লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। পর্দার পেছনের গল্প
মোহাম্মদ ইসহাক খান
শুটিং হচ্ছে। হাসির একটি গল্প অবলম্বনে নাটক প্রচার করবে স্যাটেলাইট চ্যানেল, সেটার শুটিং চলছে।
এই মুহূর্তে যে দৃশ্যটির শুটিং হচ্ছে, সেটা এই নাটকের একদম শুরুতে থাকবে। কলার খোসায় আছাড় খেয়ে একজনের পড়ে যাওয়ার দৃশ্য। খোসাটি রাস্তায় পড়ে আছে, একজন আনমনা ব্যক্তি হেঁটে আসছে, অসাবধানে সে জিনিসটার ওপর পা ফেলবে এবং পপাৎ ধরণীতল হয়ে যাবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা বিকট হাসির আওয়াজ হবে, সেই সাথে কমেডি মিউজিক। নায়ককে আছাড় খেতে দেখে নায়িকা হাসতে হাসতে এদিকে এগিয়ে আসবে।
এখান থেকেই নাটকের শুরু।
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দৃশ্যটির শুটিং হচ্ছে সবার শেষে। নাটক কিংবা সিনেমায় এই ব্যাপারটা হরহামেশাই করা হয়ে থাকে, সুবিধামত সময়ে আলাদা আলাদা করে শুটিং করে যে দৃশ্য যে জায়গায় যাবে, সেখানে ঠিকমতো বসিয়ে জোড়া দিয়ে দেয়া হয়। কার সাধ্য যে বলে কোন দৃশ্য আগে ধারণ করা হয়েছে, কোনটা পরে?
অবশ্য অসাবধানে যে মাঝেমধ্যে ভুল হয় না, তা নয়। আনাড়ি লোকের হাতে পড়লে এমনটা হতেও পারে।
এমনও দেখা গেছে, নায়ক যখন নায়িকার হাতে গোলাপ ফুল দিতে এগিয়ে আসছে, তখন তার গায়ে লাল শার্ট। কিন্তু ফুল দেয়ার পরেই দেখা গেল, নায়ক পরে আছে নীল শার্ট। শুধু তাই নয়, গোলাপ ফুল হয়ে গেল রজনীগন্ধা। পরিচালকসহ সবার কাজ হচ্ছে এসব "সিলি মিস্টেক" এড়ানো। অবশ্য আজকাল কেউ পুরো নাটক দেখে না, চ্যানেল ঘুরানোর তালে থাকলে এসব অসামঞ্জস্য কারো চোখেই পড়ে না।
কাজেই এসব ভুল বাড়তে থাকাটাই স্বাভাবিক।
এই নাটকের ব্যাপার ভিন্ন। এটা কোন নবাগতদের অভিনীত কিংবা আনাড়ি পরিচালকের তৈরি নাটক নয়। নাটকের পরিচালক আনিস হোসেনের খ্যাতি আকাশচুম্বী। তিনি বেছে বেছে সিলেক্ট করেছেন সেরা নায়ক-নায়িকা।
নায়ক হাসিব আহমেদ অনেকদিন ধরেই জনপ্রিয়। সেই তুলনায় নায়িকা মিস তানিয়া খানিকটা নতুন হলেও দক্ষ অভিনয়ে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছেন। অন্যান্যরাও প্রবীণ, অভিজ্ঞ।
যিনি ক্যামেরার পেছনে আছেন, সেই বরেন্দ্র কুমার ভৌমিক জাতীয় পর্যায়ে তিনবার সেরা ক্যামেরা ওয়ার্কের জন্য পুরষ্কার জিতে নিয়েছেন।
একটা নাটককে দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার কিছু নিয়মকানুন আছে।
প্রথমত, "চেনা" লোকজনকে দিয়ে অভিনয় করাতে হবে, যাতে দর্শক চ্যানেল বদলাতে থাকলেও এক মুহূর্তের জন্য থামে। দ্বিতীয়ত, কাহিনী হতে হবে গতিময়, হাই থট জিনিসপত্র দর্শকের পছন্দ নয়, কাহিনী "ঝুলে পড়তে" দেখলে তারা কেটে পড়বে। তৃতীয়ত, কাজটাতে পেশাদারিত্বের ছোঁয়া থাকতে হবে, সবাই যেন আগে থেকেই জানে যে এই পরিচালক যা বানাবেন, তাতে কিছু "জিনিস" অবশ্যই আছে।
সেদিক থেকে এই নাটকের কোন খুঁত নেই, এই নাটকের সাথে যারা জড়িয়ে আছেন, তাঁরা সবাই আগাপাশতলা, পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত পেশাদার। সবাই নিজের নিজের গগনে উজ্জ্বল এক একটা তারা হয়ে জ্বলছেন।
কাহিনীটা জমজমাট। শ'খানেক চ্যানেলের হাজারখানেক নাটকের মধ্য থেকে একটা বিশেষ নাটককে "হিট" করানো সোজা কথা নয়। হাসির নাটককে "হিট" বানানো তো আরও কঠিন, কারণ মানুষকে হাসানোর ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে অনেক সহজ মনে হলেও, যারা করেন, তাঁরাই জানেন যে কাজটা কত দুরূহ। হাসা যতটা সহজ, হাসানোটা ততই কঠিন, কারণ হাসি তৈরি করতে হলে দর্শকের মানসিকতা খুব ভালোভাবে বুঝতে হয়।
শুটিং এগিয়ে চলছে।
কলার খোসায় নায়ক হাসিবের আছাড় খাওয়ার ব্যাপারটা ক্যামেরায় পরিচালক এমন কারিকুরি করে ধারণ করিয়েছেন, দর্শক দেখে ভাবতে বাধ্য হবে, হরহামেশাই তারা মানুষকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে না, যেন এই প্রথম দেখছে।
এটা তো গেল শুধু একটি দৃশ্য। এমন অনেক হাসির দৃশ্য নিয়ে ভরা এই নাটক, একবার দেখতে বসলে হাজারটা বিজ্ঞাপন সত্ত্বেও দর্শক আঠার মতো চোখ লাগিয়ে রাখবে টিভিতে, এটা একেবারে নিশ্চিত।
হাসির নাটকটি, অর্থাৎ "প্রলয়ঙ্কর প্রলয়" এর ফাইনাল এডিটিং হয়ে গেছে। এবার শুধু দিন গোণার পালা নাটকটি প্রচারের।
কলাকুশলী যারা এর সাথে যুক্ত ছিলেন, হাড়ভাঙা খাটুনির পর তাঁদের এবার অবসর জুটল। এই ক'দিন সময়মত কাজ শেষ করার তাড়ায় তাঁরা কেউই ঠিকমতো খেতে, ঘুমোতে, কিছুই করতে পারেন নি। চলুন, এই সুযোগে দেখে আসা যাক, এই হাসির নাটকের পেছনে যারা ছিলেন, যারা সবসময় পেছনেই থাকেন, তাঁদের কে কী করছেন।
পরিচালক আনিস হোসেন বিষণ্ণ চিত্তে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন।
তাঁর স্ত্রী সেলিনা ছেলেকে নিয়ে চলে গেছেন।
তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সাথে থাকা আর সেলিনার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। দুঃখ নিয়েই তিনি বলেছেন, আনিস, আমি অনেক বছর তোমাকে দেখেছি, চিনতে আমার আর বাকি নেই। তোমার কাছে স্ত্রী আর পুত্রের চেয়ে তোমার কাজ অনেক বড়। আজ পর্যন্ত ছেলেকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবার কোন সময় তোমার হয়নি, একসাথে বসে একটু গল্প করার সময় হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না।
আমার কথা ছেড়েই দিলাম। আমি চলে যাচ্ছি। তোমাকে কোন দোষ দিচ্ছি না, কাজেই মন খারাপ কোরো না।
তারপর সেলিনা যে কথাটি বলেছিলেন, সেটার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলেন না আনিস সাহেব। সেলিনা খুব স্পষ্ট স্বরে কোন জড়তা ছাড়াই বলেছেন, আমি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবো, সই করে দিয়ো।
শুধু শুধু আমার জন্য দুশ্চিন্তা করে তুমি তোমার কাজে ঠিকমতো মনও দিতে পারছ না, আমিও শান্তি পাচ্ছি না। তার চেয়ে দুজনের আলাদা হয়ে গিয়ে নিজেদের রাস্তা দেখাই ভাল হবে। বাবুর (ছেলের) দায়িত্ব তুমি যদি নিতে চাও, তাহলে আইনী চেষ্টা করে দেখতে পারো, আমি কোন ঝামেলা করবো না। এভাবে অশান্তি নিয়ে বসবাস করে অনেক সময় পার হয়ে গেছে, আরও কিছু সময় নষ্ট হোক, আমি সেটা চাই না।
আজ সকালে আনিস সাহেব ছেলেকে দেখতে আসার অনুমতি চেয়েছিলেন, সেলিনা অনুমতি দেন নি।
হয়তো ধীরে ধীরে তিনি ছেলের জীবন থেকে বাবার সব ছাপ মুছে ফেলতে চাইবেন।
ক্যামেরাম্যান বরেন্দ্র কুমার ভৌমিক একটি ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখে জল। তাঁর একমাত্র মেয়েটি অসুখ হয়ে মারা গেছে। যখন মারা গেছে, তখন সে শেষ সময়ে শুধু বাবাকে দেখতে চাইছিল।
বরেন্দ্রবাবু বলেছিলেন, মা, আমি কাজ শেষ করেই চলে আসবো।
কাজ শেষ হতে হতে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তাঁর মেয়ে যখন অন্য ভুবনে যাত্রা করেছে, তখন বরেন্দ্রবাবু কলার খোসায় আছাড় খাওয়ার দৃশ্যটি ধারণ করছিলেন। তিনি ডিরেক্টরকে কথা দিয়েছিলেন, কাজ শেষ না করে কোন দিকে যাবেন না। তিনি কথা রেখেছেন।
একজন স্বনামধন্য কর্মী কখনো নিজের কথার খেলাপ করেন না, তিনিও করেন নি। মেয়ে মারা যাচ্ছে, তিনি শুনেছেন, কিন্তু তিনি কাজ শেষ না করে, সব দৃশ্য ধারণ না করে বাড়িতে ফিরে আসেন নি, বহুদূরের যে শুটিং স্পট, সেখানেই রয়ে গেছেন। একসময় তাঁর অবসর মিলেছে, কিন্তু তখন আর ফিরে এসে লাভ হয়নি। ছোট্ট মেয়েটি বাবাকে শেষবার চোখের দেখাটি দেখে যেতে পারে নি।
বরেন্দ্রবাবু চোখ মুছতে মুছতে মেয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, মা রে, আমাকে ক্ষমা কর।
আমি খুব খারাপ একজন বাবা। পৃথিবীতে কোন খারাপ পিতা নেই, এটা সত্যি নয়। আছে। আমি সেই খারাপ পিতা।
সাউন্ড এডিটর মুমিন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।
তার স্ত্রী নাসরিন অন্তঃসত্ত্বা ছিল। যখন সে তীব্র প্রসব বেদনায় ছটফট করছিলো, তখন মুমিন শেষ সময়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, সে তখন "প্রলয়ঙ্কর প্রলয়ের" ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ঠিক করছে, ডায়ালগের সাথে দৃশ্যের সমন্বয় করছে। সবকিছু সুচারুভাবে শেষ করে এসেছে সে, কোন খুঁত রেখে আসে নি। পনেরো বছরের অভিজ্ঞতায় সে কোনদিন কোন কাজে গাফিলতি করে নি। হাসপাতালে যখন সে এসে হাজির হয়েছিলো, তখন নার্স এসে তার কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে তুলে দিয়েছিলো, আর আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছিলো আপাদমস্তক সাদা চাদরে ঢাকা নাসরিনকে।
এই মেয়েটি স্বামীকে পাশে না পাবার অভিমান নিয়ে চলে গেছে।
আজ "প্রলয়ঙ্কর প্রলয়" নাটকটি প্রচারিত হবে।
পনেরো বছরের কিশোরী তনিমা খুব খুশি। সে বেণী দুলিয়ে ছুটে এসে টিভির সামনে বসলো, মায়ের হাত থেকে কেড়ে নিলো রিমোট কন্ট্রোল। তার মা তখন স্টার চ্যানেলে "আগলে জনম মোহে বিটিয়া হি কি জো" নামের হিন্দি সিরিয়ালের ১১০৩ তম পর্বটি দেখছিলেন।
মা, জানো না, আজ একটা হাসির নাটক আছে, আনিস হোসেনের?
বলিস কী? জুলেখা হেসে বললেন। দেখি তো কী নাটক?
আনিস হোসেনের নাটক শুনলে যে কেউই বাংলা চ্যানেলে চলে আসে। কাজেই জুলেখা মানা করলেন না। তিনি নিজেও দেখবেন।
চ্যানেল বদলে তাঁরা সেই নির্দিষ্ট চ্যানেলটিতে এসে থামলেন।
নাটক শুরু হল। ক্যামেরা মাটি ঘেঁষে ধরা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে কলার একটা খোসা। ক্যামেরার কারসাজিতে অনেক বড় মনে হচ্ছে খোসাটিকে।
এবার ক্যামেরা উপরে উঠলো। এগিয়ে আসছে গোবেচারা এক যুবকের বেশে নায়ক হাসিব।
কলার খোসার ওপরে পড়ে পিছলে চলে গেল কয়েক হাত, রাস্তার ময়লা কাদায় মাখামাখি। নিশ্চয়ই বেচারাকে সত্যি সত্যি আছাড় খেতে হয়েছে, নকল আছাড় এত নিখুঁত হয় না।
খিলখিল শব্দে হেসে উঠলেন মা আর মেয়ে।
তখন হাজার হাজার বাড়ির ড্রইংরুমে একসাথে এই নাটকটি দেখা হচ্ছিল, আর সবাই থেকে থেকে হেসে উঠছিলেন। কোথাও একা কেউ নাটক দেখছেন, কোথাও দুজন, কোথাও পরিবারসুদ্ধ সবাই।
নাটকটি প্রত্যাশিতভাবেই "হিট" হল। সবার মুখে মুখে ভূয়সী প্রশংসা। অনেক দিন পর নাটক দেখে প্রাণখুলে হাসা গেল। একবারও মনে হয় নি কেউ কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা করছে, বরং মনে হয়েছে, প্রায় দুই দশক আগের বিদগ্ধ রম্য নাটকের যুগটি খানিকক্ষণের জন্য হলেও পরিচালক আনিস হোসেন ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন।
সবাই নাটক দেখলো, হাসলো।
পর্দার পেছনের মানুষগুলোর কাহিনী জানার কারো কোন দরকার নেই।
(৩ ডিসেম্বর, ২০১২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।