আগামীর স্বপ্নে বিভোর... রবিন আমাকে প্রায় প্রতিদিনই ফোন করে। ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা কথা বলতে পারি যেকোন বিষয়ে। রবিনের বয়স থেকে বুদ্ধিটা একটু বেশি বলেই প্রেম করে তারচেয়ে তিন বছরের বড় এক মেয়ের সাথে। এই কৃতিত্ব সবাই দেখাতে পারেনা কিন্তু রবিন পারে কারণ সে রবিন। আমি নিজেই দেখেছি স্কুল জীবনে এক সাথে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করার পর আমি ঢুকলাম কলেজে আর আমার সহপাঠী অনেক মেয়ে ঢুকলো স্বামীর ঘরে।
মেয়েদেরকে ধরে রাখা কঠিন হলেও রবিনের কাছে তা সহজ। তমালের অভিজ্ঞতাও এক্ষেত্রে নেহায়েত কম নয়। রবিন আমাকে ফোন করেছে কোন একটা বিষয় নিয়ে আমরা খুব গভীর আলোচনা করছিলাম। আমাদের কথা বার্তার ধরণ কেউ শুনলে নির্ঘাত ভাবতে দেশের শাসন ভারের কিছুটা আমাদের উপর অর্পিত। আমাদের কথা বলার মাঝ খানে মীরা আমাকে বার বার কল দিচ্ছিলো কিন্তু ওয়েটিং দেখে কেটেও দিচ্ছে।
আমি কিছুটা বিরক্ত এই মুহুর্তে মীরার সাথে কথা বলার চাইতে রবিনের সাথে দেশের নানান সমস্যা নিয়ে কথা বলাটাই আমার কাছে জরুরী মনে হচ্ছে কিন্তু সেটা মীরা বুঝতে পারছেনা বলে বার বার কল দিচ্ছিলো। রবিনের সাথে কথা শেষ করে আমিই মীরাকে কল দিই। মীরা কিছুটা অভিমানের সুরে জানতে চাইলো কার সাথে কথা বলছিলাম আমি রবিনের কথা বললাম এবং কি নিয়ে কথা হচ্ছিলো তাও বললাম। মীরার সাথে এ ক'দিন কথা বলে আন্দাজ করতে পারছি সে ধীরে ধীরে আমার পছন্দের তালিকার শীর্ষে পৌছে যাচ্ছে। আমি তাকে থামানোরও চেষ্টা করছিনা কেন করছিনা তা বুঝতে পারছিনা।
তবে ইদানিং সে বড্ড বেশী বাড়াবাড়ি করছে, আমার প্রতিটা বিষয় সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছে। আমি কখন ঘুমুতে যাবো কখন উঠবো কখন কি পরিমান কতটুকু খাবো তাও ঠিক করে দিচ্ছে যা আমার ভালো লাগছিলোনা কিন্তু কেন জানি তার আদেশ নিষেধের প্রতিবাদও করতে পারছিলামনা। একসময় মীরা আমাকে তার মনের কথা বলে দেয় সে আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। আমি তার ভালোবাসা উপেক্ষা করতে না পারলেও হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করি। আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি যে আমিও তাকে অনেক পছন্দ করি কিন্তু এখন এর চাইতে বেশী আমাদের ভাবা উচিত হবেনা।
কিন্তু মীরা আমার কথায় কান দেয়না সেও তমালের মতো কামড়া কামড়ি শুরু করে দিয়েছে। কামড়ের প্রতিযোগীতায় মীরা তমালের মতো সিদ্ধ দন্ত নয় বলে আমি ফাঁক ফোঁকর গলে বার বার বেরিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু মীরা তার দিক থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দাঁত ফোটানোর জন্য।
- আচ্ছা তোমার কি মনে হয়না আমাদের এখন একটা সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ?
- হুঁ।
- তাহলে তুমি কিছু বলছো না কেন ?
- হুঁ।
- আফটার অল আমরা যেহেতু একটা সিদ্ধান্তে পৌছাবো তাহলে আর দেরী কেন ?
- হুঁ।
- শুধু হুঁ হুঁ করছো কেন ? হুঁ হুঁ ছাড়া কি আর কিছু বলতে জানো না ?
- হুঁ।
মীরা খট করে ফোনের লাইনটা কেটে দিলো। ইদানিং ও প্রায়ই আমার উপর রাগ করে হুট করে লাইন কেটে দিচ্ছে। আমি সাথে সাথে তাকে কল ব্যাক করিনা।
গণতান্ত্রিক দেশে আন্দোলন করার অধিকার যেমন সবার আছে তেমনি রাগ করার অধিকারও সবার আছে, বেচারী শখ করে রাগ করেছে কিছুক্ষণ রাগ নিয়েই থাকুক অল্প সময়ে কারো রাগ ভাঙ্গানো উচিত না তাতে রাগের প্রতি সম্মান দেখানো যায়না। আমি তার রাগ ভাঙ্গাই না, আপনা আপনি তার রাগ পড়ে গেলে একসময় সে নিজেই ফোন করে।
হঠাৎ করেই একটা জরুরী কাজে আমার ঢাকা যাওয়ার প্রয়োজন হয়। যাক ভালোই হলো সময় সুযোগ মিললে মীরার সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে। মীরাকে আমার ঢাকায় যাওয়ার কথা জানালাম বিনীময়ে ওর হাসির সংগ্রহশালা থেকে এমন একটা চমৎকার হাসি উপহার দিলো যে হাসির সাথে আমার পূর্বপরিচয় ছিলোনা।
ও হাসছে নাকি কাঁদছে ঠিক ঠাহর করতে পারিনি। ওর কিছু কিছু বিচিত্র ধরনের হাসি আছে যা কান্নার মতোই শোনায় প্রথমে কেউ বুঝতেই পারবেনা ওটা হাসি নাকি কান্না। আমি আর পরখ করতে চাইলাম না।
- হ্যালো... তুমি এখন কোথায় ?
- এইতো জাকির হোসেন রোডে।
- সেটা কোথায় ?
- ডাম পাড়ায়।
- কি করছো ?
- গ্রীণ লাইন বাসের কাউন্টার থেকে বাসে উঠলাম কিছুক্ষণের মধ্যে বাস ছেড়ে দিবে।
- কিছু খেয়েছো ?
- হ্যা খেয়েছি সঙ্গেও নিয়েছি।
- ঢাকায় পৌছাতে কতক্ষণ লাগবে ?
- ঠিক বলতে পারছিনা কুমিল্লার দাউদ কান্দিতে একটা ব্রিজ ভেঙ্গে গেছে তাই সময়টা জ্যামের উপর নির্ভর করছে। সব কিছু ঠিক থাকলে হয়তো ৬/৭ ঘন্টার মধ্যে পৌছাতে পারবো।
- ঢাকায় কোথায় উঠবে ?
- আমার কাজ গুলশানে তবে জানিনা কোথায় উঠবো তবে কোন একটা হোটেলে উঠবো ভাবছি।
- হোটেলে উঠবে কেন আত্মীয় স্বজন কেউ নাই ঢাকায় ?
- অনেকেই আছে কিন্তু কারো বাসায় উঠতে ইচ্ছে করছেনা।
- আজ কি আমার সাথে দেখা করতে পারবে ?
- না আজ কাল এই দুইদিন আমি ব্যস্ত থাকবো তবে তুমি চাইলে কাল বিকেলের পরে দেখা করতে পারি। তাতে তোমারও সুবিধে হবে অফিস থেকে বাড়তি ছুটি নিতে হবে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে আমরা কাল বিকেলে দেখা করছি।
- হুম।
- এ্যাই শোন।
- কি ?
- বাসের মধ্যে কি কোন মেয়ে আছে ?
- হ্যা আছে।
- মেয়েটি কোথায় বসেছে ?
- আমার পেছনের সীটে।
- সাবধান ওর দিকে একদম তাকাবানা নইলে চোখ গলে দেবো।
- আচ্ছা তাকাবো না।
বাস ছেড়ে দিয়েছে আমি সিটে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। রাতে তেমন ঘুম হয়নি, রাত দুইটার দিকে বেডে গেলাম আবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে উঠে গেছি। গোসল সেরে নাশতা করে বের হয়ে গেলাম ভোর ৬টার বাস ধরার জন্য। গরমের দিন হলেও এখন ভোর বলে কিছুটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব তার উপর গাড়ীর ভেতরে এসি চলছে আমি সুপারভাইজরের কাছ থেকে একটা ব্ল্যানকিট চেয়ে নিলাম। গ্রীণ লাইন বাসে এরোপ্লেনের মতোই ব্ল্যানকিট পাওয়া যায় এটা একটা বড় সুবিধা।
বাসের সাউন্ড সিস্টেমে এখন পবিত্র কোর-আন তেলাওয়াত হচ্ছে। তেলাওয়াত বন্ধ করে একটু পরে বাংলা নাটক লাগানো হবে। তার আগে সুপারভাইজর সবার উদ্দেশ্যে একটা ভাষণ দেবে। সুপারভাইজর মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে শুরু করলো কিন্তু স্পিকার থেকে স্পষ্ট আওয়াজ বের হচ্ছেনা হাঁসের মতো প্যাঁক প্যাঁক করে শব্দ বের হচ্ছে মনে হচ্ছে কোন হাঁস কথা বলছে। কিন্তু সুপারভাইজর দমেনি সে ক্রমাগত মাইক্রোফোনের উপর হাত দিয়ে থাপ্পড় দিয়ে যাচ্ছে সেই সাথে মাইক্রোফোনটা মুখের কাছে ধরে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছে কিছু যাত্রী বিরক্ত হয়ে বললো মাইক্রোফোন বাদ দেন যা বলার খালি মুখেই বল আমরা শুনতে পাচ্ছি।
সুপারভাইজর এখন খালি গলায় ভাষণ শুরু করে দিয়েছে। ভাষণ শেষ করে নাটক লাগাতে গিয়ে দেখলো স্ক্রীণে ছবি আসলেও কোন সাউন্ডই আর বের হচ্ছেনা নিজে নিজে মেরামত শুরু করে দিয়েছে ফলে এখন আর স্ক্রীণে ছবিও আসছেনা। বাসের মধ্যে এই নিয়ে হৈ হৈ শুরু হয়ে গেছে হঠাৎ করে পেছন থেকে দুজন ষন্ডা মার্কা যুবক এগিয়ে এলো। তাদের দাবী একটাই নাটক যদি না চলে তাহলে টিকেটের অর্ধেক দাম ফিরিয়ে দিতে হবে নইলে সুপারভাইজার নিজেই গান গেয়ে সবাইকে শুনাতে হবে। বাসের অর্ধেক যাত্রী এখন যুবক দ্বয়ের পক্ষে সবারই এক কথা তিন'শ টাকার ভাড়া সাতশ টাকায় দিয়ে আসছি নাটক দেখাতে না পারলে অর্ধেক টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
সুপারভাইজার অসহায়ের মতো ড্রাইভারের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু ড্রাইভার ভয় পেয়ে গেছে বলে সে কারো দিকে না তাকিয়ে বাস চালিয়ে যাচ্ছে। বাসের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন এই দুই যুবকের হাতে। তারা যা বলছে বাসের অর্ধেক যাত্রী তাদেরকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। নেতৃত্বদানকারী যুবকদ্বয় সুপারভাইজরের সার্টের কলারে ধরে বসা থেকে দাঁড় করালো। একজন হুমকি দিয়ে বললো এখন যদি সে গান না ধরে তাহলে তার সার্ট আর প্যান্ট খুলে নেয়া হবে।
এটা বলার সাথে সাথে অপর যুবক সুপারভাইজরের গলার টাই এক টানে খুলে ফেললো, সুপারভাইজর গান শুরু করে দিয়েছে। পেছন থেকে যাত্রীদের একজন দাঁড়িয়ে বললো এটা কি গান লাগিয়েছো মেয়েলী গান চলবে না, অন্য একটা লাগাও। সুপারভাইজর সাথে সাথে অন্য একটা গান গাইতে শুরু করলো। আরেকজ যাত্রী দাঁড়িয়ে গেলো তার পছন্দ নতুন আসা হিন্দী গান শীলা কি জোয়ানী সেটা নেচেও দেখাতে হবে। আমি কোন গান শুনতে পাচ্ছিনা সুপারভাইজরের কান্না শুনতে শুনতে সীটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
চলবে...
সুমন আহমদ
সিলেট।
২০শে মে ২০১১ খৃষ্টাব্দ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।