আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আসামি ও দলীয় নেতারা কমিউনিটি পুলিশিংয়ে!

জধানীর কাফরুল থানার ধামালকোট-লালসরাই কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি থানায় পুলিশের করা ডাকাতি ও অস্ত্র আইনের মামলায় তিনি এজাহারভুক্ত আসামি। ওই মামলায় তিনি এক বছর কারাভোগও করেছেন। মহানগরের ৮৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং একই ওয়ার্ডের কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক রায়হান খোকন। শ্যামপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহসহ জোড়া খুনের ঘটনায় গত মার্চে গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল।

কালাম ও রায়হান খোকনের মতো ঢাকা মহানগরের কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির এমন অনেক সদস্যই অপরাধ ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। অথচ অপরাধ দমন ও জনসচেতনতা তৈরির জন্যই এই কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের গঠনতন্ত্রে এই কমিটির পরামর্শ নিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) এলাকার আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা আছে। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের মুখপাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যা হলো, ভালো মানুষেরা এসব কমিটির সদস্য হতে চান না। যাঁরা আসেন, তাঁদের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করেই সদস্য নেওয়া হয়।

তবে কমিটিতে মামলার আসামি ঢুকে পড়লে তাঁদের বাদ দেওয়া হবে। পুলিশ সূত্র জানায়, চার বছর আগে রাজধানীতে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। শুরুতে অরাজনৈতিক লোকজনকে কমিটির সদস্য করা হয়, পরে আর সেই ব্যবস্থা টিকে থাকেনি। এখন সরকারদলীয় লোকজনই মূলত এসব কমিটির সদস্য। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের গঠনতন্ত্রে বলা আছে, এটি অপরাধ দমনে পুলিশের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি অরাজনৈতিক ও সেবাধর্মী ব্যবস্থা।

কমিউনিটি পুলিশিং মানে জনগণকে পুলিশের কাজে সম্পৃক্ত করা। ২০০৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের অনুমোদিত কমিউনিটি পুলিশিং কী এবং কেন পুস্তিকায় বলা হয়েছে, ‘বিতর্কিত ও টাউট প্রকৃতির লোক, চোরাকারবারি বা অবৈধ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে বলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে কিংবা যাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই, তাদের কোনোক্রমেই কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সদস্য করা যাবে না। সব পেশার প্রতিনিধি কমিটির মধ্যে থাকতে হবে। ’ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সদস্যদের কোনো ভাতা দেওয়া হয় না। থানার ওসি এই পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা ওই অঞ্চলের পুলিশের সহকারী কমিশনারকে পাঠালে তিনি এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেন।

পরে কমিটির অনুলিপি পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উপকমিশনার ও মহানগর পুলিশের কাছে পাঠানো হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব হলো, ছোটখাটো ধর্তব্য অপরাধ, যেমন—পারিবারিক বিরোধ, জমিজমা লেনদেনসংক্রান্ত অভিযোগ, বিভিন্ন গোষ্ঠী বা দলের মধ্যে বিবাদ আলোচনার মাধ্যমে আপস-মীমাংসা করে থানার ওসিকে অবহিত করা। কমিটি মীমাংসায় ব্যর্থ হলে ওসি আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিটি সার্ভিসেস) মো. মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীতে থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট মিলে ৮১২টি পুলিশিং কমিটি আছে। এর সদস্যসংখ্যা ২৩ হাজারেরও বেশি।

কমিটির মেয়াদ দুই বছর। এই কমিটির মেয়াদ এখন এক বছর করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কমিটির কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে কিংবা তিনি গ্রেপ্তার হলে তাঁর সদস্যপদ তাৎক্ষণিক বাতিল করা হবে। গ্রেপ্তার হওয়া আওয়ামী লীগের নেতা রায়হান খোকনের সদস্যপদও বাতিল করা হয়েছে বলে জানান তিনি। ঢাকা মহানগরের ৪১টি থানার মধ্যে মাত্র কয়েকটির কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সদস্যদের বিষয়ে নানা অভিযোগের কাগজপত্র প্রথম আলোর কাছে এসেছে।

এর ভিত্তিতে মাত্র ছয়টি থানার চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো: কাফরুল থানা: কাফরুল থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট মিলে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সদস্যসংখ্যা ৬৫৪। কাফরুল থানার ধামালকোট-লালসরাই কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি থানায় ডাকাতি ও অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে। ২০০৯ সালের অক্টোবরে ওই থানার গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সূত্রে কাফরুল থানার পুলিশই তাঁকে গ্রেপ্তার করে। আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০০৬ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। গ্রেপ্তারের পর তিনি নেত্রকোনা কারাগারে ছিলেন।

গত বছরের মার্চে জামিন পেয়েছেন এবং অক্টোবরে এই কমিটির সভাপতি হয়েছেন। তিনি ঢাকা মহানগরের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সাবেক সভাপতি। ধামালকোট-লালসরাই কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সদস্য মুর্তজা আলী মহাজনের বিরুদ্ধেও কাফরুল থানায় বাড়ি ভাঙচুর, মারপিটের মামলা আছে। গত বছরের ডিসেম্বরে মুর্তজা আলী ও তাঁর সহযোগীরা ধামালকোটের বাসিন্দা ফিরোজ মিয়ার বাড়ি ভাঙচুর এবং তাঁকে পিটিয়ে জখম করেন। ফিরোজ মিয়া মুর্তজা মহাজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন।

মহানগরের ৯৫ নম্বর ওয়ার্ড কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সভাপতি মো. মমিন খান। তিনি ১৫ নম্বর ওয়ার্ড বাস্তুহারা লীগের সভাপতি। তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০০৩ সালে ভাসানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প কর্তৃপক্ষ মামলা করে। মহানগরের ৯৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নাগর মিয়া (চেয়ারম্যান) একই ওয়ার্ডের কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সভাপতি। কাফরুল থানার পুলিশ সন্ত্রাসের অভিযোগে তাঁকে একবার গ্রেপ্তার করেছিল।

তাঁর বিরুদ্ধে ওই থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) আছে। জানতে চাইলে কাফরুল থানার ওসি আবদুল লতিফ বলেন, ‘নিরপেক্ষ ও সমাজের ভালো লোক দিয়ে কমিটি গঠন করার কথা। এই কমিটি গঠনের সময় আমি এই থানার দায়িত্বে ছিলাম না। তাই কমিটির সদস্যদের সম্পর্কে ভালো জানি না। কারও বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা থাকলে তা এখন দেখব।

’ কমিটির সদস্যদের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মতিউর রহমান দাবি করেন, সাত-আট মাস আগে কমিটির এক সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠায় তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ওয়ার্ড কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানানো হলে তিনি বলেন, সভা ডেকে এসব কমিটি তিনি ভেঙে দেবেন। শাহ আলী থানা: ক্যান্টনমেন্ট ইউনিয়ন কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সহসাধারণ সম্পাদক কবির আহমেদ মামুন। তিনি ক্যান্টনমেন্ট ইউনিট আওয়ামী লীগের সদস্যও। ২০০৯ সালে শাহ আলী থানার জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে (ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন) সংঘটিত জনি হত্যা মামলার আসামি তিনি।

মামলাটি বর্তমানে ডিবি তদন্ত করছে। কবির আহমেদ মামলার কথা স্বীকার করে বলেন, জনির বাবা কালা বাবুল বাদী হয়ে তাঁকেসহ পাঁচজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেছেন। শাহ আলী থানার এইচ ব্লকের কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সভাপতি জালাল হোসেন ওরফে বাবুল তালুকদার। তিনি ঢাকা মহানগরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ৩ নম্বর ইউনিট আওয়ামী লীগের সভাপতিও। ২০০৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের এইচ ব্লকের (গুদারাঘাট) বাসিন্দা আবদুস সাত্তার।

মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে বাড়ি দখল, লুটপাট ও মারধরের অভিযোগ আনা হয়েছে। একই কমিটির আরেক সদস্য শাহজাহান তালুকদার ওরফে মিয়া তালুকদারও জমি দখল মামলার আসামি। মিরপুরে সংঘটিত গৃহবধূ আলেয়া বেগম হত্যা মামলার প্রধান অভিযুক্ত টি এম বদিউজ্জামান শাহ আলী থানা কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির ডি ব্লক ইউনিটের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে, নিহত গৃহবধূ আলেয়া বেগম বদিউজ্জামানের বাড়ির ছয়তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। পরে তিনি বদিউজ্জামানের কাছ থেকে ওই ফ্ল্যাট কিনে নিয়েছিলেন।

আলেয়ার কেনা ফ্ল্যাটটি অবৈধভাবে দখলে নিতে এবং ফ্ল্যাট কেনার চুক্তিপত্র হস্তগত করতেই গত ৩ অক্টোবর ওই ফ্ল্যাটে তাঁকে খুন করা হয়। সদ্য বদলি হওয়া শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ (বর্তমানে কাফরুল থানা) বলেন, আলেয়া হত্যা মামলার প্রধান অভিযুক্ত বদিউজ্জামান দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযানও চালানো হয়েছিল। কিছুদিন আগে তিনি হাইকোর্ট থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়েছেন। এ কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.