লেখা আরেকজন ব্লগার ছুরিকাহত। নাম সানিয়ুর। আততায়ী কে, তা এখনও জানা যায় নি। আহতের বক্তব্য অনুসারে, আততায়ী পাঞ্জাবি পরা ছিল। কিছুদিন ধরে ফেসবুকে সে স্ট্যাটাস দিচ্ছিল যে, সে আক্রান্ত হতে পারে।
এরপরে এই আঘাত। তাই একটা ধারনা নিজের অজান্তেই দানা বাঁধতে চাইছে, আর তো হচ্ছে, এটা জামায়াত শিবিরের কাজ। গণজাগরণ মঞ্চ শুরু হওয়ার পর ব্লগারদের ওপর এটা দ্বিতীয় আক্রমণ। প্রথম আক্রমণ ছিল ব্লগার রাজীবের ওপর।
রাজীবের ওপর আক্রমনের পরে খোঁজ শুরু হয়ে যায়, কেন মেরে ফেলা হল এই ব্লগার কে? আর যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হল, তা হচ্ছে মহানবী (সাঃ) কে কটাক্ষ করে লেখালেখি করার কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়।
তাঁর মৃত্যুর পরে মহানবী (সাঃ) কে কটাক্ষ করা বেশ কিছু লেখালেখি ফেসবুক, ব্লগে ছড়িয়ে দেয়া হল। বলা হল এগুলো রাজীবের লেখা। রাজিব নেই, ফলে এর সত্যতা যাচাই সম্ভব না। এর পরে নাস্তিকবাদ আস্তিকবাদ এমন সব বিবাদের সুত্রপাত হল। এই মৃত্যু আন্দোলনে নতুন এক মোড় এনে দিল।
মজার যে ব্যাপারটা হলো তা হচ্ছে লেখালেখি র জন্য কাউকে হত্যা করা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে আলোচনার বদলে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসলো গণজাগরণ মঞ্চ আর ধর্ম অবমাননাকারীদের মধ্যে একাত্মতা।
ব্লগাররাই এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল। আর ব্লগারদের ভেতর যেহেতু একজন নাস্তিক তাই এই আন্দোলন করছে নাস্তিকরা। কেন করছে? কারণ এঁরা ইসলামের শত্রু। তাই এদের নির্মূল করা জরুরী, চাই জিহাদ।
যে কারণে ব্লগাররা এই আন্দোলনের সুত্রপাৎ করেছে তা নিয়ে আলোচনা কিংবা আন্দোলন কোনটাই করা সম্ভব না। তাই এই আন্দোলনকে আঘাত করার চেষ্টা হল পেছনের দরজা দিয়ে। প্রথমবারের আঘাত মন্দ হয় নি। সেই একই ফর্মুলার পুনরাবৃত্তি করতে এই আঘাত কি না এই চিন্তায় এখন ব্লগার আর ফেসবুকে ঘুরছে।
এই আকস্মিক মোড় ব্লগারদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিল।
গণজাগরণ মঞ্চের ধরণ পাল্টাল। নিজেরা আস্তিক কিংবা ধর্মের সঙ্গে এই আন্দোলনের কোন যোগসুত্র নেই, এমন সব বক্তব্য শুরু হয়ে গেল। শুরুতে চার ধর্মের ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করার নিয়ম শুরু হল। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর প্রমাণ দাখিলের চেষ্টা। সুযোগটা কিছু দৈনিক লুফে নিল।
শুরু হল ব্লগারদের বিরুদ্ধে বিষেদগার। বিতর্কিত কিছু লেখা। পাল্টা ব্যবস্থার হুমকি, পত্রিকা পোড়ান। সেই পেছনের দরজার ব্যবহার। বেড়ে গেল পত্রিকার সারকুলেশান।
অবস্থা বেগতিক দেখে প্রধানমন্ত্রী ধর্মের বিরুদ্ধে কটাক্ষকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলেন। কেন কিংবা কাকে খুশী করার জন্য এমনটা করলেন বুঝলাম না। হতে পারে পেছনের দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
রাজিব হত্যা দিয়ে যে প্ল্যানের শুরু হয়েছিল, মুসল্লিদের ব্যানারে জামায়াত শিবিরের হামলা দিয়ে তাঁর প্রথম ধাপ সম্পন্ন হল। এরপর কিছুদিন চলল লাশের রাজনীতি।
জ্বালাও পোড়াও, মন্দির, সংখ্যালঘু, নাস্তিক, চাঁদে ছবি আবিস্কার। সব মিলিয়ে এক জগা খিচুরির এর পরিণতি হল প্রায় শো খানেক লাশ। এর পরে কি? এই প্রশ্ন যখন সবার মনে, তখনই ঘটল এই হামলা। প্ল্যানের অংশ নাকি স্রেফ কাকতালীয় ব্যাপার, সাধারণ একটা ছিনতাই প্রচেষ্টা, এখনও বোঝা যাচ্ছে না।
এরপরে ব্লগারদের প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষ্যনীয় রকমের রক্ষণাত্মক।
প্রথম যে কাজটা তাঁরা করল তা হচ্ছে, ফেসবুকে জানান দিল ‘সানিউর ব্লগার কিনা জানি না। তবে সে এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত না। ‘ বোঝানোর চেষ্টা হল আন্দোলনের উদ্যোক্তার সে কেউ না। লক্ষণীয় ছিল বক্তব্যের পেছনের ভীতু মানসিকতা, ‘আবার আস্তিকবাদ নাস্তিকবাদের ঝামেলায় পড়তে চাই না। ‘ মুক্তচিন্তা, বাক স্বাধীনতা এসব যুক্তিতে এখন যাওয়া নিরাপদ না।
এই পরিস্থিতি নিজে থেকেই তৈরি হল না তৈরি করা হল কে জানে? আন্দোলন সাবোট্যাজ করার আরেকটা পেছনের রাস্তা হতে পারে, এই ভয়ে আছেন উদ্যোক্তারা।
এই প্রতিক্রিয়া বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিল। কারা ব্লগার? যে কোন একটি ব্লগে লেখালেখি করলেই ব্লগার না আরও কোন যোগ্যতা থাকা জরুরী। অন্ততঃ কয়টি ব্লগ লিখলে ব্লগার হওয়া যায়। তাঁর চেয়েও বড় কথা একজন ব্লগার কি না সে ব্যাপারে বক্তব্য দেয়া জরুরী কি না।
এই আন্দোলনের সঙ্গে কেউ জড়িত কি না, শাহবাগে যায় কি না এই নিয়েই বা বক্তব্য দেয়া উচিৎ কি না? কিংবা একজন ব্লগে কি নিয়ে লেখালেখি করে তার ব্যাখ্যা দেয়া এই মঞ্চের আওতায় পরে কি না?
অচিরেই দুই শ্রেণীর ব্লগারের সৃষ্টি হল। এক ধরণের যারা এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত আর এক ধরণের যারা এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত না। এখানে আসা যাওয়া করতে পারে সবাই তবে তাঁরা উদ্যোক্তা না। তাঁদের লেখালেখির জন্য পূর্ণ রেস্পন্সেবিলিটি কেবল তাদেরই। ধর্ম বিরোধী কিছু যদি লিখে থাকে তাঁর দায় দ্বায়িত্ব এই মঞ্চের কারো না।
এতো সব দ্বিধা দ্বন্দের পিছনে ছিল একটি ভীতি, নাস্তিকবাদ নিয়ে আবার না বিক্ষোভ শুরু হয়। একটা ব্যাপার কি উদ্যোক্তারা ভেবে দেখেছেন? এই ধরণের বক্তব্য কাদের জন্য? আদৌ তাঁরা এই বক্তব্য পড়বে? নাকি এই ব্যাখ্যা শুনে তাঁদের প্ল্যান পাল্টাবে?
আসলে ধর্ম বিদ্বেষী হওয়ার মাধ্যমে খুব সহজেই বিতর্কিত হওয়া যায়। এই ফর্মুলায় খুব সহজেই পেছনের দরজা দিয়ে সেলিব্রিটি হওয়া যায়। ধর্মকে কটাক্ষ করে কিছু লিখলেই হবে সমালোচনা। আর সমালোচনা হলেই আসবে পত্র পত্রিকায়।
বাক স্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তা এমন সব কঠিন কথাবার্তা নিয়ে শুরু হবে তর্ক বিতর্ক । অবশেষে সাহসী এক সেলিব্রিটি লেখক। এই ফর্মুলায় যদিও আক্রান্ত হওয়ার রিস্ক আছে তারপরও সেলিব্রিটি হওয়ার লোভে অনেক এই পথে যেতে পিছপা হচ্ছেন না। বিপাকে পড়েছে মঞ্চ।
এ ধরণের সমস্যা প্রতিনিয়ত তৈরি হতেই থাকবে।
এর মাঝেই আন্দোলন এগুতে হবে। তবে আন্দোলন এখন কোন পথে যাবে তা নির্ভর করছে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের ওপর। পছন্দ করি কিংবা না করি দাবীগুলো সরকারের কাছেই জানাতে হবে। দাবীগুলোকে সরকার যুক্তিসঙ্গত মনে করছে কি না? মন করলে তাঁরা পরবর্তী পদক্ষেপ কি নিতে চায়? এখনই মানবে না দাবী গুলোকে নির্বাচনের হাতিয়ার করার চিন্তা করছে? নির্বাচন কখন দিতে চায়? বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনায় যাবে না সংঘর্ষে? সামনের দরজা ব্যবহার করবে না পেছনের দরজা?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।