'জীবন' হলো এক কাপ গরম চা আর একটা জ্বলন্ত বেনসনের মতো। গরম চা একসময় জুড়িয়ে যাবে, বেনসনের তামাকও পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটা সিদ্ধান্ত অনেকদিন থেকেই শোনা যাচ্ছে। সেটি হলো, এম.বি.বি.এস ফাইনাল প্রোফেশনাল পাশকৃত নব্য ডাক্তারদেরকে নিজ মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে এক বছর ইন্টার্ণশিপের পাশাপাশি গ্রামে গিয়ে আরও একবছর ইন্টার্ণশিপ করতে হবে।
অষ্টগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কিশোরগঞ্জ
যে সকল ভাই ও বোনেরা নব্য ডাক্তারি পাশ করেছেন, তারা মোটেও হতাশ হবেন না।
কারণ, সৌভাগ্যবশত: যদি আপনার কোন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইন্টার্ণশিপ করতে যেতেই হয়, তাহলে যে বিষয়গুলো হাতে-কলমে শিখতে পারবেন তা উদাহরণসহ নিচে প্রদান করা হলো:
১.১ প্রতিটি উপজেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বা বস্ হলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (UH&FPO)। কিভাবে সরকার দলীয় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (UH&FPO) তার কর্মক্ষেত্রে (উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে) দুর্নীতি ও মাস্তানি করেন- নব্য ডাক্তারগণ তা নিজ চোখে দেখে শিখতে পারবেন। [ঢাকা এবং সকল বিভাগীয় সদরের একদম কাছাকাছি উপজেলাগুলোতে যে সকল UH&FPO বর্তমানে অবস্থান করছেন, তাদের ক্ষমতার জোরের কথা বলছি]
১.২ সরকার বিরোধী UH&FPO স্যারেরা আগের সরকারের আমলে যথেষ্ট পরিমাণ দুর্নীতি করে এখন দূর্গম এলাকায় প্রেরিত হয়েছেন। [যেমন নেত্রকোণার খালিয়াঝুড়ি এবং পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পানিশমেন্ট খাওয়া UH&FPO]
২. যদি খুব বেশি সৌভাগ্যবান হন, তাহলে দেখতে পাবেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে UH&FPO থাকার কথা থাকলেও তিনি প্রায় সময়ই জায়গা মতো ঘুষের টাকা ঢেলে সুবিধা অনুযায়ী বদলী হয়ে অন্য কোথাও অবস্থান করছেন। অতএব ওই বনে অন্য কোন বাঘ না থাকলে আপনি নিজেই বাঘ হয়ে যেতে পারেন।
(যেমন, লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বর্তমানে UH&FPO শূন্য, চলতি দায়িত্বে আছেন RMO ডা: শফিউর রহমান মজুমদার)
৩. যে সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে DSF (Demand Site Financing) প্রোগ্রামের আওতায় ফ্রি EOC (Emergency Obstetric Care) চালু আছে, সে সকল কেন্দ্রগুলোতে দেখতে পাবেন কিভাবে UH&FPO ফ্রি ডেলিভারীর সব টাকা নিজেই মেরে খাচ্ছেন এবং রোগীরা ফ্রি চিকিৎসার বদলে পকেটের টাকা খরচ করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেলিভারী করাচ্ছেন। (যেমন, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ২০১০ –এর শুরুতে দেখেছি )
৪. নব্য ডাক্তারগণ ইন্টার্ণশিপ প্রোগ্রামে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে দেখতে পাবেন, UH&FPO স্যার অধিকাংশ সময়ই ব্যাতিব্যস্ত কিভাবে সিভিল সার্জন স্যারসহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার লোকজনকে তুষ্ট রাখা যায়। নতুন ডাক্তারদের জীবনের শুরুতে এই তোষামোদি করার টেকনিকগুলো ঠিকমতো রপ্ত করে নিতে হবে।
৫. উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে আরও দেখতে পাবেন, UH&FPO স্যার অধিকাংশ সময়ই বিভিন্ন মিটিং নিয়ে স্ব-স্থানে অথবা নিজ জেলার বাইরে ব্যাতিব্যস্ত। কারণ, মিটিং মানেই ফ্রি খানা আসবে।
আর হলুদ খামের ভিতরে সম্মানীতো আবশ্যক। কোন এন.জি.ও বা ডোনার অর্গানাইজেশনের কোন প্রোগ্রামের সভাতে সম্মানী কম থাকলে সেটা নিয়ে আয়োজকদের সাথে দরদাম করতেও তারা দক্ষ। খাম গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা সরকারী-বেসরকারী কাউকেই ছাড় দিতে নারাজ, খাম তাদের লাগবেই লাগবে।
৬. কোন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে দেখতে পাবেন, কিভাবে UH&FPO স্যার তার অধীনস্থ উক্ত কেন্দ্রের ডাক্তারসহ অন্যান্য হেলথ্ প্রোফেশনালদের থেকে মাসিক বখরা খান। এখানে মাসিক বখরা বলতে বুঝায়, UH&FPO স্যারের অধীনস্থ ডাক্তারগণ কর্মস্থলে নিয়মিত না গিয়ে নিজের চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্যে স্যারকে বখরা দিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত।
আর স্যার-ও বখরা খেয়ে তাদেরকে সার্বিক সুযোগ সুবিধা দেন, সবকিছু ’ম্যানেজ’ করেন নিজের দক্ষতা দিয়ে।
৭. নব্য ডাক্তাররা দেখতে পাবেন, কিভাবে কোন মিটিং বা ট্রেনিং-এ UH&FPO স্যার তার অধীনস্থ ডাক্তারদের সকলকে সমান সুযোগ না দিয়ে শুধুমাত্র তার আস্থাভাজন লোকদের সুযোগ প্রদান করে থাকেন। এই আস্থা অর্জনের জন্যে যারা UH&FPO স্যারকে নিয়মিতি বখরাসহকারে তৈল মর্দন করতে পারেন, তারাই প্রকৃত আস্থাভাজনেষু হবার যোগ্যতা অর্জন করেন। আস্থাভাজন লাভকারীদের সকল গুনাহ UH&FPO স্যার মহোদয় ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। এক্ষেত্রে ডাক্তার ছাড়া অন্যন্য কর্মচারীরাও এই স্কীম-এর আওতাভুক্ত।
তবে স্যারের অধীনস্থ যে সকল অফিস কর্মচারী বা ডাক্তারের সরকার দলীয় পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউণ্ডের খুঁটির জোর আছে, তারা স্যারের গুড বুকে প্রথমেই থাকেন এবং স্বয়ং স্যার তাদেরকে সমীহ করেই চলেন বলা চলে।
৮. যেহেতু বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হেলথ্ এবং ফ্যামিলি প্ল্যানিং -এই দুই উইং-এর সমন্বয় আগেও ছিলনা, এখনও নেই, অতএব আপনি এই সমন্বয়হীনতা এবং Interdepartmental clash উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্ব-চক্ষে দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করবেন।
৯. উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফ্যামিলি প্ল্যানিং উইং-এর কর্মীরা কিভাবে বসে বসে মাছি মারে তা অবলোকন করতে পারবেন।
১০. আরও দেখবেন,DDFP, MOMCH সহ ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর কর্মচারীরা সব নিয়মিতই অনিয়মিতভাবে অনুপস্থিত থাকেন। (তবে কোথাও হলুদ খামের ব্যবস্থা থাকলে তারা দৌড় দিয়ে জায়গামতো চলে আসবেন)
১১. উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আপনি আরও দেখতে পাবেন কিভাবে বিসিএস কিংবা এডহক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তারগণ হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় হাসপাতালের ভেতরে বসেই প্রাইভেট প্রাকটিস করছেন এবং নির্দ্বিধায় রোগীর দেয়া ৫০ কিংবা ১০০ টাকা, যে যা দেয়, পকেটে স্মার্টলি ভরে ফেলছেন।
(যেমন, নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স)
১২. উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ঠিক বাইরে ব্যাঙের ছাতার মতো ফার্মেসীতে দেখতে পাবেন কিভাবে বিনামূল্যে বিতরণের ওষুধ মূল্য দিয়ে আপনাকেই কিনতে হচ্ছে।
১৩. কিভাবে নিজের প্রাইভেট চেম্বারে রোগী সিস্টেমে আনতে হয় (দালাল নিয়োগ দিয়ে) অথবা ডায়াগনোস্টিক/প্যাথলজী সেন্টার থেকে কিভাবে নিজের কমিশনটা ষোল আনা বুঝে নিতে হয়, সেটা শেখার জন্যে UH&FPO/ Medical Officer-এর সংস্পর্শে সবসময় থাকতে হবে।
একটা ব্যাপার পয়েন্ট না করে আলাদাভাবেই বলতে চাই। স্বাস্থ্য বিভাগের সরকারী উচ্চ পদস্থ কোন কর্মকর্তা ঢাকা থেকে কোন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভিজিটে গেলে তাকে স্পেশাল খাতির ও আপ্যায়ন করার জন্য UH&FPO ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে যে অলিখিত নিয়মটি প্রচলিত, তা হলো, উক্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সকল কর্মচারী বাধ্যতামূলকভাবে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা চাঁদা প্রদান করবে।
চাঁদার উঠানো মোট টাকার মোটা খামটি উক্ত স্বাস্থ্য বিভাগের সরকারী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাকে UH&FPO স্যার নিজ হাতে তুলে দিবেন। (যেমন শুনলাম, সম্প্রতি স্বাস্থ্য বিভাগের জনৈক উপদেষ্টা মির্জাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেছেন। সেখানে প্রায় ১৮-১৯ জন কর্মচারী জনপ্রতি ৫০০ টাকা চাঁদা প্রদান করে তাকে সন্তুস্ট করেছে)। স্বাস্থ্য বিভাগের সরকারী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার সামনে UH&FPO স্যার এখানে আসলেই অসহায় বোধ করেন।
আরও একটি ব্যাপার দেখে দু:খ পাই, যখন শুনি, একজন লোকাল এম.পি কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ২০-২৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ডাক্তার UH&FPO স্যারের সাথে বেশ একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতেই কথা বলেন, তখন স্যারকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, "”ক্যান কষ্ট কইরা ডাক্তারী পড়তে গ্যাছিলেন? ডিগ্রী পরীক্ষাটা কোনমতে ঠেইলা-ঠুইলা পাশ দিয়া রাজনীতি কইরা উপজেলা চেয়ারম্যান হইলেই তো আপনেও অন্য কোন UH&FPO রে লাথি মারবার পারতেন"।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অসহায় রোগীদের ভীড়
শেষের কথা:
এ পর্যন্ত যতজন UH&FPO স্যারের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হয়েছে, উপরের অভিজ্ঞতা তারই কিঞ্চিত প্রতিফলন মাত্র। বাস্তব অবস্থা আসলেই ভয়াবহ। তবে ভাল মন-মানসিকতার কিছু UH&FPO স্যারকে দেখেছি, যাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। এসব দুর্নীতি-আক্রান্ত ১৯৪২ সালের মডেলের ইঞ্জিনের ভাঙ্গা গাড়ি দিয়ে আর কতকাল দেশ চলবে? আর কতকাল বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতিবিহীন সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হবে এদেশের গরীব মানুষেরা? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।