কী বিপদেই না ফেলেছিলেন আমাকে মুহম্মদ জাফর ইকবাল!
এই ছিল আমার পড়া লুৎফর রহমান রিটন ভাইয়ের লেখা ছড়া বাদে প্রথম লাইন। সচলায়তনেই স্মৃতিচারণ করেছিলেন তিনি জাফর স্যারকে নিয়ে। রীতিমত মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম লেখাটি পড়ে, শুধু বিষয়বস্তুর গুণে নয়, ঝলমলে সব শব্দ, তরতরে সব বাক্যের কারণে। ছোটকাল থেকে যে মানুষকে আপাদমস্তক ছড়াকার হিসেবেই জানি, পছন্দ করি তাঁর লেখা রচনা বা প্রবন্ধও কে এত সরেস হতেই হবে? বেশ একটা ঈর্ষাই হল রিটন ভাইয়ের গদ্যের উপরে দখল দেখে, এবং তাঁর পর থেকেই খুঁজে খুঁজে রিটন ভাইয়ের কোন রচনা (মূলত সচলায়তন এবং তাঁর ফেসবুক ওয়াল) পেলেই পড়ে ফেলি, ভাল লাগায় আপ্লুত হই, এমতাবস্থায় গত সপ্তাহে এক বন্ধুর সুবাদে হাতে হাজির হল বাংলাপ্রকাশের কতৃক প্রকাশিত ”টুকরো স্মৃতির মার্বেলগুলো”। গত পরশু রাতের তূর্ণা নিশীথা ট্রেনে চট্টগ্রাম যাত্রার সময় সেই যে মজেছি বইটির ভিতরে, আজ সন্ধ্যায় বান্দরবানের মিলনছড়িতে এসে তারপর সবগুলো লেখা শেষ করে এখন হাত কামড়াচ্ছি কেন এত তাড়াতাড়ি বইটি শেষ হল বলে, ভারী তো ২৮৭ পাতার একটা বই, আরেকটু মোটা কলেবরে কি লিখতে পারতেন না তিনি? এবং সেই সাথে মনে হল যদি অন্যদের না জানায় বইটি নিয়ে তাহলে আমার তৃপ্তি পূর্ণতা পাবে না, তাই-ই আঁধার পাহাড়ের মাঝে বসে কী-বোর্ড টিপে চলা।
এই বইটির মূল আকর্ষণ হচ্ছে রিটন ভাইয়ের বর্ণীল জীবনের অসংখ্য না জানা ঘটনা যার সাথে জড়িয়ে আছে সাহিত্য জগতের কোন মহারথী, মন্ত্রী- প্রধানমন্ত্রী, ব্যাংকের গভর্নর, কুখ্যাত রাজাকার। আবার তাঁর ছোট বেলার হারিয়ে যাওয়া মুখ, কোন পত্রিকার হকার , শ্রমিক, পিঠাবিক্রেতা, আমাদের শাহেনশান সিমন, শহীদ রাজিব হায়দার ওরফে থাবা বাবা, প্রয়াত পর্বতারোহী সজল খালেদ। সব অভিজ্ঞতাই যেন বিচ্ছিন্ন এক একটি দ্বীপ, কিন্তু সবগুলোই স্থান পেয়েছে আমাদের নীল গ্রহে।
বিশেষ করে তাঁর প্রথম বই, যা কিনা ছিটে ফোঁটা নামে বেরোবার কথা ছিল যা প্রকাশিত হয়েছিল ধুত্তুরি নামে ১৯৮২ সালে, এবং জয় করে নিয়েছিল পাঠকমন সহ গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পুরষ্কার যার মাধ্যমে খ্যাতি, ভালবাসার পাশাপাশি বিবাহের দায়ে ঘর থেকে বহিষ্কৃত এক তরুণ দম্পতি পেয়েছিল কিছুটা অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও, সেটার কাহিনী মর্ম স্পর্শ করে যায় লেখার প্রতি তাঁর মমতা দেখে, অন্ধটান দেখে। নতুন বই নিয়ে রিটন ভাই লিখেছেন
”নতুন বইয়ের ঘ্রাণে অন্যরকম একটা মাদকতা আছে।
স্কুল জীবনে নতুন ক্লাসের নতুন বই হাতে পাওয়া মাত্র সেই বইয়ের সৌরভে মুখরিত হয়ে উঠত আমার চারপাশ। নতুন বইটি হাতে নিয়ে পাতা উলটেপালটে দেখতে গেলে কাগজ-কালি এবং বাইন্ডিং এর লেই-র সংমিশ্রণে তৈরি একটা গ্রন্থ গ্রন্থ ঘ্রাণ নাকে এসে ধাক্কা দিত। খুব প্রিয় ছিল সেই ঘ্রাণটি। এখনো আমি নতুন একটি বই হাতে নিয়ে প্রথমেই তাঁর সুবাসটুকু গ্রহণ করি।
নতুন বই আমার কাছে রহস্যময়ী নারীর মতো।
ঘোমটা টানা বধূর মতো। ”
আবার হাস্যোচ্ছলে দেখিয়েছেন তাঁর নতুন শব্দ তৈরির মুন্সিয়ানা, যেমন কোন বড় অফিসারের সাথে দেখা হলেই কফি পাবার অধিকার আদায় করে নিয়েছিলেন যার নাম দিয়েছিলেন কফিরাইট! ছড়া নিয়েও বলেছেন এই এক এমন জিনিস পড়ার সময় পাঠকেরও মনে হবে চাইলে আমিও লিখতে পারতাম, কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নহে!
রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের একক আগ্রহে যে কিশোরটি গান-বাজনা-আঁকার জগতে এসেছিল সেই-ই আবার ৯ বছর বয়সে প্রথম ছড়া লিখে কচিকাঁচার আসরের জন্য দিয়ে জীবনের গতি পথ পাল্টিয়ে ফেলল, হয়ে উঠল ছড়াময় জীবনের ভাস্কর, নিজের ভাষায়ই তিনি লিখেছেন-
আমি ননস্টপ ছড়াকার। যখন তখন লিখতে পারি। ছড়া লিখবার জন্য আমার রাত্রির নির্জনতার দরকার হয় না। শুনশান নিরবতার দরকার হয় না।
কাজ থেকে ছুটি নেবার প্রয়োজন হয় না। উইকএন্ডের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হয় না। রাত তিনটা, ভোর পাঁচটা, সকাল সাড়ে দশটা, দুপুর আড়াইটা, বিকেল চারটা কুড়ি। সন্ধ্যে সাতটা, রাত্রি নটা কোন ব্যাপার না। চব্বিশ ঘণ্টার প্রতিটা মুহূর্তই আমার ছড়া লেখা উপযুক্ত সময়।
ছড়া লিখতে বিশেষ কোন পরিবেশ আমার দরকার হয় পড়ে না। আমি বাড়িতে না গাড়িতে, পার্কে না সমুদ্রে, রাস্তায় না শপিংমলে, বাসস্টপে না ট্রেনে, এরোপ্লেনে না রিকশায়, আকাশে না পাতালে (বেসমেন্টে) সেটা আমার ছড়া লিখবার ক্ষেত্রে কোনো ফ্যাক্টর নয়। নো ম্যাটার হোয়েন এন্ড হয়্যার আয়েম। ছড়া লিখতে আমার কোনো এলকোহল নিতে হয় না। নিকোটিন নিতে হয় না।
ওয়াইন কিংবা হুইস্কি বা বিয়ার পান করাটা মোটেও জরুরী নয়। ছড়া লিখতে গাঁজা চরস কিংবা সিগারেট কিছুই ফুকতে হয় না আমার। ছড়াতে মগ্ন এবং আচ্ছন্ন হবার জন্য মাদকাশ্রয়ী হতে হয় না আমাকে। ছড়াটাই তো আমার কাছে চমৎকার এক মাদকবিশেষ। এ এক অপরূপ নেশা।
এই নেশার ঘোরে বুঁদ হয়েই কাটিয়ে দিলাম দীর্ঘ দিবস আর দীর্ঘ রজনীর পঞ্চাশটি বছর! সুন্দরী নারীর পিছনে আমি ছুটি না। আমার সমস্ত ছোটাছুটি ছড়ার পিছনে। সেই ছেলেবেলা থেকেই ছড়ার পেছনেই ছুটছি আমি নিরন্তর। নির্বোধ বালকের মতো। মুগ্ধ কিশোরের মত।
পাগল প্রেমিকের মত। ড্রাগএডিক্ট যুবকের মতো। সম্ভবত আমার নাছোড়বান্দা টাইপের লেগে থাকা ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয় ছড়াও আমাকে খানিকটা ভালোবেসে ফেলেছে। ভালোবেসে ছড়াও ধরা দিয়েছে আমার হাতে। আমি যেমন ছড়াকে ছাড়ি না তেমনি ছড়াও ছাড়ে না আমাকে।
আমার শৈশব হাতড়ে ডিজেল নামের এক মাতালের কথা স্বীকার করেছেন নিজের ছড়াকার হবার পিছেন যেখানে মাতাক ডিজেলকে দেখলেই পাড়ার সব পিচ্ছিরা এক সাথে চিৎকার করে বলত –
ডিজেল মেরা লাল হ্যায়
লাওড়াকা বাল হ্যায়!
এইখানেই রিটন ভাইয়ের গদ্যের জাদু, লুকোবার নেই কিছু। আর সেই সাথে ছড়ার মতই গদ্যেও তিনি প্রচণ্ড সোচ্চার রাজাকারের বিচার ও মৌলবাদী শক্তির অপকারিতা নিয়ে। আমাদের যেমন হাসান তেমনই সচেতনও করেন ক্ষুরধার বাক্যগুলো দিয়ে। তারপরও তিনি মনেপ্রাণে একজন ছড়াকার, যার বলা সাজে-
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম ছড়ার পেছন ঘুরতে ঘুরতে
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম ছড়ার ডানায় উড়তে উড়তে
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম ছড়ার ছন্দ ধরতে ধরতে
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম ছড়ার ব্যাখ্যা করতে করতে
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম ছড়ার নিবাস খুঁজতে খুঁজতে
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম ছড়ার উৎস বুঝতে বুঝতে
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম ছড়ার পেছন ছুটতে ছুটতে
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম ছড়ার মজা লুটতে লুটতে
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম ছড়ার নকশি বুনতে বুনতে
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম শুধুই ছড়া শুনতে শুনতে
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম ছড়ার পেছন হাঁটতে হাঁটতে
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম শুধুই ছড়া কাটতে কাটতে ...
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম ছড়ার প্রাসাদ গড়ার জন্য
একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম ছড়ার জন্য, ছড়ার জন্য ... ।
( ১ এপ্রিল ছিল চিরতরুণ ছড়াপাগল মানুষটির জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন রিটন ভাই।
রাজ্যের যত পোকা এসে হাজির হয়েছে আমার ল্যাপটপের মনিটরে , এক হাতে পোকা তাড়াতে তাড়াতে চিন্তা করছি কবে আপনার লেখা ”যত্রতত্র কয়েকছত্র” আর ”নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে” স্মৃতিগদ্য পড়তে পারব।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, ছড়া লেখুন, আর লেখুন স্বাদু গদ্য, চিরন্তর। )
।অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।