স্বাগতম আমিও বাবা হয়ে গেলাম
অনেক দিবসের মধ্যে সেদিন বাবা দিবসও পালিত হলো। আমার বাবা বেচে থাকলে হয়তো আমিও শুভেচ্ছাসহ খোজ খবর নিতাম। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই ,আমাদের রেখে তিনি হয়েছেন অজানার যাত্রী। বাবার কথা ভাবতে গিয়ে নিজেকেও আবিষ্কার করলাম একজন বাবা হিসেবে। হ্যাঁ তাইতো আমিও যে একজন বাবা বনে আছি!
মক্কার রাস্তায় ছেলে নিয়ে
মনে পড়ে সেদিনের কথা,আমার গিন্নীকে এদেশে নিয়ে আসার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা টের পেলাম আমাদের ঘড়ে নুতন অতিথী আসছে।
তখন থাকি ছোট্ট একটি মফস্বল শহরে,সেখানকার আল-খাফজী ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চেকআপ করালাম। বিশালদেহী এক ফিলিপিনো মহিলা ডাক্তার হাসতে হাসতে বললেন মাবরুক(কনগ্রাচুলেট) তুমি বাবা হতে যাচ্ছো। আমি কতক্ষন হা করে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে ছিলাম,তারপর বুঝতে পেরে গর্বের হাসি হেসে বলেছিলাম আল হামদুলিল্লাহ। ডাক্তার নুতন বাবা মার জন্য অনেক উপদেশ দিলেন। এবং মেডিকেল খরচা কমানোর জন্য সরকারি ক্লিনিকে নাম রেজিস্ট্রি করতে বললেন।
তখন দেশী বিদেশী সকলের জন্যই সৌদি আরবে ডাক্তার ও ঔষধ ফ্রি ছিল। বর্তমানে অবশ্য বাংলাদেশের মতোই অবস্থা,সম্পুর্ন নিজের খরচা বা কোম্পানীর দেয়া ইন্সুরেন্স পলিসি ভরসা।
কিং ফাহাদ হাসপাতাল,আল-খুবার।
যাক খুব শীঘ্রই আমি ট্রান্সফার হয়ে এই আল-খুবারে চলে এলাম। এখানে আমার পরিচিত দু-একটা পরিবার ছিল, তাদের সহায়তায় এক সরকারী ক্লিনিকে নাম রেজিস্ট্রি করলাম।
সেখানে ডাক্তার ও নার্স দুজনকেই বাংলাদেশী পেয়ে আমার গিন্নী মহা খুশি হয়ে গেলেন। বাচ্চা আসার আগ পর্যন্ত যত রকমের চেকআপ এবং ঔষধ সবই ফ্রি অর্থাৎ সরকারী। আর ডেলিভারি হবার আগে ডাক্তার কিং ফাহাদ হাসপাতালে এডমিটের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে দিলেন।
হাসপাতালের ভেতরে ফিলপিনো নার্স
এডমিশনের কাগজ-প্ত্র নিয়ে একদিন বিশাল এবং টিপটপ সেই হাসপাতালে গেলাম নাম রেজিস্ট্রি করতে। কিন্তু হায় তারা ওকে চেক আপ করেই ভর্তি করিয়ে নিলেন।
তখন তার বাচ্চা হওয়ার কোন আলামতই ছিলনা। আমারতো মাথায় হাত, ঘড়ে দুই চারদিনের আগাম রান্না বা অন্যান্য টুকটাক কোন কাজই শেষ করে যায়নি! আর সেই থেকে আমার শুরু হলো ঘড়ের ঠিকা কাজ করা,চলছে আজ অব্দি!
এখানে বলে রাখা ভাল তখন পর্যন্ত আমাদের জানা নেই ছেলে হবে নাকি মেয়ে। যেহেতু কোন ডাক্তারই আমাদের প্রশ্ন করা সত্ত্বেও বলেননি তাই ধরে নিয়েছিলাম আমাদের ঘড়ে টুকটূকি একটা মেয়েই হবে। নামও দু-একটা ঠিক করে রাখলাম।
আমি প্রতিদিনই ভিজিট আওয়ারে গিয়ে দেখা করি।
ওর পেটে লাগিয়ে রাখা যন্ত্রপাতি দেখে ভয় পাই কিন্তু ফিলিপিনো নার্স আর ডাক্তাররা অভয় দেন নরমাল ডেলিভারির জন্য নাকি সময় নিচ্ছে। এদিকে একদিন দু দিন করে ১৩দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। আমি তখন দিশেহারা হয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে যোগাযোগ করলাম কিন্তু আমার কথা শুনে তারাও বললেন আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরতে।
ঠিক চৌদ্দ দিনের মাথায় সকালে কেবিনে ফোন দিতেই ও চিৎকার দিয়ে উঠলো। তুমি কোথায় ? রাতে তুমি একটি ছেলের বাবা হয়ে গিয়েছো!!!!! আমার শুনা সেই মধুর চিৎকার আজো কানে বাজে।
বাবা হওয়ার ছিল এক আনন্দ আর ১৪ দিনের বিচ্ছেদের সমাপ্তি ছিল অন্যরকম আনন্দ,দুটো মিলে আমার সেই অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
কিন্তু আমার অপেক্ষার শেষ হয়না দুপুর আড়াইটার আগে আমি সেখানে প্রবেশ করতে পারিনা। ওয়েটিং হলে অপেক্ষার পর ওর কেবিনে ঢূকলাম। দেখি একাকী ঘুমাচ্ছে। জাগিয়ে দিলাম ছেলে কোথায় বলে খুজতে শুরু করলাম।
ওর হাসি দেখে মনে হলো যেন বিশ্ব জয় করেছে!!! বলল বেবীরুমে আছে এবং ঘন্টায় ঘন্টায় এসে দুধ খাইয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নার্সের কাছে গিয়ে এক প্যাক চকোলেট ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমার ছেলে কোথায়? সে বেবী রুমের রাস্তা দেখিয়ে দিল। সেখানে গিয়ে দেখলাম আমার মতো অনেকেই বেল টিপে সেখানকার নার্সকে বাচ্চা দেখাতে অনুরোধ করছেন। আমিও বেল টিপলাম এক বয়স্কা নার্স এসে জিজ্ঞেস করলো মায়ের নাম কি? বলে দিতেই ভেতর থেকে ট্রলিতে করে নিয়ে এলো ---দেখলাম প্রাণ ভরে। কোলে নিয়ে জড়িয়ে রাখলাম বেশ কিছুক্ষন।
যা আমার বাবাও হয়তো আমাকে নিয়ে এই রকমের আদর করেছিল।
আমি শুরু করলাম বাসায় নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। কিন্তু কর্তৃপক্ষ জানালো আগামিকাল ছেলের নাম ঠিক করে তা টেম্পোরারি বার্থ সার্টিফিকেটে লিপিবদ্ধ করে তবেই রিলিজ নেয়া যাবে!পরদিন তারাহুরা করে নাম ঠিক করে এসে সব কাজ শেষ করে ঘড়ে নিয়ে চললাম। সেখানে আমি ছাড়া বাবা-মা,শশুড়-শাশুড়ী। খালা,ফুপু কেঊ নেই যে আমাদের এই শিশু ছেলে বা তার মাকে দেখবাল করবে।
তবে প্রবাসী বন্ধুদের পরিবার থেকে বেশ কিছু সহায়তা পেয়েছি। এক সপ্তাহ ধরে রান্না করার প্রয়োজন হয়নি। তবুও আমার কাজ গেল বেড়ে। দেশের বাবা আর প্রবাসী বাবার মধ্যে যে বিশাল তফাৎ রয়েছে তা বুজবে কেবলমাত্র ভুক্তভোগীরাই। আমি এখানে বাবার দায়িত্ব ছাড়াও পার্টটাইম মায়ের কাজ করেছি।
আর এই ছেলেকে আমি যা সময় এবং সঙ্গ দিয়েছি আমার বাবা আমাদের পাচ ভাইকেও সেই সময়টুকু দিতে পেরেছিল বলে মনে হয়না। তাই হয়তো আমরা দেশে শুধুমাত্র মায়ের স্নেহের আচলে থাকতাম আর আমার ছেলে মায়ের চে বাবার পিছু পিছু থেকেছে বেশী। তাই ছেলে হয়েছে বাবার কাছের বন্ধু।
এই হচ্ছে আমার বাবা হবার অন্যতম একটি কাহিনী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।