Dream Today,Create Tomorrow........ চোখ মেলে জানালা দিয়ে তাকাতেই বৃষ্টিধারা দেখে মনটা জানি কেমন হয়ে গেলো। হৃদয়ে অশ্রু ঝরছে সাথে প্রকৃতিও যোগ দিয়েছে। ধাতস্ত হয়ে বুঝতে পারলাম বাসটা থেমে আছে। সেই সাথে থেমে আছে নিজের সমস্ত চিন্তা ভাবনা আর স্বত্তাগুলোও। বাস তার সাময়িক নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে চুপটি করে আছে।
বৃষ্টির জন্য কিছু যাত্রী এখনও বাসে আছে। বাকীরা বৃষ্টি উপেক্ষা করেই চলে গেছে পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্য। জীবনটাই বুঝি এমন....... এক গন্তব্য হতে অন্য গন্তব্যে ছুটে চলা। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় ছুটতেই হয়। যেমনটি আজ ছুটে চলছি আমি।
বুক পকেটে হাতড়ে চিরকুটটা বের করে ঠিকানাটায় আবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। এই ঠিকানাই এখন আমার পরর্তী গন্তব্য। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই বাস থেকে নেমে পড়লাম। যেই ঝড় পেছনে ফেলে এসেছি তার কাছে এই বৃষ্টি কিছুই না। মনে শুধু একটাই চিন্তা....." আমায় কিছু করতেই হবে, পৌঁছাতে হবে স্বপ্নদ্বারের প্রান্তে।
"
ঢাকা শহর মোটামুটি চেনা জানা। ১৩/২,টিকাটুলী। রিকশাওয়ালাকে বিদায় দিয়ে আবার ঠিকানাটা মিলিয়ে দেখলো আকিফ। সবই ঠিক আছে। এটাই তার আপাতত গন্তব্য।
অনেক আগে দু-একবার আসাও হয়েছিলো এই বাসায়। সম্পর্কে মামা হন। ফোনে অনেকবার কথা হলেও সামনা-সামনি কথা হয়েছে হাতে গনা কয়েকবার মাত্র। যদিও মামা-মামী দু'জনই যথেষ্ট অন্তরিক। তারপরও এই সাত সকালে কারও বাসায় আসাটা কেমন যেনো... এইসব ভাবতে ভাবতে কলিং বেলে চাপ দেয় আকিফ।
কিছুক্ষন পর ওপাশ থেকে প্রশ্ন আসে- কে?
- জ্বী..আমি। আমি আকিফ।
- কোন আকিফ?
অনেকটা আন্দাজের উপার ভর করে বললাম-
- মামা..আমি রাজশাহীর আকিফ।
খুট করে দরাজা খুলে গেলো। অনুমান মিথ্যে হয়নি।
মামাকেই পেলাম দরজার ওপারে। খুব একটা পরিবর্তন হয়নি চেহারার। আগের সেই তারুণ্যের জায়গায় হালকা একটা বয়সের ছাপ। মামার চোখে চোখ পড়তেই সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করলাম। মামা আলতো করে হেসে বললে...
- আরে ভাগনা যে!!! কতদিন পর দেখলাম।
অনেক বড় হয়ে গেছো দেখছি। আসো ভিতরে আসো।
মামাকে অনুসরণ করে ভিতরে ঢুকলাম। বাসাটাও আগের মতোই আছে। বাবা-মা'র সাথে যখন আসতাম।
সারাদিন থেকে রাতে নানার বাসায় চলে যেতাম। অতটা চঞ্চল না হওয়ার কারনে এই বাসার ড্রইং রুমটা ছাড়া আর কোন রুম-ই ভালো করা জানা হয়নি কোনদিন। মামা একটা রুম দেখিয়ে বললেন--
- হাছনার ( আমার মা) সাথে আমার কথা হয়েছে। এটা তোমার রুম। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।
নাস্তার টেবিলে কথা হবে। আমি ঘাড় নেড়ে বললাম ঠিক আছে। ব্যাগটা বিছানায় রাখলাম। মাথায় শুধু একটা শব্দ আসলো- সময়। সময়ের সাথে সাথে কত কিছুই না বদলে যায়।
বদলায় আপন মানুষগুলোও। সময়ের ঘূর্ণিচক্রে আপন মানুষগুলো পর, আর দূরের মানুষগুলো আপন হয়ে যায়। সেই সময়ের ঘূর্ণিচক্রে আজ নিজের আপন মামারা থাকতেও আমি মায়ের চাচাতো ভাইয়ের বাসায়।
সারারাত জার্নির ফলে কেমন যেনো অস্বস্তি লাগছিলো। তাই গোসলটা সেরে ফেললাম।
বেশ ফুরফুরে লাগছিলো নিজের কাছে। মা'কে একটা ফোন দিয়ে জানালাম আমি ঠিক মতো এসেছি মামার বাসায়। মা, মামার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। মা'কে বললাম পরে কথা বলো মামা কাছে নেই। ফোনটা রাখতেই মামীর গলা শুনলাম- সবাই নাস্তার টেবিলে এসো।
যাবো কি যাবোনা করতে করতে দেখে মামী-ই রুমে এসে হাজির। মামীকে সালাম দিতেই বলে উঠলেন-
- কেমন আছো বাবা? সারারাত জার্নি করে আসছো কষ্ট হয়নি তো? আমি রান্নাঘরে নাস্তা তৈরী করছিলাম । তাই ভাবলাম সব রেডী করে নাস্তার টেবিলেই সব কথা শুনবো। চলো নাস্তাটা সারতে সারতে কথা হবে। আমি চুপচাপ মামীকে অনুসরণ করে টেবিলে গিয়ে বসলাম।
মামা ও আমার দুই মামাতো ভাই-বোন তাসনিয়া ও তরুনকে নাস্তার টেবিলে পেলাম। বেশ বড় হয়ে গেছে দু'জনই। তাসনিয়া ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য কোচিং করছে আর তরুন একটা বেসরকারী ভার্সিটিতে থার্ড ইয়ারে আছে। মামা খুব রসিক মানুষ। মামীও যথেষ্ট আন্তরিক।
আজ কালকের যুগে এমন মানুষ পাওয়া খুব দুষ্কর। তাসনিয়া আর তরুনকে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি কারন ওদের সাথে খুব একটা মেশা হয়নি। তবে মা-বাবা যেহেতু এমন,তারাও এর ব্যতিক্রম হবে না।
আজ বন্ধের দিন হওয়াতে সবাই আস্তে ধীরে এক সাথে নাস্তা করছে বুঝলা। তা না হলে এই যান্ত্রিক শহরে সবাই ব্যস্ত।
ইন্টারভিউ কবে?? মামার প্রশ্নে নীরবতা ভাঙ্গলো।
- আগামীকাল যেতে বলেছে। সকালের দিকেই যাবো।
- তোমার বাবা আমার অনেক পছন্দের একটা মানুষ ছিলেন। উনার মতো এতো সৎ মানুষ আমার জীবনে আমি খুব কম দেখেছি।
শত কষ্টের মাঝেও উনার স্বচ্ছ চিন্তাধারায় আমি মুগ্ধ হতাম। উনি তোমার পড়ালেখার ব্যপারে খুব সচেতন ছিলো।
- জ্বী মামা। বাবা'র জন্যই মাষ্টার্সটা শেষ করতে পেরেছি। অথচ উনার জন্য কিছুই করতে পারলাম।
এখন মায়ের জন্য কিছু করতে চাই।
মায়ের কথা উঠতেই মামী বলে উঠলেন-
- তোমার মা'ও অনেক কষ্ট করছে তোমাদের জন্য। বাবা'র জন্য কিছু করতে পারো নাই এমনটা ভেবো না। বেশী বেশী দোয়া করো। দোয়া করি ভালো একটা চাকুরী পাও তারপর মা'কে নিজের কাছে নিয়ে আসো।
মায়ের জন্য করলেই বাবার জন্যও করা হবে।
- দোয়া করবেন মামী। আমিও এমনটাই ভাবছি।
অনেক কথাবার্তার সাথে নাস্তা পর্ব শেষ হলো। মামার কি যেনো কাজ আছে তাই বেরিয়ে গেলেন।
মামী গেলেন রান্নাঘরে। তরুন আমায় নিয়ে গেলো তার রুমে। তাসনিয়া গেলো মামীকে সাহায্য করতে। এরই মাঝে তরুনের সাথে বেশ খাতির হয়ে গেলো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাসনিয়াও এসে আমাদের আড্ডায় সঙ্গ দিচ্ছিলো।
একটা ব্যাপার খুব মজা লাগলো ওদের ভাই-বোনের সম্পর্ক খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ এবং ওরা দু'জনেই আমাকে বেশ আন্তরিকভাবে নিয়েছে। যতটা অস্বস্তি লাগবে ভেবেছিলাম এখন আর লাগছে না। ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁধুর দেখলে ভয় পায় আমার মনের অবস্থাও তাই। বিপদের সময় কাছের মানুষের কাছে যে ব্যবহার পেয়েছি তাই দূরের মানুষদের কাছে এতো ভালোবাসা,আন্তরিকতা পাওয়া আমার জন্য হাতের মুঠোয় চাঁদ পাওয়ার মতোই।
কিভাবে যেনো দিন পেরিয়ে রাত চলে আসলো বুঝলাম না।
রাতে খাওয়ার টেবিলে মামা জিজ্ঞাস করলো অফিস কোথায়? বললাম শান্তিনগর। সাথে সাথে তাসনিযা বলে উঠলো বাবা-
- কাল সকালে তো আমার কোচিং আছে। ভাইয়া তো শান্তিনগরই যাবে। আমি আর ভাইয়া এক সাথে যাই?
- মামী বললো ঠিক আছে যাস। তোর জন্য ওর আবার দেরী হয়ে যাবে না তো??
একা যেতে পারলেই খুশী হতাম কিন্তু ও নিজ থেকে যেতে চাওয়ায় আমি বললাম- না মামী,ওর ক্লাস যেহেতু দশটায় আর আমাকেও দশটার মধ্যে যেতে হবে।
আমার কোন সমস্যা হবে না। কথাটা শেষ করে নীরব সম্মতির আশায় তাসনিয়ার মুখের দিকে একবার তাকালাম। মুচকী একটা হাসি দিয়ে কি বোঝালো কিছুই বুঝিনি। খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে চলে আসলাম। প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র, কি পড়ে যাবো সব গুছিয়ে রাখলাম।
সকাল সকাল উঠে যাতে ঝামেলা না হয়। সব গুছাতে গুছাতে বাবার কথা খুব মনে পড়ে গেলো। বাবা সব সময় একটা কথা বলতেন-" কাজের জন্য চাই পূর্ব প্রস্তুতি। তাড়াহুড়োর কাজ কখনো ভালো হয় না। পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে কাজ অনেক সুন্দর হয়"।
বাবা সারাটা জীবন শুধু প্রস্তুতিই নিয়েছিলেন শুধু ফলটা উপভোগ করতে পারলেন না। মা'কে খুব মনে পড়ছে। অনেক রাত হয়ে গেছে তাই মা'কে আর ফোন দিলাম না। বিছানায় শুয়ে মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতে পারিনি।
তাসনিয়ার ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো।
উঠে গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে এসে রেডী হলাম। মা'কে একটা ফোন দিয়ে দোয়া চেয়ে নিলাম। নাস্তার টেবিলে আসতেই তাসনিয়ার কথা- বাহ!! পুরোপুরি জেন্টেলম্যান। দারুন হ্যান্ডস্যাম লাগছে। কালকের আপনার মাঝে আর আজকের আপনার তো বিরাট তফাৎ।
চিনাই যাচ্ছে না। ওর কথায় মুচকি হেসে বললাম-থ্যাংকস। নাস্তা সেরে মামা-মামীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দু’জন বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় নেমে ওকে জিজ্ঞাস করলাম- কিসে করে গেলে ভালো হয় বলো তো? সে বললো- রিকশা।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দেড়ঘন্টার মতো আছে তাই একটা রিকশা ঠিক করে উঠে পড়লাম।
রিকশায় উঠতেই তার প্রশ্ন পর্ব শুরু হলো। মনে মনে ভাবছি- যাচ্ছি জীবিকার যুদ্ধের প্রশ্নের সম্মুখিন হতে তুমি আবার কি শুরু করলা!!! মেয়েটাকে অল্প দেখাতেই কেন জানি ভালো লেগেছে। কিছু মানুষ আছে পৃথিবীতে,যাদের ক্ষনিক দেখাতেই ভালো লেগে যায়। তাসনিয়াও সেই দলের একজন। ভাইয়া...ডাকে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলাম
- কি বলো?
- আপনি এতো কি চিন্তা করেন?
- কই।
কিছু না তো।
- মিথ্যা বলেন কেন? সারাদিন চুপচাপ থাকেন। কি নিয়ে এতো ভাবেন বলেন তো আমায়?
- তোমার সাথে মিথ্যে বলে আমার লাভ কি,বলো? কিছু স্বপ্ন বুকে পুষে রাখছি। তাই চুপ করে থাকি। যেদিন স্বপ্ন পূরণ হবে সেদিন আর চুপ থাকবো না।
- কি স্বপ্ন বলবেন আমায়?
- তেমন কিছু না। খুবই সাধারন স্বপ্ন। প্রিয় মানুষগুলোর হাসি মাখা মুখ।
- আমি কি আপনার প্রিয় মানুষ? আচ্ছা আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন?
তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে শুধু ছোট্ট করে বললাম -হুম
- হুম মানে কি!! আমার উত্তর কই? বলবেন না আমায়?
- তুমি আমার প্রিয় মানুষ আর আমি একজনকে অনেক ভালোবাসি। আমার জীবনের চেয়েও বেশী।
তাসনিয়া কিছু না বলে শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমি তাকিয়ে ছিলাম আকাশপানে। আকাশের অসীমে যার বসবাস একমাত্র উনিই জানে ওর চিন্তায় আর আমার চিন্তায় কত পার্থক্য।
(চলবে) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।