শফিকুল ইসলাম, কলকাতা
১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয়, ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় বাংলা। এর পশ্চিম ভাগটি পড়ে ভারতে, নাম হয় পশ্চিমবঙ্গ। আর পূর্ব ভাগটি পাকিস্তানের পক্ষে যায়। এই ভাগটি পূর্ববঙ্গ নামে পরিচিত হয়। পরে এর নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান।
১৯৭১ সালে এই অংশটি স্বাধীন হয়। নতুন নাম হয় বাংলাদেশ। অবিভক্ত বাংলা যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল, তাই ১৯৪৭ সালের পর দুটি ভাগই বিশাল সংখ্যক শরণার্থী-সমস্যার সম্মুখীন হয়। যা পরবর্তীকালে দুটি দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছিল। পূর্ববঙ্গ থেকে অসংখ্য হিন্দু এদেশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে; ঠিক তেমনই পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু মুসলমান চলে গিয়েছিল পূর্ববঙ্গে।
যারা থেকে যায় তাদের মুখোমুখি হতে হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা, দাঙ্গা আর কখনও পাকিস্তানের চর, মৌলবাদী আখ্যা নিয়ে। ১৯৪৭ সাল থেকে আজকের ২০১১, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা সমস্যাশূন্য থাকেনি। পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যা ২০১১-এর জনগণনা অনুসারে ৯ কোটি ১৩ লাখ ৪৭ হাজার ৭৩৬ জন। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানের সংখ্যা ২ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার ২০০ জন। পঞ্চদশ জনগণনা রিপোর্ট অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে সাক্ষরতার হার ৭৭.০৮ শতাংশ।
আর মুসলিমদের মধ্যে এই হার ৫৭.৪ শতাংশ।
ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য চাকরি ও বাসস্থান দুটোই বড় জরুরি। এদেশের শাসকরা বলেন, ‘মুসলমানদের শিক্ষা-দীক্ষা ও নৈপুণ্য যথেষ্ট নেই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই চাকরির ক্ষেত্রে তারা অনেক পিছিয়ে। ’ অনেক সময় যোগ্যতা থাকলেও শুধু মুসলমান বলেই চাকরি পান না তারা।
এই অভিযোগ বহু মুসলমানের। কখনও কখনও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও মুসলমানদের মনে সর্বদা থাকে বৈষম্যের তীব্র ভয়। কর্মবিনিয়োগ কেন্দ্রের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, এক বছরে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরি পেয়েছেন ১৪ হাজার ৪৬৫ জন। এর মধ্যে মুসলমান খুঁজতে হয় অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে, মাত্র ৭১৭ জন। আধা-সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মুসলিমপ্রার্থী নিয়োগের কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না, তবে অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা যায় তার হারও অনুরূপভাবে কম।
১৯৯১ সালে আদমশুমারি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার প্রায় চব্বিশ শতাংশ ছিল মুসলমান, ২০০১-এ তা গিয়ে দাঁড়ায় পঁচিশ শতাংশে এবং সর্বশেষ ২০১১-এর জনগণনা অনুযায়ী মুসলমানের সংখ্যা শতকরা ২৬ শতাংশ। মুসলমান সংগঠনগুলো মনে করে, এ সংখ্যা ২৮ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দাবি, পুলিশে শতকরা ৯ জন মুসলিম চাকরি করছেন। কিন্তু বাস্তবে তা মেলে না।
কেন্দ্রীয় সরকারের উপদেশ, পুলিশে আরও বেশি মুসলিম চাই।
মুসলিমদের সমস্যা ও উন্নয়নের ব্যাপারে এতদিন পর কেন্দ্রীয় সরকারের ঘুম সম্ভবত ভেঙেছে। তবে তা কতটা মুসলিম ভোটের কথা ভেবে এবং কতটা মুসলিমদের প্রতি দরদের কারণে, তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। সম্প্রতি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ও রাজ্য সরকারগুলোকে দেয়া কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশে বলা হয়েছে, যেসব অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা অনেক বেশি সেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের পুলিশকর্মীদের আরও বেশিসংখ্যায় নিয়োগ বা বহাল করতে হবে—যাতে কিনা তারা ওইসব এলাকায়, বিশেষ করে উত্তেজনাপ্রবণ ও হিংসাত্মক পরিস্থিতিতে অনেক বেশি নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করতে পারে। প্রসঙ্গত, সমাজসেবী ও পণ্ডিত-গবেষক আজগর আলি ইঞ্জিনিয়ারসহ দেশের বহু বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বহুদিন ধরেই সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিলেন, দেশের পুলিশ বাহিনীতে বেশিসংখ্যায় মুসলিমকর্মীদের নিয়োগ করা হলে দেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিংসাত্মক ঘটনা এবং দাঙ্গা-পরবর্তী পরিস্থিতি আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করা যেত।
ভারতে অন্ধ্রপ্রদেশই হলো একমাত্র রাজ্য, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতের (১০ শতাংশ) তুলনায় পুলিশ বাহিনীতে মুসলিমকর্মীদের সংখ্যা অনেক বেশি (১৫ শতাংশ)।
জম্মু ও কাশ্মীরে মুসলিমদের সংখ্যা ৭০ শতাংশ, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে মুসলিম পুলিশকর্মীদের আনুপাতিক হার ৫৭ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের সংখ্যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ হলেও পুলিশ বাহিনীতে মুসলিমকর্মীদের প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৭ থেকে ৯ শতাংশ। তবে গুজরাটে মুসলিমরা মোট জনসংখ্যার যেহেতু মাত্র ৭ শতাংশ, সে তুলনায় গুজরাট পুলিশ বাহিনীতে মুসলিমকর্মীদের আনুপাতিক হার ৫ শতাংশকে বেশিই বলতে হবে। অর্থাত্ ‘প্রগতিশীল’ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে গুজরাট অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। মুসলিমকর্মীদের প্রতিনিধিত্বের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ দিল্লি (৩ শতাংশ) ও তামিলনাড়ু রাজ্যে (২ শতাংশ)।
পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যার হার সরকারি মতে ২৬ শতাংশ, বেসরকারি হিসাবে ২৮ শতাংশ। অর্থাত্ পশ্চিমবঙ্গে মোট জনসংখ্যার তারা একটা বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মুর্শিদাবাদসহ এই রাজ্যের বেশকিছু জেলায় মুসলিম ভোটারদের সংখ্যা এত বেশি যে, ক্ষমতায় আসতে আগ্রহী কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই পশ্চিমবঙ্গের এই বিশাল সংখ্যক মুসলিম ভোটারকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, পশ্চিমবঙ্গের বিগত বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যের মুসলিমদের অর্থনৈতিক অবস্থা বা পশ্চাত্পদতা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি; এর ফলেই পরবর্তীকালে মুসলিমদের কাছ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সংখ্যালঘুদের আর্থিক-সামাজিক অবস্থা পর্যালোচনায় নিযুক্ত সাচার কমিটির রিপোর্টের বিভিন্ন তথ্য ও হিসাব-নিকাশেও স্পষ্ট যে, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা দেশের মধ্যে সব ব্যাপারেই পিছিয়ে আছে।
এমনকি সরকারি চাকরি এবং অন্যান্য ব্যাপারেও তারা বঞ্চিত, শোষিত ও পিছিয়ে পড়ার দলে। সরকারি হিসাবই বলছে, পশ্চিমবঙ্গে সরকারিতে মুসলিম কর্মচারীদের হার মাত্র ৪ শতাংশ—যা অত্যন্ত নগণ্য। গোটা দেশে মুসলিমদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের ক্ষেত্রে তা মাত্র ৫৭.৫ শতাংশ। মজার ব্যাপার—কেরালায়, যেখানে কয়েকবছর অন্তর বামরা ক্ষমতায় আসে ও যায়—সেখানেও কিন্তু সাক্ষরতার হার ৮৯.৪ শতাংশ অর্থাত্ যথেষ্ট বেশি। উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে এটা যথাক্রমে ৪৭.৮ ও ৪২ শতাংশ।
অর্থাত্ বিহারের অবস্থা বেশ খারাপ।
পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের চাকরির হালহকিকত : সরকারি এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, রাজ্য সরকারের লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক নিয়োগে ৮৩৪ জনের মধ্যে মুসলিম মাত্র ১৬ জন। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের কীভাবে সংরক্ষণ দেয়া যায় এ নিয়ে যেমন বিস্তর আলোচনা সরকারি মহলে, তেমনি সাম্প্রতিক চাকরি নিয়োগে সরকারের (বিগত) আন্তরিকতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক গ্রুপ ‘ডি’ বিভাগে সাম্প্রতিক কর্মী নিয়োগে আবারও মুসলিম নগণ্য নিয়োগের দৃষ্টান্ত সামনে এসেছে। গত ১৬ মার্চ এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের সরকারি দফতরের লোয়ার ডিভিশন কর্মী নিয়োগের যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে মুসলিমদের নিয়োগের হার দু’শতাংশেরও কম।
বিভিন্ন দফতরের লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক নিয়োগের যে দুটি তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে মোট নিয়োগের সংখ্যা হলো ৮৩৪ জন। এর মধ্যে মুসলিম মাত্র ১৬ জন। মাস কয়েক আগে কলকাতা পুলিশ নিয়োগে মুসলিমদের স্বল্পসংখ্যক উপস্থিতি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যসহ অন্যান্য মন্ত্রীদের বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ২০০১-এর জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে যেখানে মুসলিম জনসংখ্যার হার ২৫.৫ ভাগ, চাকরিতে এ নগণ্য উপস্থিতি কেন সে প্রশ্ন সাচার কমিটির রিপোর্টেও ওঠে এসেছে। কিন্তু সরকারের তরফে বার বার দাবি করা হয়েছিল সাচার কমিটির রিপোর্ট ঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি, ফলে প্রকৃত তথ্য নাকি অধরাই থেকে গেছে।
এরপর রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য প্রথমে মুসলিমদের হতাশ করে দেয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন, চাকরিতে মুসলিমদের সংরক্ষণ দিয়ে খুব বেশি লাভ হবে না। আর জাতিগতভাবে মুসলিমদের সংরক্ষণ দেয়ার নানা অসুবিধার কথাও তিনি তুলে ধরেন।
মুসলিম বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সরব হলে তিনি ঘুরে গিয়ে সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণের চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানান। পরবর্তীতে সময়ে ওবিসি অর্থাত্ অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের আওতায় কম আয়ভুক্ত মুসলিমদের সংরক্ষণের কথা ঘোষণা করেন।
এ রাজ্যে মুসলিমদের মধ্যে ওবিসি আওতাভুক্ত হলো ২ শতাংশের মতো। তাদের মধ্যে আবার একটু বেশি আয়ের মুসলিমরা সংরক্ষণ পাবে না। শিক্ষাসহ অন্যান্য জরুরি দফতরে আবার এ সংরক্ষণ প্রযোজ্য নয়। কিন্তু সরকারি চাকরিতে কেন মুসলিমদের ৩ শতাংশ উপস্থিতি যে বিষয়ে বরাবরই পাশ কাটিয়ে গেছেন সরকারের মুখ্যমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীরা। তারা বার বার সাচার কমিটিতে উল্লেখ হওয়া চাকরিতে মুসলিমদের সংখ্যা নগণ্য একথা মানতে চাননি।
এর প্রত্যুত্তরে জনগণের কাছে তারা সঠিক তথ্যও তুলে ধরতে পারেননি। আসলে তারা ধারে ধোরে বলতে চেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের ক্ষেত্রে কোনও বৈষম্য রাখা হয়নি। কিন্তু তথ্য জানার আইন আসার পর এখন অনেক সরকারি তথ্যই সাধারণ জনগণের হাতে আসতে থাকায় তাদের বক্তব্য আর ধোপে টিকছে না।
পাবলিক সার্ভিস কমিশন, পশ্চিমবঙ্গে দু’দফায় গ্রুপ-ডি লোয়ার ডিভিশন অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ করে বিভিন্ন দফতরে। এ নিয়োগ করা হয় ২০০৬ সালে ক্লার্কশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের ভিত্তিতে।
দীর্ঘদিন পর গত বছর ওই পরীক্ষায় সফল হওয়া প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১০, নোটিশ নং অ-৩৭-চঝঈ (অ)। এই তালিকায় উল্লেখ করা হয়, ‘Secretariat of the Public Service Commission, West Bengal’ দফতরের কথা। এ দফতরে যে ৩৬ জনের নিয়োগ তালিকা প্রকাশ করা হয় তার মধ্যে একজন মুসলিমেরও স্থান হয়নি। তারপর দেয়া হয় ‘P&AR Department, (CC Wing), Block-1, 2nd floor, Writers Buildings, Kolkata-700001, দফরের নিয়োগ তালিকা। এ তালিকায় রয়েছে ৫২০ জনের নাম।
তার মধ্যে মুসলিম স্থান পেয়েছে মাত্র ১৩ জন। অর্থাত্ পিএসসির দু’দফতর মিলিয়ে মোট নিয়োগের সংখ্যা ৫৫৬ আর মুসলিম নিয়োগ মাত্র ১৩! এখানে মুসলিম নিয়োগের হার মাত্র ২.৩%। নিয়োগ তালিকায় স্থান পাওয়া ওই ১৩ মুসলিম হলেন : (১) হাসনাল হক (২) সাইফুল ইসলাম (৩) কায়েস আলী মিয়া (৪) আবদুল্লাহ নিসার (৫) সেখ মনিরুল হক (৬) শামিম ইয়াসমিন (৭) তানিয়া গাজি (৮) সেখ মুহাম্মদ শফিক (৯) মুহাম্মদ নাসিম (১০) সৈয়দ নাসিরুদ্দিন (১১) ফখরুদ্দিন সরদার (১২) সেখ সাহেব আলী (১৩) মসিউর রহমান।
এরপর গত বছর ১৬ মার্চ (নোটিশ নং অ-৬১/PSC (A) dated 16 March 2010) ক্লাকশিপ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। এ তালিকায় রয়েছে মোট ২৭৮ জনের নাম।
তার মধ্যে মুসলিম মাত্র ৩ জন। অর্থাত্ মুসলিম নিয়োগের হার এক শতাংশের কম।
প্রথমে তালিকায় স্থান পায় ‘West Bengal Legislative Assembly Secretariat, ÒASSEMBLY HOUSEÓ Kolkata-1.’ বিভাগে নিয়োগকৃতদের এ তালিকায় মোট ১০ জনের নাম থাকলেও একজন মুসলিমেরী স্থান হয়নি। এরপরের তালিকায় রয়েছে খাদ্য ও সরবরাহ বিভাগে নিয়োগকৃতদের নাম। এতে রয়েছে ২৬৮ জনের তালিকা।
তার মধ্যে মাত্র ৩ জন হলেন মুসলিম। এ তিন সৌভাগ্যবানের নাম : (১) সেখ দীন ইসলাম (২) মুহাম্মদ নাসিমুদ্দিন (৩) মো. মুদাস্সার।
সম্প্রতি খাদ্য সরবরাহ বিভাগে নিয়োগ নিয়ে স্বজনপোষণের অভিযোগ ওঠে। আর এ তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর সরকারি ক্ষেত্রে মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ চরমে পৌঁছায়। কারণ বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন ও বুদ্ধিজীবী মহল বারবার চাকরিতে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম বঞ্চনার অভিযোগ তুলে আসছিলেন।
এবার সেই অভিযোগ আরও দৃঢ় হলো বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছে। সেই সঙ্গে তাদের দাবি, এ রাজ্যে জনসংখ্যা অনুপাতে চাকরি দিতে হবে মুসলিমদের।
সাচার রিপোর্টে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের বৈষম্য-বঞ্চনার প্রতি বিগত বামফ্রন্ট সরকার কোনো নজরই দেয়নি। রাজ্য সরকার ও মিডিয়ায় বলা হয়—মুসলমানদের মধ্যে আশানুরূপ যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্ন! রাজ্য সরকারের দফতরগুলোর জন্য সাফাইকর্মী, পিওন দরকার হয়; পুলিশ বিভাগে কনস্টেবল, হোমগার্ড অথবা হাসপাতাল কর্মী দরকার হয়।
সেখানে যে যোগ্যতার দরকার তাও কি সংখ্যালঘুদের নেই? সাচার কমিটির উদাহরণ তুলে ধরা হচ্ছে— (গত ২০ বছর) মুসলমান জনসংখ্যার হার ২৪-২৬% কর্মনিযুক্তি মাত্র ৪.৯৫%।
তপসিলি জনসংখ্যার হার ২৪% কর্মনিযুক্তি ২১ শতাংশ।
তপসিলি উপজাতি জনসংখ্যার হার ৬%, কর্মনিযুক্তি ৫.৮১%।
ওবিসি (পিছিয়ে পড়া বর্ণহিন্দু) জনসংখ্যার হার ১০%, কর্মনিযুক্তি ৫.৮২%।
অন্যান্য জনসংখ্যার হার ৩৬%, কর্মনিযুক্তি ৬২.৪৩%।
(অন্যান্য জনসংখ্যার মধ্যেও উচ্চবর্ণ রয়েছে)
মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও সংগঠনগুলোর নেতাদের প্রশ্ন— রাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে—এটাই সংবিধানস্বীকৃত। তবে কেন এ বৈষম্য আর বঞ্চনা? সাচার কমিটিও এ প্রশ্ন তুলেছে।
সাচার রিপোর্টের পর এবার মুসলিমদের প্রকৃত অবস্থার কথা তুলে ধরেছে কেন্দ্রীয় সরকারেরই জরিপ সংস্থা ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অফিস বা এনএসএসও।
ওই সংস্থার জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতি ১০০ জন মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে মাত্র ১০ জন উচ্চ বিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষালয়ে যায় যেখানে তপসিলি জাতিদের আনুপাতিক হার ১১ শতাংশ, তপসিলি উপজাতিদের ১২ শতাংশ এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতিদের ১৪ শতাংশ। আর্থিক দুরবস্থার কারণেই মুসলিমরা বিদ্যালয়ে কম যায় বলে ওই জরিপে দেখানো হয়েছে।
এখন যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তা হলো, মমতা কি মুসলিম সম্প্রদায়ের এসব সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হবেন? কারণ মুসলিমদের জন্য সাম্প্রদায়িক নিরাপত্তার ব্যবস্থাটুকু ছাড়া উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী এবং বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব ও বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার তাদের উন্নয়নের জন্য খুব একটা কিছু করে উঠতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজনৈতিক মহলের মতে, মুসলিম ও তফসিলি সম্প্রদায়ের ভোট পেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবাংলার মসনদে আসীন হয়েছেন; কিন্তু তার পক্ষে মুসলিমদের জন্য খুব বেশি উন্নয়ন করা সম্ভব হবে না। কারণ প্রশাসনে একদল মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন আধিকারিক আছেন, যারা এ ব্যাপারে মমতাকে ‘কুপরামর্শ’ দিতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একাংশ মনে করেন, তিনি অত্যন্ত অস্থিরমতি ও ক্ষমতার অন্বেষণে এক সময় বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন এবং এনডিএ’র শরিকও ছিলেন। তার এনডিএ পরিত্যাগ করার কারণগুলোর মধ্যে মুসলিম ভোটারদের মন জয় করা ছিল অন্যতম কারণ।
তিনি ইফতার পার্টিতে অংশ নেন, মুসলিম এলাকার জনসভায় হিজাব করেন, ‘ইনশাল্লাহ মুসলিম ভাই-বোনদের পাশে থাকব’—এসব প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েই বলেছেন, সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে সাচার কমিটির সুপারিশ মানা হবে। আগামী দু’বছরেই বোঝা যাবে মমতার প্রতিশ্রুতি শুধু আবেগ না বাস্তব।
ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের ইদানীং যে শিক্ষা-সহবত নেয়া দরকার তা হলো—সংখ্যালঘুদের ভোট, বিশেষ করে মুসলিম ভোটের ওপর কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট আর একচ্ছত্রভাবে নিশ্চিতরূপে নির্ভর করতে পারবে না। এদেশে আশির দশকের শেষদিক পর্যন্ত যখন কংগ্রেস দলের কোনো বিকল্প ছিল না, তখন কংগ্রেস শুধু আত্মতুষ্টিতেই যে ভুগতো তা নয়—উপরন্তু সুকৌশলে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে তলে তলে হাত মেলাতো।
তারা এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর সাহায্য-সহযোগিতা খুব সূক্ষ্মভাবে ও সুকৌশলে গ্রহণ করতো। এমনকি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও আশির দশকের গোড়ায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও আরএসএসের সমর্থন নিয়েছিলেন। মুসলিমদের তখন একথাই বোঝানো হতো যে, কংগ্রেসই হলো দেশের একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্প। ফলে মুসলিমরাও তখন একপ্রকার বাধ্য হতো কংগ্রেসকে সমর্থন জানাতে।
নব্বইয়ের দশক থেকে এই পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে এবং মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট কার্যকর হওয়ার পর এদেশে জাতপাতনির্ভর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হয়।
মুসলিমরাও তখন উত্তরপ্রদেশ, বিহারসহ অন্যান্য কয়েকটি রাজ্যে বিভিন্ন দলকে বেছে নিয়েছিল। এ কারণেই কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হয়। ইউপিএ (ইউনাইটেড প্রগেসিভ অ্যালায়েন্স) তৈরি করার পর তারা আবার ২০০৪-এ কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়। বামপন্থীরাও বরাবর সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে সামনের সারিতে থাকলেও পশ্চিমবঙ্গে তাদেরও এখন বেহাল অবস্থা। পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ মুসলিমের কাছে আপাতত বামফ্রন্টের বিকল্প হলো তৃণমূল কংগ্রেস।
অল ইন্ডিয়া মিল্লি কাউন্সিলের সেক্রেটারি ড. মনজুর আলম বলেন, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন যে, এদেশের গণতান্ত্রিক অবস্থার সুফল দেশের সব স্তরের মানুষ লাভ করতে পারেনি। এদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফল উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কুক্ষিগত করে রেখেছে। দু-চার ফোঁটা অবশ্য ওবিসি’র (পিছিয়েপড়া সম্প্রদায়) মাধ্যমে দেয়া হয়েছে, যাকে কিছু রাজনৈতিক দল সমর্থন করেছে। কিন্তু মুসলিমদের মতো সংখ্যালঘুরা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
গণতন্ত্রের ব্যাপারটার কোনো তাত্পর্য বা গুরুত্বই থাকে না, যদি না সেখানে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় এবং তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফলের যথাযথ ভাগ তারা না পায়।
ভারতে বসবাসকারী মুসলিমরা হলো বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম সংখ্যালঘু—প্রায় ১৫ কোটি (১৫০ মিলিয়ন); কিন্তু তা সত্ত্বেও এদেশে আদৌ তারা সুখকর ও সফল একটা জায়গায় নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম জনগণের যে ভয়াবহ ছবিটি সাচার কমিটি প্রকাশ করে দিয়েছে—তা থেকেই বোঝা যায়, এদেশে দলিতদের থেকেও নিচে মুসলমানদের অবস্থান।
তবে আশার কথা, ইদানীং পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একটি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটেছে, যার সাফল্য কোনো সরকার দাবি করতে পারে না। কারণ মুসলিমদের এই অতি ক্ষুদ্র অংশ এদেশে তাদের দুরবস্থা বিষয়ে নিজেরাই তীব্রভাবে সচেতন হয়েছে এবং তারা স্বেচ্ছা প্রণোদিত ভাবে নিজেদের উন্নয়নে উদ্যোগী হয়েছে।
সবশেষে একটা কথা বলতেই হয়, পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পান বা অবাক হন, দীর্ঘদিন যাদের পাশাপাশি তারা বাস করছেন, তাদের অজ্ঞতা বা উদাসীনতা দেখে।
সেসব হিন্দু ভাইয়েরা, শিক্ষা-দীক্ষায় যারা অগ্রগণ্য, পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ের যারা খোঁজখবর রাখেন অথচ প্রতিবেশী সম্পর্কে তাদের সীমাহীন অজ্ঞতার কী কারণ থাকতে পারে, শুধু অনাগ্রহ বা মনের শীতলতা ছাড়া তা উদ্ধার করা যায় না!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।