আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সদ্য পড়া বই - পাখিদেরও আছে নাকি মন


একবার কাবুল থেকে একজন একটি মদনটাক ধরে আমার কাছে এনেছিল। পাখিটি বেশ পোষ মেনে গেল এবং মাংস ছুঁড়ে দিলে তা ধরে খেত। তার ঠোঁট থেকে কিছুই ফসকে যেত না। একবার সে একটি আস্ত জুতা গিলে ফেলল, তারপর একটি মুরগি গিলল- ডানা ও পালক সমেত। --- সম্রাট বাবর (বাবরনামা)
সম্রাট বাবর এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের জীবন গ্রন্থের পাখি সম্পর্কিত দুইটি মজার ঘটনা আছে বইটির শুরুর দিকেই।

পুরাণ, ইতিহাস, কিংবদন্তী লেগে আছে এর পাতায় পাতায়, পরতে পরতে। ইকারাসে ডানা, গ্রীক কবি সাফো ও তার সমকামী প্রেমিকা আত্তিস, সম্রাট অশোক, ইরানি মহাবীর কোরেস, মহাভারতের দ্রৌপদী যেমন এখানে এসেছে বাস্তব গল্পের প্রয়োজনে, পাখিদের টানে, তেমনি এসেছে পার্সিয়ান কিংবদন্তীর হোমা পাখি!

পড়লাম পাখি বিশেষজ্ঞ, আলোকচিত্রগ্রাহক, অভিযাত্রী ইনাম আল হকের লেখা বই পাখিদেরও আছে নাকি মন। উল্লেখ্য লেখকের একাধিক ফটোগ্রাফির বই থাকলেও এবং তার লেখা বিভিন্ন বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হলেও এই প্রথম লেখার সংকলন আলাদা বই হিসেবে প্রকাশিত হল।
পাখির প্রাণ, পাখির মন এবং পাখি অস্তিত্ব এমন ৩ টি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে তার ২০টি লেখা- কোনটি ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার, কোনটি বিজ্ঞানের, কোনটি আবার পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে। চার রঙে ছাপা ১৫০ পৃষ্ঠার বইটি সম্ভবত পাখি নিয়ে ছাপা একমাত্র বাংলা বই যার প্রতিটি পাতায় ছবি আছে।

কেবল বিহঙ্গকূলেরই নয়, কাহিনীর সাথে সামঞ্জস্য মিলিয়ে পোকা, সাপ, ব্যাঙ, বাদুর, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, মানুষ, ভবন কিছুই বাদ যায় নি।

পুরাণ, ইতিহাস, জীববিজ্ঞান, আইন, ফ্যাশন, বঙ্গভবনের কাক ইত্যাদি স্থান পেয়েছে পাখি নিয়ে আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে। কাব্যপ্রেমীদের জন্য বিশেষ প্রাপ্তি জীবনানন্দেরও ছিল নাকি মন, পাখির মতন লেখাটি, যেখানে লেখক জীবনানন্দের কবিতায় সবচেয়ে বেশি উল্লেখিত ৫ টি পাখি (বুনোহাঁস, প্যাঁচা, শালিক, চিল, কাক) নিয়ে কবির বিভিন্ন রচনা তুলে এনে চমৎকার আলোচনা করেছেন।

ছোট ঝলমলে পাখি পাতি মাছরাঙ্গাকে আমরা সকলেই চিনি যার বৈজ্ঞানিক নাম অলসেডো আত্তিস। আত্তিস কী বা কে? আত্তিস ছিলেন প্রাচীন গ্রীকের লেসবো দ্বীপের বাসিন্দা এক পরমাসুন্দরী রমণী।

যার প্রেমিকা ছিলেন সেই বিশ্বের সেরা দশ কবির একজন সাফো। তারা ছিলেন সমকামী, তাদের বাসস্থান লেসবো থেকে ইংরেজি লেসবিয়ান শব্দের উদ্ভব!

সেই মাছরাঙার নামে কী করে কয়েক হাজার বছর আগের এক সমকামী জুটির ঘটনা ব্যবহৃত হল তা প্রাঞ্জল ভাষায় বলেছেন ইনাম আল হক, একইভাবে তিনি চকাচকির পিঠে চাপিয়ে আমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছেন সমগ্র বাংলাদেশ, যেখানে আছে কাদাময় চর, ঘাসময় জলা, আবার শিকারি বন্দুক, বাটুল, লোভ।
বহুরঙা পাখির পালকের মতই বইটি বিচিত্র সব ঘটনায় ভরপুর- কোথাও লেখক পড়েছেন শিকারির রোষানলে, কোথাও আবার ডাকাত সন্দেহে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে গিয়েছেন থানাতে, রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে গেছেন বঙ্গভবনের কাকদের শুভেচ্ছা দিতে, সুন্দরবনের গহনে, হাতিয়ার দ্বীপে, পাখি পায়ে রিং লাগানোর ক্যাম্পে। তবে সেই বহুবর্ণ জগতের সবকিছুই সুন্দর সরল নয়, পোষা বেড়ালের কাছে কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই ফি বছর ২৪০ কোটি পাখি মারা যাবার রক্তাক্ত কাহিনী যেমন আছে, তেমনি আছে বাংলা শকুনের প্রায় বিলুপ্তি মুখে এসে দাঁড়ানোর করুণ সত্য।
সুখপাঠ্য বইটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব।

মুখবন্ধ লিখেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। উৎসর্গ করা হয়েছে অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেন এবং সম্পাদক মীজানুর রহমানকে। ফ্ল্যাপে লেখা আছে ইনাম আল হককে উদ্দেশ্য করে কবি শামসুর রাহমানের কিছু কথা-- " প্রিয়বরেষু, আপনার জীবন এক ধরণের ধনধান্যে পুস্পে ধনী। আপনি যে জগৎ সৃষ্টি করেছেন তা সবার সাধ্যের, আয়ত্বের মধ্যে নেই। ধন্য আপনার জীবন।

"
বইয়ের গৌরচন্দ্রিকায় ইনাম আল হক লিখেছেন-
বিদায়ি পাখিদের নিয়ে মনে মেলা কথা আছে। পাখি হারিয়ে গেলে আমি বিলাপ করিনে, পাখিটি যে এদেশে ছিল তা লিখি। ছাপাখানায় এর পুনর্জন্ম হয়, টিকে থাকে কিছু দিন কাগজের কন্দরে, মানুষের মনে।
পাখি নিয়ে এখানে তাই আমি কিছু কলরব করলাম। বিলুপ্ত হয়ে গেছে এ দেশের যত পাখি, চির-বিদায়ের পথে আছে তারও বেশি।

যারা আজ ভাল আছে মনে হয়, আসলে তারাও ভালো নেই ; এদের আবাস কালই বেদখল হবে।
আশা আছে এ বইয়ের পাতায় ভালই থাকবে বিপন্ন পাখিরা যদি না লক্ষ লক্ষ উই-পোকা এর নাগাল পেয়ে যায়, অথবা আপনার শিশু এর ওপরে হিসু করে দেয়, কিংবা আপনি একে নদীতে ছুঁড়ে ফেলেন, যে নদীতে মরে গেছে সব মাছ, পালিয়ে বেঁচেছে পাখি, ব্যাঙাচিও নেই।

(বইটির মূল্য ৪৫০ টাকা, তবে মোড়ক উম্মোচনের দিন ৩০০ টাকা রাখা হবে। সেটি সামনের শনিবার, ৭ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে)

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।