকটা মদের বোতল ভেঙ্গে যায় আর কয়েক জন বমি করে বিভিন্ন রুমে। পার্টি চলেছে ভোর চারটা পর্যন্ত। ঘর বাড়ি রোববার সারাদিন ধরে পরিষ্কার করেছে দুই ভাই বোনে। কিন্তু, মদ আর বমির গন্ধ মিলে যে একটা বিকট গন্দ তৈরি হয়েছিল, তা পুরোটা দূর করা সম্ভব হয় নি। একগাদা পাইন ও সোল (Pine O Sol) ব্যাবহার করেও খুব একটা বেশী লাভ হয় নি।
রাত দশটার দিকে আরো তিন বন্ধু এসেছিল শেষ মুহূর্তের কোন সাহায্য লাগবে কিনা তা দেখতে। ওরাও চেষ্টা করলো, তেমন কোন লাভ হয় নি।
শ্যামা ফেসবুকে চল্লিশটা পার্টির ছবি আপলোড করেছে। সেখানে বাড়ি ভর্তি মদের বোতলের ছবি থেকে আরম্ভ করে, পানাহার, গাজা টানা, নাচের ছবি সবই আছে। অনেক গুলো ছবির মধ্যে শ্যাম, শ্যামা আছে।
কখন তারা মদ খাচ্ছে, কখন নাচছে, কখন গাজা টানছে। কয়েকটা ছবির মধ্যে শ্যামা বেশ অন্তরঙ্গ ভাবে একটা কালো ছেলের সাথে, আর শ্যামকেও দেখা গেল একইভাবে একটা সাদা মেয়ের সাথে।
১০
রুপা অনেকটা বাধ্য হয়ে, কামরুলকে সেই দিনের গন্ধের কারন বলল। এর মধ্যে জেরিন ফেস বুকের লেখা আর ছবিগুলো ইমেল করে পাঠিয়েছে। সব শুনে, পড়ে আর দেখে কামরুল একটাও কথা বলল না।
উঠে চলে গেল শোবার ঘরে। কিন্তু রাত দুইটার দিকে বিছানা থেকে উঠে গেল। বাকি রাত পায়চারী করে কাটালো।
এর তিন দিনের মাথায় কামরুলের একটা ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক হল। নিজেই বুকের ব্যাথা নিয়ে হাসপাতালে গেল।
ডাক্তার বলল, আর এক ঘণ্টা দেরি করলে বাঁচানো যেতো না। পরের দিন বাই পাস সার্জারি হল। দশ দিন পর বাসায় ফিরল। তার পরে আরো চার সপ্তাহ বেড রেস্ট করে কাজে ফিরল।
কামরুল এখন খুব দরকার না হলে কারোর সাথে কথা বলে না।
বাসায় থাকলে পায়চারী করে আর বিরবির করে কথা বলে। কথা গুলো দুর্বোধ্য। শ্যামকে ক্রিকেট খেলা বুঝানোর চেষ্টা করে না। শ্যামার সাথে বসে কথাও বলে না। প্রতিদিন রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুটা সময় কাটায়।
হোক না সে পূর্ণিমা কিংবা কাল মেঘে ঢাকা আকাশ। মাঝে মাঝে মনে কামরুল আকাশকে জানি কি একটা প্রশ্ন করে।
১১
দুই ধারার দুই জীবন এইভাবে চলতে লাগল একই ছাদের নীচে। রুপা এখনো চেষ্টা করে যায় শ্যাম, শ্যামাকে জয় করতে। মায়ের কিছু কথায় সায় দিলেও, এদের যে তার মধ্যে কোন প্রানের তাগিদ থাকে না; তা দুই পক্ষে সহজেই বুঝে নেয়।
পৃথিবীটা শ্যাম, শ্যামার জন্যে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। ঘরের ভিতর এক জীবন, আর ঘর খুলে বাইরে বের হলে একেবারে অন্যরকম একটা জগত। ধান ক্ষেত, নদীতে সাঁতার, কাঁচা আম, বৃষ্টি, রবীন্দ্রনাথ, ডঃ ইউনুস, ক্রিকেট কোন কিছুই তাদেরকে আকৃষ্ট করতে পারে না। বাংলা আর বাংলাদেশের মায়াবি হাত ছানি ডাক ওরা শুনতে পায় না। ওরা আসলে বুঝলই না মায়াবী হাত ছানি ব্যাপারটা কি।
শ্যাম, শ্যামার মা রুপা বাসায় কেও না থাকলে কিছুক্ষণ একা একা কাঁদে। এক সময় কামরুল ছিল তার পাশে প্রতিটা ব্যাপারে। এখন সে একজন নিঃস্পৃহ মানুষ, কোন ব্যাপারেই তার আগ্রহ নাই। ছেলে মেয়ে দুটো অপেক্ষা করছে কবে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের পৃথিবীর আনন্দে নিজেদের ভাসিয়ে দিবে। হয়তো শ্যাম, শ্যামা জীবনে অনেক অর্থ সম্পদ উপার্জন করবে।
কিন্তু, চেষ্টা ছিল ওদেরকে মানুষের মত মানুষ বানানো। অর্থ না মনের দিক থেকে বড় করতে। হয়তো তাদের একদিন বয়সের গরিমা কমে যাবে। বাবা, মা’র কথা বুঝতে পারবে। শিকড়ের সন্ধান করবে।
কিন্তু, তখন রুপা, কামরুল কি থাকবে ওদেরকে দেখার জন্যে।
রুপা প্রায়ই ভাবে, যদি আরেকটা একুশে ফেব্রুয়ারী হত, যা তাকে তার স্বামী, ছেলে-মেয়ে ফিরিয়ে দেবে, তা হলে সে অবশ্যই সেই মিছিলের সবার সামনে থাকত। গুলি খেয়ে মরতেও বিন্দু মাত্র সংশয় করত না। তার পরেও যদি কিছু মানুষজন তাদের প্রানের মানুষদের ফিরে পেত। সব বাঙ্গালী; বাঙ্গালী হত।
নিজেকে নিয়ে গর্বিত হত। তাদের কাজকর্ম দিয়ে পরের প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করত না। বাবা, মা সন্তান থেকেও; না থাকার যন্ত্রনায় ভুগতো না।
জুন ১৯, ২০১১
http://www.lekhalekhi.net
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।