এইতো! আগামী দিনে কেমন বাঙলাদেশ চাই/ এম আমির হোসেন
-----------------------------------------------------------
বাঙলাদেশে সামনে জাতীয় নির্বাচন। বিভিন্ন দল জনগণকে আকৃষ্ট করার জন্য নানা ধরণের প্রলোভন দেখাচ্ছে। সব জেনে বুঝেও জনগণ প্রলুব্ধ হবে, এবং ভোট দিতে যাবে। বাঙলাদেশ একটি চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। স্বপ্নহন্তারক শাসককে ভোট না দিয়ে তারা তাদের মনের অপ্রকাশিত ক্ষোভকে প্রকাশ করে।
ফলে চক্রাকারে এক দল পরাজিত হয়, আরেক দল ক্ষমতায় আসে। উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত আগুনে গিয়ে পড়ে জনগণ। কিন্তু এভাবে পাঁচ বছর পর পর সরকার পালটানো কি উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত? বাঙলাদেশে যেখানে রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, কলকারখানা ইত্যাদি ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল বিষয়গুলোর উন্নয়ন একটি লেভেল পর্যন্ত যায় নি, সেখানে যদি গণতন্ত্রের নামে পাঁচ বছর পর পর সরকার পালটাতে থাকে তবে দেশের মৌলিক উন্নয়ন কী করে হবে? আমি মনে করি, বাঙলাদেশের মৌলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল উন্নয়নের জন্য একটি প্রগতিশীল সরকার ন্যূনপক্ষে বিশ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকা দরকার। একটানা দীর্ঘ সময় মাহাথির মোহাম্মদের সরকার আজ মালয়েশিয়াকে কোথায় নিয়ে গেছে? ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশে প্রতি নির্বাচনে সরকার পালটালে সমস্যা নেই। তাদের একটা বেসিক লেভেল পর্যন্ত ডেভেলপমেন্ট হয়ে গেছে বহু আগেই।
বাঙলাদেশের উন্নয়নের জন্য যে যে বিষয়গুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি তা নিম্নে ধারাবাহিক ভাবে লিখছি।
ক) বিকেন্দ্রীকরণঃ বাঙলাদেশের সকল সেক্টর বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। বিভাগীয় শহরে জনগণের প্রয়োজনীয় কাজের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ যেন হয়ে যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। বিভাগীয় শহরগুলো অনেকটা প্রাদেশিক রাজধানীর মতো হবে। সেখানে পাবলিক, মেডিকেল, ইঙ্গিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে, প্রধান কোর্ট থাকবে, আলাদা স্বনির্ভর প্রশাসন থাকবে, নিয়োগ-উন্নয়ন-বাজেট সব আলাদা হবে, সেখানে টিভি-রেডিও-মিডিয়া আলাদা থাকবে।
কেন্দ্রীয় সরকার থেকে শুধু একজন নিয়োগপ্রাপ্ত গভর্ণর থাকবে যার কাজ হবে মূল সরকারের সাথে সমন্বয় করা। প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা হলে ভালো হয়, তা করা না গেলে বিভাগীয় নির্বাচিত এমপিদের থেকে একজন প্রধান সমন্বয়ক থাকা উচিৎ। বিভাগ কেন্দ্রীক যাবতীয় উন্নয়ন হবে। অন্যান্য বিভাগের সাথে উন্নয়ন নিয়ে একটি প্রতিযোগিতার ভাব তৈরি করতে হবে।
খ) দুর্নীতি হ্রাসকরণঃ দুর্নীতি বাঙলাদেশের একটি প্রধান সমস্যা।
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুর্নীতি হ্রাস করার পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগ করলে, বড় বড় সরকারি প্রজেক্টগুলোর হিসাব মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ করলে, রাজনীতিবিদ-আমলাসহ গুরুত্বপূর্ণ সবার আয়ব্যয়ের হিসাব, ইনকাম টেক্সের হিসাব জনগণের কাছে প্রকাশিত করলে দুর্নীতি বহুলাংশে হ্রাস পাবে। একমাত্র পিএসসি কর্তৃক নিয়োগ ছাড়া সকল সরকারি চাকরি অস্থায়ী হওয়া উচিৎ। সবার জন্যই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। পারফর্মেন্সের উপরে চাকরি রিনিউ হবে।
সরকারের অপ্রয়োজনীয় বিভাগগুলো বিলুপ্ত করতে হবে, লোকবল কমিয়ে কোয়ালিটিফুল লোকবল যেন যে কোন সময় সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি চাকরিজীবীদের উচ্চ সুবিধাও দিতে হবে, এবং বড় দুর্নীতিবাজদের প্রমাণিত দুর্নীতির ক্ষেত্রে দৃশ্যমান শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।
গ) বেসরকারি খাত উন্নয়নঃ বাঙলাদেশে বর্তমানে যতটুকু উন্নয়ন দৃশ্যমান তার একটি প্রধান অবদান বেসরকারি খাতের। বেসরকারি খাতকে প্রতিদ্বন্ধী না ভেবে বন্ধু ভাবা উচিৎ সরকারের। বাঙলাদেশে কারো উপকার করার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো তার ‘অপকার না করা’।
এই নীতি এ দেশের নীতিনির্ধারকগণ মেনে চললে এ দেশ এমনিতেই তরতরিয়ে বেড়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস। বাঙলাদেশে ব্যক্তি ও বেসরকারি পর্যায়ে যে উন্নয়ন দৃশ্যমান তা সত্যই বিস্ময়কর। বাঙলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর, প্রাইভেট ভাবে বেড়ে উঠা ব্যাংকিং সেক্টর, টেলিকমিউনিকেশন, ফার্মাসিউটিক্যালস সেক্টরে লক্ষ লক্ষ লোক চাকরি করে সুন্দর ভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে, যা কিছুদিন আগেও ছিলো অসম্ভব কল্পনা। ধীরে ধীরে জীবন যাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। আর বেশির ভাগ উন্নয়নই হচ্ছে প্রাইভেট সেক্টরে।
মানুষের আয় বাড়াতে সেবাখাতগুলোও বিকশিত হচ্ছে। প্রাইভেট সেক্টর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো যদি এতোটা উৎপীড়ক না হতো তাহলে এ দেশের উন্নয়নের গতি আরও বৃদ্ধি পেতো। তাই বেসরকারি খাতের উন্নয়নবান্ধব নীতি সরকারের গ্রহণ করা উচিৎ।
ঘ) যোগাযোগ খাত উন্নয়নঃ কোন গ্রামে একটি নতুন সড়ক তৈরি করলে ঐ গ্রামের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠে। বেকার ছেলেরা রাস্তার পাশে মোবাইল কার্ডের দোকান দেয়, চায়ের দোকান দেয়, বাজার গড়ে উঠে, কৃষক সহজেই কাঁচামাল উপজেলা সদরে পৌঁছাতে পারে তথা মানুষ উৎপাদনমুখী হয়।
অর্থনীতি গতি প্রাপ্ত হয়। সকল হাইওয়ে গুলো চার লেন করা উচিৎ এবং হাইওয়ের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা উচিৎ। তাহলে যোগাযোগের গতি বৃদ্ধি পাবে ও দূর্ঘটনাও কমে আসবে। হাইওয়ের ডিভাইডার বরাবর রেল চলাচলের লাইনও করা যায়। রেল খাত সাশ্রয়ী, মানুষ ও মালামাল পরিবহণে আমাদের দেশের জন্য সবচে ভালো উপায়।
ব্রিজ-কালভার্টগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্মাণ ও উন্নয়ন করা উচিৎ।
ঙ) রাজধানী উন্নয়নঃ একটি রাষ্ট্রে মূল কেন্দ্র হলো রাজধানী। রাজধানী ঢাকায় যানজটসহ হাজারো নাগরিক সমস্যা বিদ্যমান। এর কারণ জনসংখ্যার আধিক্য ও পরিকল্পনার অভাব। রাজধানী থেকে ক্যান্টনমেন্ট, পিলখানা, জেলখানা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো নিকটবর্তী কেরানিগঞ্জ, গাজিপুর, পুর্বাচল, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে সরিয়ে নেয়া উচিৎ।
গার্মেন্টস সহ অন্যান্য শিল্প কারখানার জন্য আলাদা শিল্পনগরী গড়ে তুলতে হবে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছাকাছি কিংবা মালয়েশিয়ার মতো আলাদা প্রশাসনিক অঞ্চল গড়ে তোলা দরকার। যানজট কমাতে হলে যেখানে চার রাস্তার সংযোগ স্থল সেখানে ছোট ছোট ফ্লাইওভার করতে হবে যেন গাড়ি আটকে না থাকে। পারসোনাল নয়, বরং গণপরিবহনের মান উন্নত করা জরুরী।
চ) নাগরিক নিরাপত্তা ও সুশাসনঃ সামাজিক নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এর অভাববোধের কারণে অনেক সুশিক্ষিত মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-সামাজিক পরিচয়-রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে সবার সমান নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না থাকলে মানুষ হতাশ হয়, পুরোপুরি উৎপাদনমুখী হয় না; নিজের সৃজনশীলতা বিকশিত করে না যা রাষ্ট্রের জন্যই আত্মঘাতী।
ছ) রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধিঃ শিল্প কারখানা গড়ে তুললে, উন্নয়নমুখী বেসরকারি খাতকে আন্দোলন-হরতাল-ধর্মঘটের আওতামুক্ত রাখলে, ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ ও আধা-দক্ষ জনশক্তি বাইরে রপ্তানি করলে, পর্যটন খাতকে বিশেষ অঞ্চল ঘোষণা করে বিকশিত করলে রাষ্ট্রের আয় অনেক বৃদ্ধি পাবে। মানুষের লুকানো কালো টাকা সরকারি খাতে বিনিয়োগ করে মার্জনাসহ সাদা করার সুযোগ দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, টাকা হচ্ছে রক্তের মতো; রক্ত জমাট বাঁধলে যেমন স্ট্রোক হয়, তেমনি টাকা অলস পড়ে থাকলেও একটি দেশের অর্থনীতির স্ট্রোক করে। গ্রাম থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে হবে।
বাঙলাদেশ আমাদের সবার। একটি বিশেষ দল কিংবা গোষ্ঠির নয়। ‘রাজা যায়, রাজা আসে’—জনগণ সেই একই বৃত্তেই পড়ে থাকে।
পাঁচ বছর পর পর সরকার পালটানোই সমাধান নয়। দেশের উন্নয়নই আসল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ আমাদের। আর একটি কথা, দেশের উন্নতি হবে প্রগতির পথে, কোন প্রকার মৌলবাদী পথে নয়। আমাদের শিক্ষা হতে হবে অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিকতামনস্ক। অসাম্প্রদায়িক ও উদার গণতান্ত্রিক পথে এ দেশকে এগিয়ে যেতে হবে।
সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল উভয় দলই হবে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি। এর ব্যত্যয় হলে উন্নয়নকামী আগামী প্রজন্মের কাছে তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এই উন্নত মিডিয়া ও ইন্টারনেটের যুগে নতুন প্রজন্ম এখন অনেক সচেতন। ধীরে ধীরে এই প্রজন্মের হাতে রাজনীতিকে ছেড়ে দিতে হবে। রাজনীতি কোন গভীর তাত্ত্বিক বিষয় নয়, সময়োপযোগী রাষ্ট্র পরিচালনার একটি প্রক্রিয়া মাত্র।
অতি-তাত্ত্বিকতা দিয়ে রাজনীতি হয় না।
বর্তমানে শহরকেন্দ্রীক শিক্ষিত বাঙলাদেশি তরুণরা মূলত দ্বিতীয় প্রজন্মের যাদের পিতা-মাতারা কিছুটা শিক্ষিত এবং যৌবনে শহরে এসে লেখাপড়া, চাকরি-বাকরি করে তাঁদের সন্তানদের মানুষ করেছেন। এইসব শিক্ষিত তরুণদের বেশির ভাগের দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানি ছিলো গ্রাম-কেন্দ্রীক ও মূলত চাষ-বাস করে জীবিকা নির্বাহ করতো। প্রথম প্রজন্ম শহরে অস্তিত্বের জন্য যে কোন উপায়েই জীবন গড়ে নিয়েছেন এবং তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন। দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষিত এই তরুণ অংশটির জন্ম ও বিকাশ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে।
কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদ-আমলা-নীতিনির্ধারকগণ এখনো প্রথম প্রজন্মেরই রয়ে গেছে। তাই তাদের মানসিকতা এখনো শিক্ষিত শহুরে প্রজন্মের মতো হয় নি এবং তারা তাদের অস্তিত্ব নিয়ে সর্বদা সন্দেহে ও সংঘাতে থাকেন। নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে প্রথম প্রজন্মের রিটায়ার করার সময় আসতে আর বেশি দিন বাকি নেই। এর পর পদ্ধতি ও নীতিনির্ধারণ ঠিক হবে দ্বিতীয় প্রজন্ম দ্বারা। দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকে শুরু হয় স্থিতিশীল উন্নয়নের প্রক্রিয়া; এবং তৃতীয় কিংবা চতুর্থ প্রজন্ম থেকে মৌলিক উন্নয়ন ও জ্ঞান উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
আগামী দিনের বাঙলাদেশ হবে ‘অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল বাঙলাদেশ’ যখন এই দ্বিতীয় প্রজন্ম সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্বে আসবে । রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারক হিসাবে তাদের প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবি। নেতৃত্ব আসতে হবে তাদের মাঝ থেকে, এবং আসবেই। কয়েক প্রজন্ম আধুনিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে না গেলে প্রকৃত ঔজ্জ্বল্য আসে না, কোন জাতি জাতে উঠে না!
তাই আগামী দিনের বাঙলাদেশ নিয়ে আমি হতাশ হতে রাজি নই। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।