:-)
প্রথম পর্ব
আসাদ ছেলেটা একটা নদীর মত। অনেক বেশি শান্ত,স্থির আর গভীর। কখনো তাকে রেগে যেতে দেখিনি আমি। তবে মাঝে মাঝে সেই নদীটাতে ঢেউ উঠত। আসাদ হঠাৎ খুব চঞ্চল হয়ে যেত।
অধ্যয়ণ থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমাকে বলত—
--নীতু,আমাদের পৃথিবীটা আমরা ইচ্ছা করলেই সুন্দর করতে পারি নারে?
--হাহাহা। পৃথিবী আসলে সুন্দর। কিন্তু এখানকার মানুষগুলো ভালো না। এইটা আমি ব্যাপক গবেষণা করে বাইর করছি।
--ঠিক বলেছিস তো!
তারপর পাগলটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়।
কি যে ভাবত ঈশ্বর-ই জানেন! আসাদের পরিবারের কারো সাথে আমার কোন পরিচয় হয়নি। সবচে’ মজার ব্যপার আমি জানতাম ও না আমাদের পাড়ার কোন বাড়িটা আসাদের। একদিন অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলাম ওরা ঢাকা ছেড়ে নারায়নগঞ্জ চলে আসল কেন? সেদিন কথাটা আসাদ ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গিয়ে বলেছিল—
--তোকে একদিন সব বলব নীতু।
--আজকেই বল। এক্ষুনি বল।
--নাহ আজ না। তবে বলব। যেদিন তুই আমার অনেক কাছের বন্ধু হবি সেদিন।
--আমি তোর কাছের বন্ধু না?
--আপাতত না।
এই সহজ কথাগুলোর জন্য-ই ওর উপর আমার কোনদিন রাগ হতনা।
অথচ আমি জানি এভাবে তুষার ভাই কথা বললে আমি রেগে ভূত হয়ে যেতাম। দুইজনের সাথে আমার দুইরকম আচরণ। কেন সেটা নিজেও জানিনা। তবে এটুকু জানি কোন কিছু না জেনেই আমি আসাদকে ভালোবাসি। আর তুষার ভাই সম্পর্কে সব জেনেও আমি তাঁকে ভালবাসিনা,ভালোবাসতে পারিনা।
অথচ তুষার ভাই অনেক ভাল ছেলে,অনেক ভাল।
আসাদের কথাবার্তায় আমি টের পেতাম আসাদ পড়াশোনাতে বেশ ভাল। তার জেনারেল নলেজ অনেক রিচ। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য কোথাও কোচিং শুরু করেনি আসাদ। আমি নিজে তখন ঢাকাতে ভর্তির কোচিং করছি।
রোজ বাসে করে আসা-যাওয়া ঢাকা টু নারায়নগঞ্জ। অধ্যয়ণে পড়াতে যাওয়ার সময় হয়না। আসাদ একাই সব ক্লাস নেয় সেখানে। আমার খুব ইচ্ছা করে আসাদের সাথে অধ্যয়ণে যেতে। কিন্তু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় যেতে পারিনা।
আসাদ অবশ্য আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে আসত। আমার সোজা-সরল মা কিভাবে যেন আসাদকে খুব পছন্দ করে ফেলেছিলেন। আসাদের মধ্যে একটা মায়া আছে। সেই মায়া উপেক্ষা করা কঠিন। ভালোবাসা শক্ত ভাষায় উপেক্ষা করা যায়।
মায়া উপেক্ষা করা যায়না।
একদিন বিকাল আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি সময়ে দিকে ঢাকা থেকে কোচিং শেষ করে বাড়ি ফিরছি এমন সময় দেখি আসাদ এক হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে।
--এ্যাই আসাদ! এ্যাই!
ছেলেটা দেখি আমাকে পাত্তা না দিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছে। আমি অল্পেই বিরক্ত হই। এবার ও হলাম।
আসাদের শার্টের হাতা ধরে টান দিলাম দস্যি মেয়ের মত।
--এ্যাই ছেলে। চোখে দেখনা?
--আরে আস্তে। শার্ট ছিড়বে তো। এত হাউকাউ করছিস ক্যান?
--কই যাস বাজার নিয়া?
--তুই কই থেকে আসলি?
--ক্যান জানিস না? সানরাইজে গেছিলাম,ক্লাস ছিল।
--ও।
--তোর সাথে কথা আছে।
--আচ্ছা দাঁড়া বাজারটা বাড়ি দিয়ে আসি। তারপর তোদের বাড়ি যাব। কাকীকে বলিস নাস্তা রেডি রাখতে।
--এহ! খুব মজা না? তুমি বললেই তো কাকী নাস্তা রেডি করে বসে থাকবে!
আসাদ হাসল। তার সেই অদ্ভূত নিষ্পাপ হাসি। যে হাসি সারাদিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়!
সেদিন সন্ধ্যায় আসাদ আমাদের বাড়ি আসল। আসাদের আসা মানেই মায়ের নতুন নতুন পদ তৈরী আর আসাদকে জোর করে খাওয়ানো। আমি রাগ করতাম,ভীষণ রাগ।
--মা তুমি আসাদকে এত জোরাজুরি কর কেন খাওয়া নিয়ে? বিরক্ত লাগে। ও কি তোমার নিজের ছেলে নাকি?
--ছেলের মত-ই তো রে মা। আসাদের বাড়ি একদিন যাব। ওর মায়ের সাথে দেখা করে আসব। যে ছেলে এত মায়াকাঁড়া তার মা না জানি কত ভাল হবে?!
মায়ের সাথে আমার এরকম কথাবার্তার সময় আসাদ চুপ করে বসে থাকত।
কথা বলত না কেন জানি। কিন্তু সেদিন বলল। আমার মায়ের সাথে না,আমার সাথে। মা ওকে নাস্তা দিয়ে খাওয়ার ঘর থেকে বের হ্ওয়ার পরপর-ই আসাদ বলল-
--নীতু,তুই না আমার সব কথা শুনতে চেয়েছিলি?
--চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তো বলবা না।
আমি তোমার ভালো বন্ধু না। দরকার নাই তোর কথা শুনার।
--হাহাহা। তুই বড় পাগলি আছিস রে! ঠিক বলেছিস। আমার ভালো বন্ধু আসলে তুই না,আমার ভালো বন্ধু তুষার ভাই।
--ও।
আমি অভিমানে মুখ বেঁকিয়ে রাখলাম। সেই অভিমান আসলে আসাদের উপর হল নাকি আসাদ হুট করে এসে আমার কাছ থেকে তুষার ভাইকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তুষার ভাইয়ের উপর হল জানিনা। তবে আমার সেই অভিমান দীর্ঘস্থায়ী হলনা। কারণ সেই মরচে ধরা সন্ধ্যাতেই আমাকে আসাদ শোনাল তার জীবনের গল্প।
আসাদ আমাকে শোনাল সৎ মায়ের অত্যাচারে জর্জরিত জীবনের কথা। খেতে না পেয়ে পেয়ে কংকালসার রুগ্ন বাবার কথা। ঢাকার সায়েদাবাদের টিনের ঘরের ফুটা দিয়ে বৃষ্টির পানি এসে পুরো ঘর ভেসে যাওয়ার কথা। গরীবের ঘরে জন্ম নেওয়ার জন্য আজন্ম পাপী হয়ে যাওয়ার কথা। টাকার অভাবে ভাল ছাত্র হ্ওয়া স্বত্তেও ভাল জায়গায় পড়তে না পাওয়ার কষ্টের কথা।
আসাদ যখন আমাকে কথাগুলো বলছিল,আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই ছেলেটার মা-ই নেই? মায়ের ভালোবাসা কি সেটা সে জানেনা? কে এটা বিশ্বাস করবে তার ঐ মায়াময় চোখের দিকে তাকিয়ে? আমার মুখোমুখি বসা ছেলেটা জীবনে এতটা কঠিন সময় পার করে এসেছে? এত কষ্ট তার ছোট্ট বুকে ধারণ করে রেখেছে? এত ঝামেলার মধ্যেও ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে ভালো রেজাল্টের আশায় দিন গুনছে? আর আমি? সারাদিন বাপের টাকায় খাচ্ছি আর ধেই ধেই করে ঘুরে বেরাচ্ছি।
আসাদ একটানে বলে যাচ্ছিল তার সব কথা। একদিনে যেন বুক থেকে পাথর ভার নামাতে চায় সে। ম্যাট্রিকের পর যখন টাকার অভাবে আসাদের পড়াশোনা বন্ধ হ্ওয়ার পথে,তখন আসাদের পরিচয় হয় তুষার ভাইয়ের সাথে।
তুষার ভাই আর তার বন্ধুরা মিলে একটা স্কুল করেছেন ঢাকায় পথশিশুদের জন্য। আসাদ সেখানে পড়াত। তুষার ভাই পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু টাকা দিতেন আসাদকে। সেই টাকায় আসাদের কলেজে পড়াশোনা,ইন্টারমিডিয়েট দেওয়া। আসাদের সৎ মা প্রচন্ড অত্যাচার করত আসাদের উপর।
গরীবের ঘরে একটা বাড়তি পেট মানেই আপদ। আসাদের সৎ মা আসাদকে খেতে দিত না। উঠতে বসতে খোটা দিত। একদিন এইসব অশান্তি সহ্য করতে না পেরে আসাদের বাবা আসাদকে বলেন বাড়ি থেকে চলে যেতে। পেটে ক্ষুধা নিয়ে দুইদিন রাস্তায় ছন্নছাড়া ঘুরে বেড়ানোর পর আসাদ নারায়নগঞ্জ চলে আসে।
তুষার ভাইকে সব খুলে বলার পর তুষার ভাই আসাদকে বুকে টেনে নেন। তুষার ভাই নাকি আসাদকে বলেছেন,"আমার নিজের ও টাকা-পয়সা নাই,ছোট্ট বাড়ি,আব্বা-আম্মা সহ থাকি। তবে তুই যতদিন চাইবি থাক। নিজের বাড়ি মনে করে কাজ-কর্ম করিস। আমার হাতে টাকা থাকলে তোকে ভর্তি কোচিং-এ ভর্তি করে দিতাম,কিন্তু হাতে এখন টাকা নাই।
তুই আপাতত অধ্যয়ণে পড়া। আমি দেখি কি করতে পারি। "
আসাদের কথা শেষ হ্ওয়ার পর সে ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল—
--জানিস নীতু, আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে পৃথিবীর সব অন্যায়গুলো,গরীবকে শোষণ করার নীতিগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলি। লাথি মারি গরীবদেরকে চুষে খাওয়া বড়লোকদের মুখে,এসির বাতাসে বসে বসে সমাজ নিয়ে চিন্তা করা বড়লোকদের মুখে।
আসাদের জীবনের গল্পগুলো শুনে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। তাই মাথা নীচু করে বসেছিলাম। আসাদের কথা শুনে আবার ওর দিকে তাকালাম। এ যে এক অন্য আসাদ।
সমস্ত চোখে মুখে মায়ার বদলে একটা তীব্রতা খেলা করে যাচ্ছে। আশ্চর্য! এই তীব্রতাটুকুও আসাদকে মানিয়ে গেছে অবলীলায়। আমি ধ্যানমগ্ন হয়ে নির্লজের মত আসাদের মুখের দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে সেই তীব্রতা দেখি!
আসাদের ডাকে আমার ধ্যান ভাঙ্গে—
--নীতু অনেক দেরি হয়ে গেল। বাড়ি যাই। তুষার ভাই চিন্তা করবেন।
--তুই তুষার ভাইয়ের বাড়িতে থাকিস আমাকে আগে একবার ও বললিনা। না তুষার ভাই,না তুই। বড়-ই আজিব তোরা!
--তুষার ভাই চাননি রে আমি এইসব কাউকে বলি। আমি তো উনার রক্তের সম্পর্কের কেউ না। উনি যে কেন আমাকে মত একটা গরীব ছেলেকে এত স্নেহ করেন জানিনা।
ভালো মানুষেরা নিজেদের মহত্ত্বটুকু লুকিয়ে রাখতে চায় বুঝলি নীতু? তুষার ভাই ছাড়া আমি এতদূর পড়াশোনা করতে পারতাম না। হি ইজ এ্যা গ্রেট ম্যান।
--তোকে দেখলে সবার-ই স্নেহ করতে ইচ্ছা করে। আর তুষার ভাই গ্রেট ম্যান না ছাতা! উনাকে তো আমার ওম্যান মনে হয়! তুষার ভাই যে ঢাকায় পথকলিদের পড়ায় আমাকে বলতে পারলনা?
--হাহাহা। তোর তুষার ভাইয়ের উপর খুব অভিমান না রে? আমার কেন জানি মনে হয় তুই তুষার ভাইকে খুব সাহসী দেখতে চাস! তবে আমার একটা কথা রাখিস নীতু।
তুষার ভাইকে কখনো অসম্মান করিস না। তিনি অন্যরকম একজন। এই স্বার্থপর সমাজের বাইরের একজন। আমি এ জন্মে তাঁর ঋণ শোধ করতে পারব কিনা জানিনা রে। তুষার ভাই ছাড়া আমার খুব কাছের কোন বন্ধু নেই,গার্জেন নেই।
তুষার ভাই-ই এখন আমার সব।
এই পর্যায়ে আসাদের গলা ধরে এল। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে ছেলেটা নিজের জীবনের কষ্টের কথাগুলো বলতে গিয়ে একবার ও ভেঙ্গে পড়েনি,সেই ছেলেটা যখন তার জীবনে তুষার ভাইয়ের অবদানের কথা বলছিল,তখন তার চোখ বেয়ে অশ্রুবিন্দু ঠুস করে পড়ে গালে মিশে গেল। আমার খুব ইচ্ছা করছিল-এই শান্ত ছেলেটার এলোচুলগুলো আরো এলোমেলো করে দিয়ে বলি—“কে বলল তুষার ভাই ছাড়া তোর কেউ নেই? আমি আছি না? তোর নীতু আছে না?”
মনের কথাগুলো অব্যক্ত থেকে গেল। তবে সেই মরচে ধরা সন্ধ্যায় আসাদের কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি কেমন ঘোরের মধ্য চলে গেছিলাম।
আসাদ চলে যাওয়ার পর বারবার জীবনানন্দের একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছিল। যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা! কোন কবিতায় লাইনটা ছিল সেইটা অবশ্য মনে নাই! আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল—আসাদের মত ছেলেদের দোয়েল-ফড়িঙ্গের জীবনের সাথে দেখা না হ্ওয়াটাই ভাল। দোয়েল-ফড়িঙ্গের জীবনের সাথে দেখা হয়ে গেলে হয়ত পোড় খেয়ে খেয়ে পুড়ে যাওয়া ছেলেটা একটা খাঁটি সোনা হতে পারতনা!
আসাদের জীবনের গল্প শোনার রাতে হঠাৎ ঝড় আর বৃষ্টি শুরু হয়ে হুট করেই থেমে গেল। ঝড়ের কারণেই কিনা জানিনা--আমার মত নিরস প্রকৃতির মেয়ের মনেও একটু কাব্যিক ভাব আসল,আসাদকে নিয়ে একটা কবিতা লেখা শুরু করলাম। কিন্তু দুই-তিন বার কাঁটাছেড়া করে চারটা লাইন লিখতেই আমার ঘুম চলে আসল।
ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে সানরাইজে যাওয়ার জন্য তৈরী হব,দেখি কাল রাতে হুটহাট করে লেখা চার লাইনের কবিতার কাগজটা মাটিতে পড়ে আছে। আমার বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠল কেন জানি! কবিতা লেখা কাগজটা হাতে নিলাম।
কাগজে আসাদের জন্য লেখা ভালোবাসার অসম্পূর্ণ কবিতা!
(চলবে)
তৃতীয় পর্ব
শেষ পর্ব ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।