বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ মন মানুষ আছে ঢাকা
খোঁজ করলে পাবে দেখা;
শক্ত কইরা তারে ধরো রে ...
মুর্শিদে দিলে ঠাঁই
মিলবে আকাশের চাঁদ
পাপ যন্ত্রণা যাবে ঘুচে রে ...
এই গানটি ফিরোজ শাঁইয়ের কন্ঠে সেই সত্তরের দশকের শেষে আশির দশকের শুরুতে শুনতাম। কথার মানে আর কি বুঝতাম-আমরা তখন ছোট ছেলে। স্কুলে পড়ি।
ফিরোজ শাঁই আমাদের চামেলিবাগেই থাকতেন, তাঁকে অনেকবারই সামনাসামনি দেখেছিও; তবে তাঁকে সাদাকালো টিভিতেই দেখেছি বেশি। আজ তাকে কাছে পেলে গান সম্বন্ধে যে সব প্রশ্ন করতাম, সেসব প্রশ্নের উদয় তখনও আমার মাথায় হয়নি । ‘মন মানুষ আছে ঢাকা’ - বলতে ঢাকা শহরকেই বুঝতাম, ঢাকা মানে যে hidden; সেটি তখনও বুঝতাম না। ওই গানের আরও একটি শব্দও ভুল জানতাম। শব্দটি হল ‘দিল্লীশ্বরে’।
ফিরোজ শাঁইয়ের গানটির প্রথম দুটো পঙতি এরকম:
মন তুই চিনলি না রে, দেখলি না রে
মন মানুষ বিরাজ করে আমার দিল্লীশ্বরে ...
ওই ‘দিল্লীশ্বরে’ শব্দটাকে আমি মনে করতাম ‘দিল্লী শহরে’। আমি এও ভাবতাম: এত জায়গা থাকতে ‘মনের মানুষ’ কেন দিল্লী শহরে বিরাজ করেন। ঢাকা শহরে বিরাজ করেন না কেন? ফিরোজ শাঁই তো ঢাকা শহরের চামেলীবাগে বাস করেন। তাহলে? পরবর্তীকালে ‘দেল-কোরান’, ‘হেরা-বৃন্দাবন’ ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে। এবং লালনের গানের মারফত জেনেছি-
হাতের কাছে হয় না খবর
কি দেখতে যাও দিল্লী লাহোর ...
তবে আজও যেন ‘মন মানুষ বিরাজ করে আমার দিল্লীশ্বরে’-এই বাক্যটির তাৎপর্য অনুধাবন করতে আমি সম্পূর্ন ব্যর্থ।
‘দিল্লীশ্বরে’ শব্দটি কি ‘দিল- ঈশ্বর’ হবে? ওই ‘দেল কোরানের’ মতোই?
জানি না।
তবে জানতাম যে ফিরোজ শাঁই মাইজভান্ডারী গান করতেন। মাইজভান্ডার বলতে চট্টগ্রামের কোনও মাজার বুঝতাম। আমার ভুলও হতে পারে। অবশ্য তার চেয়ে বেশি কিছু বুঝতাম না।
ওই দিল-কাঁপানো গানটি কে লিখল, কে সুর করল- সেসব নিয়েও আমার কখনও মাথা ব্যাথা ছিল না। তবে গানের সুরটা টানত খুব, খুব গভীরভাবেই টানত। আজও টানে, আজও উতলা করে; জিন্দা বলেই টানে, জিন্দা বলেই উতলা করে। কিছু কিছু গান কখনোই মরে যায় না। ‘মহাকাল তারে বাঁচায় রাখেন।
’ ... তখনও আমি বুঝিনি যে - আমার মনের অজান্তেই আমার কৈশরেই আমার বাউলিয়ানায় কিংবা মারেফাতের দীক্ষা হয়ে যাচ্ছে । যে গান – নিঃসঙ্গ মুসাফিরের জিন্দা গান । যে গান একদিন মুসাফিরের দুরূহ সর্পিল পথে আলো ফেলবে। কাঁধে ঝুলি নিয়ে মুসাফির পথ চলতে চলতে গাইবে:
সুর্য্য যে ডুইবা যায়,
দিন যে তোর চইলা যায়
সময় থাকতে ডাকো আল্লার নামরে
মুর্শীদে দিলে ঠাঁই
মিলবে আকাশের চাঁন
পাপ-যন্ত্রনা যাবে মুছেরে !
গানটির লিঙ্ক
Click This Link
আমাদের শৈশবে ফিরোজ শাঁইয়ের আরেকটি মুসাফিরি গান শুনতাম:
স্কুল খুইলাছে রে মাওলা স্কুল খুইলাছে
গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী স্কুল খুইলাছে।
সেই স্কুলের এমনি ধারা মায়না ছাড়া পড়ায় তারা
সিনায় সিনায় লেখাপড়া শিক্ষা দিতেছে
গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী স্কুল খুইলাছে।
আমাদের কৈশরে ওই রকম বিস্ময়কর মাইজভান্ডারী গানের মধ্য দিয়ে আমাদের তাসাউফী (মারেফাত) দীক্ষা দিয়েছেন বলেই ফিরোজ শাঁই কে আজ আমার দীক্ষাগুরু বলেই মনে হয়। যে গানে বাংলার দার্শনিক ভাবজগৎটি সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে । যে ভাবজগতের দীক্ষা বাঙালির সহজাত। মধ্যযুগ থেকেই একতারা হাতে বাঙালির দীক্ষাগুরুরা নানারূপে নানা পন্থায় বাঙালিকে মারেফাত আর বাউলিয়ানার দীক্ষা দিয়ে চলেছেন। আজম খানও সত্তরের দশকে ইলেকট্রিক গিটার বাজিয়ে ওই একই দীক্ষা দিলেন:
আমি যারে চাইরে সে থাকে মোরই অন্তরে
কিংবা ...
ভক্তিতে মুক্তি জেনেছি এ সত্যি
বাসনা পূর্ণ হবে সাধনে।
লালন একতারা হাতে উনিশ শতকে মরমী গানের দীক্ষা দিচ্ছেন :
আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে
দিব্যজ্ঞানী সে হয়েছে
কুবৃক্ষে সুফল ফলেছে
আমার মনের ঘোর গেল না।
ছেলেবেলায় এ গানটি শুনলেও গানটির অর্ন্তনিহিত তাৎপর্যটি কখনোই বুঝে উঠতে পারিনি। আজও বুঝি কি না সে প্রশ্নও উঠতে পারে। তবে গানের একটা ছাপ যে মনের মধ্যে পড়েছিল, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই । আমরা আমাদের ছেলেবেলায় বাংলার মরমী সাধকদের কাছ থেকে এভাবে মনের অজান্তেই বাউলিয়ানায় কিংবা মারেফাতের পাঠ নিচ্ছিলাম, গভীরোতর আত্বতত্ত্বের পাঠ নিচ্ছিলাম।
আমরা একটি spiritual nation -এর অর্ন্তগত বলেই আমাদের অন্তরে মরমী দর্শনের অনিবার্য দীক্ষটি সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছিল। বাঙালি জাতি আপাদমস্তক spiritual । বাঙালি জাত বাউলা; তা যুগে যুগে বাঙালি যতই রূপ ধরুক না কেন । অধ্যাত্ববাদ তার রক্তে মিশে আছে। এ সত্য কোনও ভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।
বাঙালির রক্তে যে অধ্যাত্ববাদ মিশে আছে তার কারণটি হল: বাউলতত্ত্ব কিংবা তাসাউফের শিক্ষা বাঙালির শৈশবের চারিপাশে ছড়িয়ে থাকে। গানে গানে। রবীন্দ্রবাউলও তাঁর গানে ওই তাসাউফের শিক্ষাই প্রচার করেছেন ।
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে ...
এ রকম অসংখ্য উদাসী সংগীত রচনার কারণে রবীন্দ্রনাথকে সুফিসাধক বলা যেতেই পারে। আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে /তাই হেরি তায় সকল খানে ...এই বক্তব্যই তো, যতটুকু বুঝতে পারি, সুফিতত্ত্ব বা ইসমে আযম- এর সারকথা: যা একজন সঙ্গহীন মুসাফিরের পাথেয়।
আমরা কি প্রত্যেকেই নিঃসঙ্গ মুসাফির নই? সবাই আমরা তো ক্ষণিক সফরেই রয়েছি। সে সফর অনন্তকালের হলেও মানবজীবনে তার খন্ডিত রূপই তো প্রকাশ পায়।
নজরুল কেও তাঁর গানে সুফিসাধকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি।
হেরা হতে হেলেদুলে নুরানী তনু ঐ কে আসে যায়
সারা দুনিয়ার বেহেস্তের পর্দা খুলে খুলে যায়
সে যে আমার কামলিওয়ালা কামলিওয়ালা ...
নজরুল ইসলাম ইসলামের নবীকে ‘কামলিওয়ালা’ (কম্বল পরিহিত সুফি) বলেছেন। এতে করে যেন ইসলামের নবীর যথার্থ স্বরূপ উদঘাটিত হল।
আমাদের দেশে আরেকটি মারফতি গানে হযরত আলীকে মুর্শিদের সম্মান দেওয়া হয়েছে। আর তাতে করে গানটি যেন জিন্দা হয়ে গিয়েছে।
দয়াল বাবা কেবলা-কাবা আয়নার কারিগর।
আয়না বসায়া দে মোর কলবের ভিতর।
আমার বাবা আলহাছ (আলহাজ) আলী
যের (যার) কাছে মারফতের কলি
কলব হইয়া যায় নুরানী চাইলে এক নজর।
এ রকম সুগভীর আধ্যাত্বিক উপলব্দি অনেক বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদের ভাবনায় হয়তো অনুপস্থিত, যা বাংলার একজন শিক্ষাবঞ্চিত (অথচ প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত) গীতিকারের কাছে আমরা পেয়েছি। যা হোক। এই গানটি অবশ্য আমরা ছেলেবেলায় শুনিনি। শুনেছি, আরও পরে- নব্বুয়ের দশকে। তবে বলার কথা হল এইটাই যে, নজরুল তাঁর গানে ইসলামের নবীকে ‘ কামলিওয়ালা’ অবহিত করায় এবং এই গানে হযরত আলী কে পিতার মর্যাদা দেওয়ায় বাংলার মরমী ভাবজগতে চমৎকার একটি ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে ।
আমাদের ছেলেবেলায় ফকির আলমগীর-এর একটি রূপকধর্মী মাইজভান্ডারী গান তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
কামেলিরা কাম করিয়া কোথায় জানি লুকাইছে
দুই পাহাড়ের মাঝে মওলায় মসজিদ বানাইছে।
গানটির অর্ন্তগত অর্থ বোঝা ছিল আমাদের সাধ্যির বাইরে । তবে বন্ধুদের সঙ্গে গিটার বাজিয়ে গাইতে অনাবিল আনন্দের কখনও কমতি হয়নি । আমরা চিৎকার করে গাইতাম:
নদীতে জোয়ার হয় যখন
তিন প্রকারের পানি আছে
লাল কালা সাদা বরণ ...
(বহুকাল বাদে স্মৃতি থেকে উদ্বৃত করছি।
পঙতিবিন্যাসে গরমিল থাকা স্বাভাবিক)
এসব গানের শরীরে কোন্ কামেল পীর আল্লাহ্র নামে তাঁর রূহানী-ফুঁক দিয়ে দিয়েছিলেন কে জানে । তারপর থেকে যেন গান নিজেই জিন্দা (কালজয়ী?) হয়ে উঠেছে। কেবল শোনার ইচ্ছে হলেই হয়, গানটি আপনি থেকেই যেন বেজে উঠবে। এ বড় আশ্চর্যের কথা। আমাদের শৈশবজুড়ে এরকম অনেক আশ্চর্যজনক জিন্দা গান ছিল।
যে গান হয়ে উঠছিল ভবিষ্যতের নিঃসঙ্গ মুসাফিরের পথচলার অন্যতম অবলম্বন।
ছেলেবেলার আরেকটি প্রাণস্পর্শী গানের কথা মনে পড়ে:
ভালোবাস মানুষেরে
যদি চাও তুমি তারে
ও আমি কি পাবো তারে ...
আমরা এ ধরনের বহু জীবন্ত গানের ভিতর ছেলেবেলায় আকন্ঠ ডুবে ছিলাম। সচেতন ভাবে নয়, অসচেতন ভাবে। তখনও জানতাম না যে এরকম গান পৃথিবীর আর কোনও দেশেই বাজে না। কেবল বাংলায় বাজে, কেবল বাংলাদেশে বাজে।
তখনও জানতাম না যে এই জীবন্ত গানই অন্যান্য জাতি থেকে বাঙালিকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে । তখনও জানতাম না যে এই গানই বাংলাকে বিশ্বসভ্যতায় বাংলাকে বাংলাদেশকে ধনী ও জ্ঞানী করে রেখেছে। আজকাল এই ভেবে শিউড়ে উঠি যে -কার ইশারায় এমন ধনী মরমী গানে দেশে জন্ম হল আমার ? বিগত জন্মে আমি কি এমন পূণি করেছিলাম যে মানবজন্ম লাভ করে চন্দনা মজুমদারের কন্ঠে রাধারমের গান শুনলাম, ‘আমার বন্ধু দয়াময়/ তোমারে দেখিবার মনে লয়। ’ কিংবা শুনলাম বিজয় সরকারের, ‘জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটা কি। ’-এই চরম agnostic গান? ... আমরা ভাগ্যবান বলেই শৈশব থেকেই এসব ঐশ্বর্যশালী জীবন্ত গান শুনে বেড়ে উঠেছি।
আর মনের অজান্তেই শিখে নিয়েছি জীবন ও জগতের অর্ন্তলীন তত্ত্বকথাটি। জীবনের নিহিত সারকথাটি যেন আমাদের চেতনায় ক্রমশ স্পস্ট হয়ে উঠছিল। জীবনের সে সব গূঢ় তত্ত্বকথা সুরে আর বাণীর মধ্য দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছিলেন বাংলার মহৎ সংগীতগুরুরা। লালন, রবীন্দ্রনাথ, ফিরোজ শাঁই কিংবা ‘দয়াল বাবা কেবলা কাবা আয়নার কারিগর’- এর মহান রচয়িতাগন। এতকাল পরে জীবনের জরাজীর্ণ তোরঙ্গটি উলটে-পালটে দেখি কৈশরের ওই জীবন্ত গান এবং ওই জীবন্ত গানের সারমর্ম-যা আমার হৃদয়ে মিশে আছে- ওইটুকুনই জীবনের পরম প্রাপ্তি বলে মনে হয় ।
আর বাদবাকী সবই যেন আবছা কুয়াশার ভিতর দূর থেকে দেখা অস্পষ্ট বায়োস্কোপ ... এতকাল পথ চলার পর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার পর, ঝুরঝুরে মানবিক সর্ম্পকের অসারতা বুঝে আমাদের কারও কারও তো নিজেদের মুসাফির বলেই মনে হতেই পারে । পথ চলতে চলতে চারধারে যেন অচেনা ভাষায় বায়োস্কোপ দেখছে একজন বিমূঢ় মুসাফির। তার কেবলি মনে হয়: কৈশরের ওই সমৃদ্ধশালী মরমী জিন্দা গান মুসাফিরের দীর্ঘ পথপরিক্রমার অবলম্বন ছিল বলেই এতটা পথ আসা গেল! আজও ওই উদাসী ফকিরের জিন্দা গানই মুসাফিরকে জাগিয়ে রেখেছে । তার কারণ। সবাই ঘুমিয়ে গেলেও মুসাফিরকে তো জেগে থাকতেই হয়!
উৎসর্গ: রাইসুল জুহালা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।