তোমাকে ছাড়া বাচতে পারবো না..... আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অতীত এক ইতিহাস মাত্র। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্ব-অবদান স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরক্ষণেই ফুরিয়েছে। আত্মত্যাগী বীর শহীদদের উদ্দেশ্যে বছরের নির্দিষ্ট দিনে বাণী প্রচারে দায় মেটানো হয়ে থাকে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অতীতকে মুছে সামনে এগিয়ে যাবার দিক-নির্দেশনার নানা কথা আমরা শুনে থাকি। আমরা অবশ্যই সামনে এগিয়ে যাবো।
তবে সামনে এগিয়ে যাবার মূলেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-প্রেরণা। আমাদের সকল স্বপ্ন-সম্ভাবনা মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বিজয়ের আলোকেই। বিগত চল্লিশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনার ন্যূনতমও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং পিছিয়েছে চরমভাবে। পথভ্রষ্ট হয়েছে আমাদের কাঙিক্ষত স্বপ্ন এবং সম্ভাবনা।
সবই সম্পন্ন হয়েছে অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে। শাসনতন্ত্রের চার মূলনীতিও অক্ষত থাকেনি। অক্ষত থাকেনি সংবিধানও। গণতন্ত্র স্রেফ ভোটাধিকার প্রয়োগের গণতন্ত্রে পরিণত। সমাজতন্ত্রকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়েছে সংবিধান থেকে।
ধর্মনিরপেক্ষতা পাল্টে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এসেছে। সামরিক শাসকের সেই ফরমানটি নির্বাচিত সরকারগুলোও অক্ষুণ্ন রেখেছে সংবিধানে। আমাদের জাতীয়তাবাদী সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। ভাষাভিত্তিক সেই জাতীয়তাবাদ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়েছে। একে একে আমরা সবই খুঁইয়েছি।
আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারিনি। ক্রমশ পেছনে পিছিয়েছি। অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনায় অন্তর্গত। অথচ তার বিন্দু-বিসর্গও আমরা পূরণ-প্রতিষ্ঠা কোনটি করতে পারিনি। ব্যর্থতার পাল্লাটি ভারী হতে হতে ছিঁড়ে যাবার উপক্রম।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ বিরোধী ছিল। অথচ স্বাধীন দেশে বহুগুণ শক্তিতে ফিরে এসেছে যেমন সাম্রাজ্যবাদ তেমনি পুঁজিবাদও। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের দাসত্বের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ আমাদের শাসক শ্রেণী। যাদের হাতেই ঘুরে ফিরে পালাক্রমে রাষ্ট্র ক্ষমতার হাত বদল হয়ে চলেছে। রাজতান্ত্রিক রাজনীতির দাপটে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ নয়, বিনাশের পালা চলছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসও হয়েছে বিকৃত এবং দলীয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত সঠিক ও সত্য ইতিহাস। কত ত্যাগ আর আত্মত্যাগে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর গেরিলা চলচ্চিত্রটি দেখে অনেকেরই প্রশ্ন “সত্যি এত ত্যাগে-আত্মদানে-আমাদের স্বাধীনতা এসেছিল? পাকিস্তানিরা কি এত নিষ্ঠুর বর্বরতা-হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করেছিল”? গেরিলা ছবিটি না দেখলে তাদের মনে এমন প্রশ্নের উদ্রেক হয়ত হতো না। তাদের মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের ভাবনার ক্ষেত্র তৈরিতে গেরিলা ছবির অবদান অনস্বীকার্য।
তাদের এই ভাবনার তাগিদেই তারা জেনে নেবে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। যা তাদের জন্য এবং জাতির জন্যও ইতিবাচক ফল দেবে বলে আশাকরি।
এ যাবৎ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশে যে কয়টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে নিঃসন্দেহে গেরিলা ছবিটিই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। নির্মাতা নিজে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধে দিয়েছেন নেতৃত্বও।
তাঁর অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ গেরিলা হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ইতিহাস। গেরিলা ইতিহাস উপজীব্য কিন্তু ইতিহাস নয়। তবু গেরিলা মুক্তিযুদ্ধে ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনা কেন্দ্রীক বলেই হয়েছে ইতিহাসের অংশ। দর্শকদের মনোজগতকে নাড়িয়ে দিতেও হয়েছে সক্ষম। যাদের জন্ম একাত্তরের পরে তাদের প্রত্যেকের জন্য অসামান্য প্রাপ্তি হবে গেরিলা ছবিটি দেখা।
ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও বৃহৎ মুক্তিযুদ্ধের শিল্প রূপটি দেখে মুক্তিযুদ্ধকে তারা উপলব্দি করতে পারবে। আমাদের স্বাধীনতা কারো দয়া-ভিক্ষায় নয়। এসেছে জাতির বীর সন্তানদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগে। সমর পারদর্শী দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে।
মৃত্যু আতঙ্কের বিভীষিকাময় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জুড়ে হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছিল এদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ।
নিরাপদ ছিল না কারোরই জীবন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ গেরিলা ছবিতে ফুটে ওঠেছে নির্মোহ বাস্তবতায়। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের সকল প্রকার সহায়তা করেছিল। দেশবাসীর নিরঙ্কুশ সহযোগিতা ও সমর্থনে বিজয় লাভ সম্ভবপর হয়েছিল। দেশের ক্ষুদ্র অংশ মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী ছিল।
পাকিস্তানি হানাদার সহযোগী অক্সিলারি ফোর্স হিসেবে তারা করেছিল মানবতা বিরোধী অপরাধ। তাদের অপরাধের শাস্তি দেয়া সম্ভব হয়নি। সামরিক শাসন আর ক্ষমতা কেন্দ্রীক রাজনীতির নির্লজ্জতায় তারা চল্লিশ বছর নির্বিঘ্নে পার পেয়েছে। এখন তাদের বিচারের সম্মুখীন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মুখচেনা ক’জনকে আইনের অধীনে নেয়া হলেও তাদের বিচার ও শাস্তি নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
তাদের দুর্বল ভাবার কোন কারণ নেই। ক্ষমতার রাজনীতির নিয়ামক শক্তিরূপে তাদের অবস্থান যেমন দৃঢ় রাষ্ট্রযন্ত্রে তেমনি রাজনীতিতেও। বড় কথা হচ্ছে আমাদের আশা ভঙ্গের পাল্লাটা অধিক ভারী বলেই আশা-নিরাশায় দোলায় সংশয়ে ঝুলছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির বিষয়টি।
গেরিলা ছবিটি রাষ্ট্রীয় অনুদান পেয়েছিল। অনুদানের মাত্র ত্রিশ লক্ষ টাকায় ছবির ১০% কাজও সম্পন্ন হবার কথা নয়।
নির্মাতা কোনরূপ আপস করেননি ছবি নির্মাণে। তাই অধিক ব্যয়াধিক্য হয়েছে নির্মাণ ব্যয়। সেজন্য নিশ্চয় তাকে দ্বারস্থ হতে হয়েছে অনেকের কাছেই। ফরিদুর রেজা সাগর, ইবনে হাসান, এশা ইউসুফ, শহিদুল্লাহ খান বাদল, এ.কে.এম শামসুদ্দোহা, কাজি আলি হাসান প্রত্যেকের সহযোগিতায় নির্মাণ সম্ভবপর হয়েছে। আমরা দেখতে পেরেছি মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতায় উত্থিত গেরিলা।
আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী গেরিলা ছবির করমুক্তের ঘোষণা দিলেও তার কোন আলামত এযাবৎ দেখা যায়নি। করমুক্ত ছবির টিকেটের মূল্য নির্ধারিত মূল্য থেকে অনেক কম হবার কথা। দর্শক কম মূল্যে ছবিটি দেখার সুযোগ পাবে। অথচ করমুক্ত ঘোষণা দিয়েই সরকার দায়িত্ব শেষ করেছেন। সে বিষয়ে যথাযথ কর্তব্য পালন করেননি।
তাই দর্শকদের অতীতের মূল্যেই টিকেট ক্রয় করে ছবিটি দেখতে হচ্ছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কল্যাণে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি-স্থিতি ফিরে এসেছে। জীবন-যাত্রা স্বাভাবিক হয়েছে। এমন মিথ্যা প্রচার-প্রচারণার বিরুদ্ধে ঢাকা অপারেশন নামক গেরিলা যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। গেরিলা ছবিতে ঢাকা অপারেশনের কিছু বাস্তব ঘটনা সার্থকভাবেই নির্মাতা তুলে এনেছেন।
টান টান উত্তেজনা আর অসীম সাহসী বীরত্বপূর্ণ ঢাকা অপারেশন পাকিস্তানিদের মিথ্যা-প্রচার-প্রচারণার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্ব জানান দিতেও ঢাকা অপারেশন ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ নিজে ছিলেন ঢাকা অপারেশনের অন্যতম রূপকার। তবে গেরিলা ছবিতে তিনি নিজেকে আড়াল করেছেন। রেখেছেন ক্যামেরার পেছনে।
ঢাকা অপারেশনের ক’জন গ্রেফতারে বিপদজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ভয়াবহ নির্যাতনে মুখ খুলতে বাধ্য হয় গ্রেফতারকৃত মুক্তিযোদ্ধা ক’জন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বেপরোয়া সাড়াশি অভিযান চালায় সংশ্লিষ্টদের খোঁজে। পড়ন্ত বিকেলে ঝড়ের গতিতে নাসির উদ্দিন ইউসুফ নিজ বাড়িতে এসে পরিবারের সকলকে বলে যান-“আমাদের ক’জন সহযোদ্ধা ধরা পড়েছে। বাড়ি রেড হতে পারে।
সবাই সাবধানে থাকবেন। ” পরিবারের সবাইকে সাবধান করে দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন গভীর রাতেই নাসির উদ্দিন ইউসুফের খোঁজে পাক বাহিনীর বিশাল বহর পুরো বাড়ি ঘিরে বেপরোয়া তল্লাশী চালায়। পাকিস্তানি গোয়েন্দারা সন্ধ্যায় তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে রাতে তল্লাশী চালিয়েছিল। কিন্তু তার বেরিয়ে যাওয়াটা হয়ত দেখেনি।
পুরো বাড়ি-ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে না পেয়ে তার নিরপরাধ পাঁচ ভাইকে ধরে নিয়ে যায় শেরে বাংলা নগরস্থ টর্চার সেলে। সেই টর্চার সেল হতে বেশির ভাগই জীবিত ফিরে আসেনি। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার টেলিফোন আসে-“বাচ্চু কমাণ্ডারকে আমাদের হাতে তুলে দাও। আমরা এই পাঁচজনকে ছেড়ে দেবো। বাচ্চু বাচ্চা ছেলে, ভুল করেছে।
আমরা তাকে বুঝিয়ে শুধরে ছেড়ে দেবো। বাচ্চুকে নিয়ে আসো। একজনের জন্য পাঁচজনের ক্ষতি হলে সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ” তাদের যতই বলা হচ্ছিল বাচ্চু কোথায় জানি না। তাকে পেলেই তো আপনাদের হাতে তুলে দেবো।
নিরীহ-নিরপরাধ ঐ পাঁচজনকে দয়া করে ছেড়ে দিন। বাচ্চুকে পাওয়া মাত্র আপনাদের হাতে তুলে দেবো। ” কে শোনে কার কথা। সেনা কর্মকর্তা শব্দ করে টেলিফোন রেখে দেয়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নিদারূণ উৎকণ্ঠায় টর্চার সেলের বন্দীদশা থেকে বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে পাঁচজনকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল।
সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংকার, সদ্য বিদেশ ফেরত, মেডিকেল ছাত্র তারা ন্যূনতম সহানুভূতি পর্যন্ত পায়নি। পাক সেনার বুটের আঘাতের ক্ষত নিয়ে এখনও একজনকে খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছে।
ঢাকা অপারেশনের বীরযোদ্ধা অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ। রোজার ঈদের ক’দিন পূর্বে বায়তুল মোকাররম মার্কেটে বোমা বিস্ফোরণ করতে গিয়েছিল। গাড়িতে বোমা বিস্ফোরণের আনুষ্ঠানিক কাজ শেষে বাইরে তাকিয়ে দেখে অদূরে তার নানা।
নানার নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কর্তব্য পালনে সামান্য দ্বিধা না করে গাড়ি থেকে বের হয়ে দ্রুত নিরাপদ স্থানে বোমা বিস্ফোরণের অপেক্ষা করছিল। সেদিন কারিগরি ত্রুটিতে বোমাটি ফাটেনি। দ্রুত তারা গাড়ি নিয়ে স্থান ত্যাগ করে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান আসাদের নানা। এর মাত্র ক’দিন পর বায়তুল মোকাররম মার্কেটে তারা বোমা বিস্ফোরণ করে জানান দিয়ে ছিল ঢাকা অপারেশন এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার শান্তি-স্থিতি কিরূপ বিরাজ করছিল তার নমুনাও।
গেরিলা ছবিতে তসলিম সরদারের চরিত্রটি আমার কাছে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছি স্থানীয় সরদারদের পাকিস্তান প্রীতি। এক সময়ে ঢাকার কাগুজে নবাবদের পরিয়ে দেয়া পাগড়ী মাথায় চড়িয়ে সরদার উপাধী পাওয়া এসকল সরদারদের দ্বারাই নবাবেরা তাদের নানা সিদ্ধান্ত স্থানীয়ভাবে বাস্তবায়ন করতেন। নিয়ন্ত্রণ করতেন বিভিন্ন এলাকা-মহল্লা।
বিত্তবান এবং শক্তিধরদেরই বেছে বেছে ঢাকার সরদার মনোনয়ন দিতেন নবাবেরা। আইন-আদালতের পরিবর্তে পঞ্চায়েতে বিচার-সালিশ সরদারদের দ্বারাই সম্পন্ন করতেন নবাবেরা। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ লর্ড কার্জনের অনুপ্রেরণায় বঙ্গভঙ্গের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় হতাশ নবাব সলিমুল্লাহ ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠন করেছিলেন। মুসলিম লীগ গঠনের প্রক্রিয়ায় সক্রিয় যুক্ত ছিল ঢাকার সরদারেরা।
মুসলিম লীগের হাত ধরেই দ্বিজাতিতত্ত্বের রক্তাক্ত দেশভাগ সম্পন্ন হয়েছিল। তবে মুসলিম লীগের নেতৃত্ব পরবর্তীতে নবাবদের হাতের মুঠোয় থাকেনি। চলে গিয়েছিল জিন্নাহ্র হাতে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন সহ সকল আন্দোলন সংগ্রামের সময়ে সরদারেরা যেমন ছিলেন পাকিস্তানপন্থী। তেমনি ছিলেন মুসলিম লীগ পন্থীও।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সরদারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ শান্তি কমিটির প্রধান হয়ে রাজাকার সৃষ্টিতে অবদান রেখেছিলেন। আইয়ূব খানের বুনিয়াদী গণতন্ত্রে এরাই হয়েছিলেন বিডি মেম্বার, চেয়ারম্যান। ব্যতিক্রম ছিল না, তা বলা যাবে না। তসলিম সরদারের চরিত্রটি ঢাকার সনাতনী সরদারদের চরিত্রের ব্যতিক্রম হিসেবেই এসেছে।
আমাদের উপমহাদেশের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে নারী অসামান্য অবদান রয়েছে।
ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই, ভগিনী নিবেদিতা, স্বর্ণকুমারী, সরদা দেবী, আশালতা সেন, সরোজিনী নাইড়ু, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মাতঙ্গিনী হাজরা, প্যারী সুন্দরী, ইলা মিত্র, বেগম সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম হতে গেরিলা চলচ্চিত্রের বিলকিস। প্রত্যেকের ধারাবাহিক অবদানে আমাদের জাতীয় বিকাশ সাধন এবং শৃঙ্খল মুক্তি সম্ভব হয়েছে। তাদের ত্যাগ ও অবদানে আমরা হয়েছি ঋদ্ধ। হয়েছি ঋণীও। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগীদের আকাঙক্ষার বাস্তবায়ন হয়নি।
তাদের প্রতি যথার্থ মর্যাদা-কর্তব্যও আমরা পালন করতে পারিনি। এই বাস্তবতায় নারীর গুরুত্বপূর্ণ অবদানে মূর্ত হয়ে ওঠার সুযোগ-উপায় কোথায়? গেরিলা চলচ্চিত্রে নারীর অসীম অবদানের বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যময় এবং হৃদয়স্পর্শে নির্মাতা ফুটিয়ে তুলেছেন বিলকিস, মিসেস খান কিংবা জয়তুনের ত্যাগের মহিমায়।
মেজর সরফরাজ, ক্যাপ্টেন শামসাদ নিষ্ঠুর-নিপীড়ক পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের প্রতীকি হিসেবে চলচ্চিত্রে সার্থকভাবে উজ্জ্বল হয়ে এসেছে। নিষ্ঠুর, নির্মম-নির্লজ্জ পাক সেনা অফিসারদের প্রতীকি উপস্থিতি ভুক্তভোগীদের চল্লিশ বছর পূর্বেকার স্মৃতি মনে করিয়ে দেবে। ভয়াবহ সেই স্মৃতি ভুক্তভোগী কেউ কোনদিন ভুলতে পারেনি।
পারবেও না।
পূর্ব পাকিস্তানে মালাউন নির্মূল অভিযানের নামে সংঘটিত গণহত্যার মূলে ছিল ধর্ম। ধর্মের বাতাবরণেই গণহত্যা সংঘটিত করেছিল পাক সেনাবাহিনী। পাকিস্তানিদের ধর্ম-কর্মের নজির গেরিলা ছবিতে স্পষ্ট হয়েছে। তাদের প্রকৃত চেহারাটি দেখা যাদের সম্ভব হয়নি।
গেরিলা ছবিতে তা’ দেখার সৌভাগ্য হবে।
স্বাধীনতার পর ধৃত এক বেলুচ সেনা স্বীকারোক্তি দিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে তাদের পাঠানোর সময় তাদের কমাণ্ডিং অফিসার তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিল-“পূর্ব পাকিস্তানের সবাই মালাউন, ইন্ডিয়ান এজেন্ট। তাদের নিশ্চিহ্ন করতে এবং ইসলাম ও পাকিস্তানের আজাদী রক্ষার জেহাদী দায়িত্ব পালন করতেই তোমরা সেখানে যাচ্ছো। কোনরূপ অনুকম্পা, সদয় সহানুভূতির সামান্য স্থান এই অভিযানে নেই”।
এখানকার প্রকৃত অবস্থা উপলব্দি করে কৃত অপকর্মের জন্য অনুশোচনা করেছিল ধৃত বেলুচ সেনাটি। ইসলাম রক্ষার নামে পাকিস্তানিরা যা করেছিল তা পৃথিবীর নিকৃষ্টতম ধর্মও অনুমোদন করে না। তাদের নৃশংসতা-বর্বরতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানদের পাকিস্তান রাষ্ট্র মুসলমান হিসেবেই গণ্য করেনি। সেটা কেবল আচরণে নয়।
দালিলিক প্রমাণেও। পাকিস্তানের গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশনে গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানে কাদের কাদের অধিবাস তার একটি তালিকা দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল-“এখানে মুসলমানদের মধ্যে আছেন পাঠান, পাঞ্জাবী, শিয়া, সুন্নী ইত্যাদি এবং হিন্দুদের মধ্যে আছেন ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব, ক্ষত্রিয়, বাঙালি এবং মাদ্রাজী। ” জিন্নাহ্র এই উক্তিতে বাঙালি মুসলমানদের সম্প্রদায়গত অবস্থান পাকিস্তান রাষ্ট্রে নিশ্চিত হয়েছিল। সে সময়ের বাঙালি মুসলমানদের কোন প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে বাঙালি মুসলমানদের অমুসলিম দুর্নাম নিয়েই অতিবাহিত করতে হয়েছে দুঃস্বপ্নের ছাব্বিশটি বছর।
সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধে দেশে ছিলেন না। ছিলেন যুক্তরাজ্যে। দূর থেকে মুক্তিযুদ্ধকে উপলব্দি করতে পেরেছিলেন বলেই লিখেছিলেন উপন্যাস নিষিদ্ধ লোবান। নাসির উদ্দিন ইউসুফ মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় বিলকিস চরিত্রটিকে বাস্তবতায় যুক্ত করে পাল্টে দিয়েছেন উপন্যাসের বিলকিসকে।
ভাই খোকনকে কবর দিতে যাওয়া বিলকিসকে তিনি নিহত ভাইয়ের নিথর দেহ স্পর্শে মৃত্যু প্রান্তরে নিয়ে গেছেন। সেখানে ধরা পরে বিলকিস। সেনা অফিসারকে ছলে-কৌশলে জ্বলন্ত চিতায় ফেলার পরিবর্তে নির্মাতা বন্দী বিলকিসকে দিয়ে তাজা গ্রেনেডের পিন খুলে রহস্যপূর্ণ স্মিত হাসিতে গ্রেনেড বিস্ফোরণে সেনা অফিসার হত্যা এবং বিলকিসের আত্মদান অসাধারণ শৈল্পিক গুণে সমৃদ্ধ। সকল দর্শকের প্রাণ ছুঁয়েছে শেষ দৃশ্যের নান্দনিক সৃজনশীলতা।
যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি।
তাদের জন্য গেরিলা ছবিটি দেখা অসামান্য অর্জন-প্রাপ্তি বলেই মনে করি। নির্মাতা এবং গেরিলা সংশ্লিষ্ট সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাই। জাতির ক্রান্তিলগ্নে গেরিলা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সামনে আলোকবর্তিকা হিসেবে আবার আলোর পথ দেখাবে সে প্রত্যাশাই করছি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।