আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাজেট কেন হয় না গণমুখী?

শফিক হাসান বাজেট নিয়ে হাস্যরসাত্মক উক্তির কমতি নেই। তার মধ্যে একটি হচ্ছে-বাজেট পাস হলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। জাতীয় অর্থনীতিতে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। তাহলে আর বাজেট প্রণয়নের দরকার কী! এ উক্তি শ্লেষাত্মক হলেও এটা ফেলে দেয়ার উপায় নেই; কথা তো ঠিকই! বাজেট পাস না হলেই যদি বাজার ‘হাতের নাগালে’ থাকে তাহলে বাজেট পাস না হলেই তো ভালো! বাজেট পাস মানেই জিনিসপাতির দাম হু হু করে বাড়া, জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়া। এই বর্ধিত মূল্যের ঠেলা সামাল দিতে গিয়ে মানুষের জীবনযাপন আরো দুর্বিষহ হয়ে ওঠা...।

প্রতিবারই বাজেট ঘোষণার পর দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব পড়ে। সৃষ্টি হয় অসহনীয় ধরনের অস্থিরতার। মূল্যের আঁচে হাত পুড়ে যায়। বাজেটের আবার দুইটি রূপ-সরকারি দলের কাছে গণমুখী আর বিরোধী দলের কাছে গরিব মারার বাজেট! সরকারি দল আর বিরোধী দলের কুতর্কে না গিয়েও বলা যায়, বাজেট অনেকাংশে গরিব মারারই। গরিবদের চেয়ে ধনীদের সুবিধাই বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রায় প্রতিবারই হাস্যকরভাবে বিলাস দ্রব্যের দাম কমে, আর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশচুম্বী করে দেয়ার একটা সযত্ন প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। যে দলই বাজেট ঘোষণা করুক না কেন-এর ব্যত্যয় নেই। কারণ রাষ্ট্র সবসময়ই সবলদের সমঝে চলতে চায়। পাত্তিঅলা লোকদের পাত্তা দিয়ে চলতে হয়, কোনো এক (বা একাধিক) গূঢ় কারণে। গরিব মানুষদের দরকার শুধু নির্বাচনের সময়।

এর বাইরে নয়। সুতরাং ওদের নিয়ে এতো ভাবাভাবির কী আছে? ভোট না দিয়ে যাবেই বা কোথায়! বাজেট পাস হয়েছে কি হয়নি, ব্যবসায়ীদের তর সয় না-নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রে দাম খুব তাড়াতাড়িই বাড়িয়ে দেন তারা। প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে। এমনকি যেসব দ্রব্যের মূল্য কমানো হয়, সেগুলোর মূল্য ব্যবসায়ীরা না কমালেও বাড়তি মূল্য আদায়ে তৎপর ষোলো আনা! ভোক্তার অধিকার কখনোই সংরক্ষিত হয় না। না সরকার পক্ষ থেকে, না ব্যবসায়ী বা অন্য কোনো পক্ষ থেকে।

এই তো কিছুদিন আগে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হলো। এতে বাড়লো পরিবহন ব্যয়। মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে পরিবহন ভাড়া নিয়ে যে ক্যাঁচাল শুরু হয়েছে সেটা চলছে এখনো। প্রায় প্রতিদিনই যানবাহনের যাত্রীর সাথে পরিবহন শ্রমিকদের ঝগড়াঝাটি, বাদানুবাদ হচ্ছে। সরকার তরফ থেকে এই করবো সেই করবো বলে হুংকার দেয়া হলেও শেষপর্যন্ত সব ঠিক।

সবলরাই সবসময় জয়ী, সুতরাং পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের হাতে যাত্রীরা আরো বেশি নিষ্পেষিত হবে-এটাই তো স্বাভাবিক! এই অস্থিতিশীল অবস্থা কাটার আগেই যদি বাজেটে নতুন নতুন ক্যাঁচালের সূত্রপাত হয় তা হবে দুঃখজনক। নির্বাচনোত্তর কালে দ্রব্যমূল্য সহনশীল রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ সরকারের প্রথম শাসনামলে সন্ত্রাস এবং দুর্নীতির প্রচুর ‘কাটতি’ থাকলেও তারা সফল হয়েছিলো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে। কৃষিখাতে অর্জিত হয়েছিলো লক্ষ্যমাত্রা। যার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের জনপ্রিয়তা ছিলো তুঙ্গে।

মানুষ বলতে সাধারণ মানুষ, প্রান্তিক শ্রেণির। এদেশে সাধারণ মানুষ তথা নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যাই যে বেশি-বলার অপেক্ষা রাখে না। এদের ভোটই রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। (যদিও রাজনৈতিক দলগুলো এটা মাথায় রাখে বলে মনে হয় না)। উত্থান-পতনে জোরালো ভূমিকা রাখে প্রান্তিক মানুষরাই।

এদের সাথে যুক্ত হয় তরুণ প্রজন্ম। এবারের বাজেট যদি ‘গরিব মারার বাজেট’ই হয় তাহলে আওয়ামী লীগের কপালে খারাবি আছে। এতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার হারাবে জনপ্রিয়তা এবং দলটি আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার সুযোগ নাও পেতে পারে। এ সুযোগে জায়গা নেবে বিএনপি-জামাত জোট। রাজাকার, মৌলবাদের উত্থানে যা সহায়ক।

স্বাধীনতাবিরোধীদের আবার ক্ষমতায় দেখতে চায় না সাধারণ মানুষ। আওয়ামী লীগের উচিৎ হবে সস্তা বাগাড়ম্বরে না গিয়ে সময়োপযোগী বাজেট প্রণয়ন করা-যে বাজেটে অবশ্যই গরিব মানুষের স্বার্থ প্রতিফলিত হবে। ফুটে উঠবে তৃণমূল মানুষের আশা-আকাঙক্ষার চিত্র। এমনটি করতে পারলে সরকারি দলের জন্য যেমন মঙ্গল, তেমনি দেশের জন্যও। এই বাংলাদেশের জন্য আওয়ামী লীগের অবদানই সবচেয়ে বেশি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাটা জীবন সংগ্রাম করেছেন এদেশের জন্য। মাটি ও মানুষের তরে নিবেদিত থেকেছেন। অথচ তাঁর অকালমৃত্যু হয়েছে এই দেশেরই কিছু মানুষের হাতে। তিনি শাসন ক্ষমতায় থাকাকালীন। শাসক হিসেবে তাঁর ব্যর্থতা থাকতে পারে, রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত থাকতে পারে কিন্তু তিনি যে অকৃত্রিম বাংলাদেশপ্রেমী, নির্লোভ মানুষ এতে কোনো সন্দেহ নেই।

পৃথিবীর সফল রাষ্ট্রনায়কদের অন্যতমও বটে তিনি। কিন্তু সফল নেতা সবসময় সফল শাসক নাও হতে পারেন। এ দুই সত্তা একত্রে মেলানো হয়তো কঠিন। নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে কিন্তু শাসক হিসেবে তাঁর সফলতা প্রশ্নবিদ্ধ। অবশ্য তখনকার যে পরিস্থিতি, সে পরিস্থিতি মোকাবেলা কঠিন ছিলো।

যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে হাজারো রকম সমস্যা। সে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগার কথা। সেই সময়টুকু তিনি পাননি। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়াও সম্ভব হয়নি। যার ফলে প্রাণ দিতে হলো মতিচ্ছন্ন দেশীয় হানাদারদের হাতে।

তাঁর মৃত্যুতে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানুষ যেভাবে ফুঁসে উঠেছিলো, সেভাবে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম বা প্রতিবাদ হয়নি বললেই চলে। আসলে নিরন্ন মানুষের কাছে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মহান ব্যক্তিত্বের মূল্য নেই বললেই চলে। শাসক হিসেবে তিনি সফল হতে পারেননি, এই একটি ব্যর্থতার নিচে চাপা পড়ে গেছে তাঁর যত সফলতা। যাবতীয় অর্জন। কোনো সরকার যখন ক্ষমতার স্বাদে মত্ত হয়ে ওঠে, একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিতে থাকে; মানুষের জীবন দিন-দিন কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলতে থাকে তখন এ-কথা আমাদের স্মরণ করতে হয়।

ব্যর্থ শাসকের প্রতি জনগণ বড় নির্মম। নিজেদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়, তখনই মানুষ বাধ্য হয় কঠোর হতে। প্রাক্তন কবি (!) স্বৈরশাসক এরশাদ এটা অস্থিমজ্জায় বুঝেছেন। দেশপ্রেমিক মানুষ চাইবে, সরকার সঠিক পথেই থাক। কোনোভাবেই যেন লাইনচ্যুত না হয়।

বিশেষ করে দেশটাকে নিয়ে যারা ভাবেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বিষয় এড়িয়ে যেতে পারেন না, তারা নির্ভর করতে চান আওয়ামী লীগের ওপরই। যদিও বাস্তবিক পক্ষে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি’র মধ্যে বড় কোনো তফাৎ নেই। একই মুদ্রার এ-পিঠ ও-পিঠ। তবু মানুষ এখনো আওয়ামী লীগের ওপর কিছুটা হলেও ভরসা করে। কারণ তাদের সাথে রাজাকার জোট নেই।

যারা চায়নি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হোক। একাত্তরের ঘৃণিত রাজাকারদের সাথে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লোভে জোট বেঁধেছে বিএনপি তথা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। অবশ্য এ জোট একবার পেয়েছিলোও ক্ষমতার স্বাদ। সেই স্বাদ আবার পেতে তারা আঁচল আর পাঞ্জাবির খুঁট দিয়ে গেরো বেঁধেছেন। এগিয়ে চলেছে তাদের দ্বৈরথ।

এ জোটের শাসনামলে মানুষ দেখেছে জঙ্গিবাদের উত্থান, অস্ত্রের ঝনঝনানি। দেশপ্রেমিক মানুষ নিশ্চয়ই আবার জঙ্গিদের মদদদাতা ও বর্ণচোরাদের ক্ষমতার মসনদে দেখতে চাইবে না। তারা ক্ষমতায় যাবে কি যাবে না, এটা এখন যতটা না নির্ভর করছে ভোটারদের ওপর তার চেয়ে বেশি নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের ওপর! আওয়ামী লীগের শাসন যদি সঠিক পথে অগ্রসর হয়, তারা গণমানুষের আস্থা অর্জন করবে। আর বেঠিক হলে ইতিহাসের নির্মম পরিণতি বরণ করার জন্য তৈরি থাকতে হবে। জনরায় ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়, কিন্তু সবসময় সেটা পারা যায় না।

যার প্রমাণ এর আগে দেশবাসী দিয়েছে। তারাও বুঝেছেন জনতার বিপক্ষে দাঁড়ানোর মানে। ষড়যন্ত্র বা দুর্নীতির ক্ষমতা প্রচুর কিন্তু এগুলো সবসময় ঠিকঠাকভাবে কাজ নাও করতে পারে। এগুলো ব্যবহারের সুযোগ নাও পাওয়া যেতে পারে। সুখের কথা হচ্ছে, এবারকার আওয়ামী লীগ আগের চেয়ে সহনশীল।

উল্টাপাল্টা কাজ করে কিছু বিতর্কে জড়ালেও নতুন কোনো গডফাদারের উত্থান হতে দেয়নি এবার। নেত্রী নিজেও সস্তা ডিগ্রি সংগ্রহের মানসিকতার পরিবর্তন করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন। এগুলো অবশ্যই ইতিবাচক দিক। অবশ্য এখানেই থমকে থাকলে চলবে না। ইতিবাচক দিকগুলোকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে হবে।

ইতিহাস অনুযায়ী বোঝা যায়, বাজেট মানেই বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। হযবরল। বাজেটে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার যে পরিবর্তন আসে সেটা যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নামবে। আর জনপ্রিয়তায় ধস নামা মানেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানে যে রাষ্ট্র ক্ষমতা তদারকির অধিকার থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া-বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইমেইল : ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.