শিক্ষা যেখানে অসম্পূর্ণ, জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।
পর্ব-১, পর্ব-২
গত পর্বে যেহেতু রামায়ন চলে এসেছে তাই এ পর্বটিতে মহাভারতের উপর আলোকপাত করতে চাই। ৪র্থ পর্ব থেকে উপমহাদেশে আর্য-আক্রমন তত্ত্বকে রিফিউট করার যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকবে। আরেকটি কথা বলা হয়নি এই লেখাগুলোকে মূলতঃ আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা বইটির রিভিউ বলা যেতে পারে। লেখকদের চিন্তার সাথে আমার নিজের চিন্তার সামান্য কিছু প্রয়োগ রয়েছে।
রামায়নের কাহিনীগুলো যেমন মিথ, মহাভারতেরও তাই। পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মগুলোয়ই মিথের উল্লেখ দেখা যায়। কোরান/বাইবেলে নুহের প্লাবনের বর্ণনা, কোরবানীর গল্পসহ বেশকিছু মিথকেই দেখতে পাই। গ্রীকমিথ তো পৃথিবী বিখ্যাত। খ্রীস্টানিটির প্রভাবে পূরাতন ধর্মগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় সেখানে মিথগুলো কেবল মিথ হয়েই আছে যা সাহিত্যের উপাদান হয়ে বর্তমানে সৌন্দর্য্য বিতরণ করছে, উপমহাদেশ/আরবের মত মিথগুলো ধর্মে রূপান্তরিত হয়নি।
হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যানুযায়ী বেদ আবির্ভূত হয় সত্য যুগে। রামায়ন ও মহাভারত যথাক্রমে ত্রেতা ও দ্বাপর যুগে। তবে আমরা দেখেছি রামায়নের কাহিনীর জন্ম মূলত কৃষিনির্ভর সমাজ সৃষ্টির সূচণালগ্নে অর্থাৎ ঋগ্বেদের পূর্বে এবং রামায়নের চরিত্রগুলো বিশেষ করে সীতা, শূর্পণখা ঘটনা/সময়/বস্তুর রূপায়ন মাত্র। এ ব্যাপারে আরেকটি বিষয় অবশ্যই লক্ষ্য করা উচিত যে প্রাচীন এমনকি মধ্যযুগের মানুষেরাও জীব এবং জড়কে বিশেষ পার্থক্য করতে পারত না। তারা ভাবত জড়েরও আত্মা রয়েছে।
সুতরাং রাম, রাবণ ইত্যাদি চরিত্রগুলোও যে ঘটনা বা সমাজব্যবস্থার অন্য কোন উপাদান নয় তা জোর দিয়ে বলা যায় না বরং সেরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক।
মহাভারতের ক্ষেত্রেও যে বাস্তবতা কিছু রয়েছে তা অনস্বীকার্য। কিন্তু ঘটনা, চরিত্র ও সময় সম্ভবত ঋগ্বেদের পরবর্তী কোন সময়ে। ঋগ্বেদের অনেক দেবতার নামই এখানে দেখা যায়। তবে কৃষ্ণসহ বেশ কিছু নতুন চরিত্র/দেবতা/ভগবাণের উদ্ভব হয় যেগুলো আসলে ঋগ্বেদের কিছু দেবতার ভিন্নরূপ বৈ কিছু নয়।
প্রথমেই দুর্যোধন, দু:শাসন এই একশত কৌরব ভাইয়ের কথা বলতে হয়। এই নামগুলোর আগে দু উপসর্গটির প্রয়োগই বলে দেয় যে এগুলো আসলে কোন মানুষের নাম নয়, সমাজ/মানব চরিত্রের খারাপ দিকসমূহ। ঋগ্বেদ, রামায়নের মতই ঘটনা ও বৈশিষ্ট্যের পার্সোনিফিকেশন মাত্র। ঠিক তেমনি পাণ্ডব ভাইদের নামগুলোও। যুধিষ্ঠির স্থিরতা, ভীম শক্তি, অর্জুন দক্ষতার প্রতীক মাত্র।
সময় ও স্থান লেখকের আরোপিত মাত্র।
পাণ্ডবের পাঁচ ভাই হলেও তাদের জন্ম পাঁচজন দেবতার ঔরসে। যুধিষ্ঠির ধর্মের পুত্র, ভীম বায়ুর, অর্জুন ইন্দ্রের এবং নকুল ও সহদেব যমজ দেবতা অশ্বীনিকুমারদ্বয়ের পুত্র। সমস্যা হল ধর্ম বলতে কোন দেবতা আমরা ঋগ্বেদে পাই না। বাকিদের পাওয়া যায়।
এই ধর্ম সম্ভবত বরুণ। ঋগ্বেদে আমরা দেখতে পাই (পর্ব-১) ধর্মসংস্কারের ফলে ইন্দ্র যখন প্রধান দেবতা হিসেবে প্রাধান্য পেতে শুরু করে তখন বরুণকে হেয় করা হয়। কিন্তু প্রথমদিককার ঋকগুলোতে বরুণ প্রধান দেবতা থেকেই যায় কারণ সেগুলোর পরিবর্তন সম্ভব ছিল না। সম্ভবত ধর্মসংস্কারের জন্য প্রাচীন দেবতাকে যেহেতু বরুণ রূপে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি তাই তাকে নতুন নামে নতুন রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ধর্মদেবতাকে সকল দেবতার উর্ধে স্থান দেয়া হয়েছে।
তারপরও থেকে যায় কৃষ্ণ।
ঋগ্বেদে বরুণের সাথে আরো একজন দেবতাকে আমরা দেখতে পাই। সে হল মিত্র। ইন্দ্রের পূর্বে বরুণ এবং মিত্র এই দুই দেবতাকে ঋগ্বেদে বেশ উচু স্থান দেয়া হয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণের অবস্থান নিরপেক্ষ হলেও সে পাণ্ডবদের মিত্র হিসেবেই অবস্থান নেয়। সুতরাং তার নামের সাথে তার চরিত্রের মিলকেই তুলে ধরা হয়।
তাছাড়া কৃষ্ণ বিবেক/জ্ঞান/প্রজ্ঞাও হতে পারে। অর্জুনের রথের সারথি হয়ে সে অর্জুনকে দিকনির্দেশনা দেয়। এমনকি কৃষ্ণ মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন নিজেও হতে পারেন। বেদব্যাসের অপর নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। নিজেকেই মহাভারতের চরিত্রে রূপ দিয়ে দেখিয়েছেন ভগবান যেমন জগতের সবকিছুর নিয়ন্তা তেমনি তিনি নিজেই এই মহাকাব্যের সকল ঘটনা ও চরিত্রের নিয়ন্তা।
সবকিছু বিচার বিবেচনায় নিলে লেখক নিজেই কৃষ্ণ নামক ভগবান হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
যাই হোক। মহাভারতের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আদৌ আছে কিনা তা বের করা মুশকিল। তবে চরিত্রের নামগুলো সত্যিকার অর্থেই শুভ ও অশুভর প্রতীক। মন্দের সাথে ভালর যে যুদ্ধ চিরকাল চলে এসেছে এবং তাতে যে ভালরই জয়লাভ নিশ্চিত তারই মহাকাব্যিক রূপ এই মহাভারত।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।