আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম, শান্তিচুক্তি এবং ব্লগে পূর্বলিখিত একটি পোস্টের প্রেক্ষিতে কিছু মন্তব্য

জীবনে এই প্রথমবার ব্লগে কিছু লিখলাম বা লিখতে বাধ্য হলাম। মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে শুরুতে ভূমিকার মধ্য দিয়ে ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করতে চাই। এই লেখাটি মূলত আমার পরিচিত এক ব্লগারের অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সাম্প্রতিকতম লেখার প্রেক্ষিতে লিখা। সেই লেখাটি পাবেন এই লিংকে । ব্লগটির লেখক যেহেতু আমার ছোট ভাইয়ের মতোই, তাই লেখক এরকম একটা বিষয় কষ্ট করে তার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণভিত্তিক লেখার মাধ্যমে তুলে আনায় আমার খুবই ভাল লেগেছে।

ব্লগারের সাথে ফেইসবুকে কন্টাক্ট থাকার সুবাদে প্রথমে ওখানেই তার লেখাটির লিংক পেয়েছিলাম, তারপর এখানে আসা। কারণ ওখানে কমেন্ট করার মুহূর্তে মনে হল মন্তব্যটা লেখকের ব্লগে লেখাই ঠিক হবে, যদিও ব্লগে আমি এর আগে কখনো কোন মন্তব্যও করি নি, আমার ভূমিকা আজ পর্যন্ত কেবল ব্লগ পড়াতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। কিন্তু এখানে সদ্যই নিবন্ধন করার পর জানলাম সামুর নবনির্ধারিত নিয়মনীতিতে আমার পক্ষে এখনই অন্য কারো ব্লগে মন্তব্য করাটা সম্ভব নয়। আর প্রথমে লেখাটি যেহেতু মন্তব্য হিসেবেই লিখেছিলাম, তাই এতে এখন বেশ কিছু পরিবর্তন আনার পরও খাপছাড়া লাগাটাই স্বাভাবিক। সেরকম লাগার জন্য আমি দুঃখিত।

লেখকের কথায় বুঝলাম যে শান্তিচুক্তিতে সব কিছুর সমাধান নেই। এমনটা হতেই পারে। এক জিনিসেই সব কিছুর সমাধান তো আশাও করা যায় না! তবে চুক্তি যখন একটা হয়েছেই, তখন তা বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে পরবর্তীতে দীর্ঘসূত্রিতা স্বাভাবিকভাবেই হতাশার জন্ম দেবে, সেই জমাট বাঁধা হতাশাই এখন ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। আর যে চুক্তি এখন হল, তাতে আলাদা করে স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠা বা ঐরকম একেবারে অবাস্তব কিছু তো নেই। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে দ্বিপাক্ষিক দীর্ঘ আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমেই শেষ পর্যন্ত এই চুক্তি হয়েছে।

একসময় স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যারা সশস্ত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল, তারাও তাদের ভুলগুলো ইতোমধ্যেই ধরতে পেরেছে। তার প্রমাণ - সেই আন্দোলন পরিচালনায় শীর্ষ পর্যায়ে যারা জড়িত ছিল, পরবর্তীতে চুক্তির মধ্য দিয়ে তাদের নিজেদের অস্ত্র সমর্পণ। আর এর আগ পর্যন্ত স্বাধীন ভূখণ্ডের দাবিতে তাদের এই চলমান সশস্ত্র আন্দোলনে পাহাড়িদের সবার যে সমর্থন ছিল – এমনও তো না। এতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই আরো অনেক অনেক কম ছিল। অথচ বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময় আন্দোলন বন্ধ করার নামে যা যা ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে সমস্যার সমাধান হওয়া তো দূরের কথা, বরং দিনে দিনে সমস্যা শুধু বেড়েছে, তার সাথে বেড়েছে আন্দোলনের প্রতি অন্য অনেকেরও এক প্রকার নীরব সমর্থন।

শেষ পর্যন্ত যা-ই হোক, চুক্তির পর অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে নিঃসন্দেহে পরিস্থিতির বহুলাংশেই উন্নতি হয়েছিল বলা যায়। এরপর চুক্তির বাদবাদি আরো কিছু ব্যাপারও যদি দীর্ঘসূত্রিতায় ফেলে না রেখে ঠিকঠাকভাবে বা আংশিকভাবেও করে ফেলা হতো, তবে সম্প্রতি বিরোধপূর্ণ ভূমির দখল নিয়ে দুঃখজনকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারও যে অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে – তা হয়তো এতটা প্রকট হতো না। এখন একটা চুক্তি হওয়ার পর তা বাস্তবায়নের আগে মাঝপথে আবারও অন্য আরো এক বা একাধিক উপায়ে সমস্যার সমাধান করতে গেলে শেষমেষ পুরনো সমস্যাগুলিই আরো ভিন্ন মাত্রায় দেখা দেবার আশংকা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর বর্তমানে তো এমনটাই হতে দেখা যাচ্ছে। সশস্ত্র আন্দোলনের বদলে ভিন্নভাবে সমস্যার সমাধানে যাদের মধ্যে সবসময় আগ্রহ ছিল - এমনকি ঘোর সংকটকালীন সময়টাতেও, এখন সরকারের সদিচ্ছার অভাবের কারণে তাদের সাথেই সরকার ও সরকারী প্রশাসনের দূরত্ব বাড়ছে।

আর যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাহাড়িরা বসবাস করে আসছে, যেখানে কিনা তাদের কয়েক পুরুষের বসতভিটা, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি স্বাভাবিকভাবে তাদের একটা মায়া বা আকর্ষণ থাকবেই। দেশকে ভালবাসা বা দেশপ্রেম – যাই বলা হোক না কেন, তার মূলে তো আসলে থাকে নিজের শিকড়ের প্রতি টান। ঘরকে ভাল না বাসতে পারলে দেশকেই বা কীভাবে ভালবাসা যায়! নিজের জন্মস্থান, পূর্বপুরুষের আবাসভূমির প্রতি এমন ভালবাসার তাড়নাতেই, সর্বোপরি দেশের প্রতি ভালবাসার টানেই তো মাতৃভূমিকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষার জন্য তারাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তাছাড়া এসবের বাইরে আরো বলা যায় - পাহাড়িদের অনেকেই শিক্ষাদীক্ষায় দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় বেশ পিছিয়ে। জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদের অধিকাংশই এখনো নিজ আবাসভূমির উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।

অথচ পাহাড়িদের মধ্যে কেবল একাংশ জড়িত এমন একটি আন্দোলনকে স্তিমিত করার জন্য গৃহীত সুদূরপ্রসারী এক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময়ে দেশের সরকারগুলো নানান সু্যোগসুবিধা প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে যেভাবে পাহাড়ি এলাকায় বাঙালি আবাসন, এবং অন্যান্য সব উপায়ে (কু!)পরিকল্পিতভাবে পাহাড়ের পুরো জনপদকে নিজেদের বসতভিটা থেকে উৎখাত করে তাদের উদ্বাস্তু বানিয়ে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিতে চেয়েছে – তা ভাবতেই অবাক হতে হয়। এছাড়া সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক সময়ই আমরা যেসব উপায়ের কথা বলে থাকি, যেমন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা, তা ভিন্ন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। এক্ষেত্রে বলা যায়, শিক্ষায় তুলনামূলকভাবে দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় পিছিয়ে থাকা পাহাড়িরা – যাদের অধিকাংশই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে প্রথমদিকে নিজেদের প্রাপ্য মৌলিক অধিকারগুলো সম্পর্কেই ঠিকমত সচেতন ছিল না - তাদের পক্ষে তখন বিভিন্ন বঞ্চনার মুখে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মতো উপায় নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা ছিল না, বরং এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ঐ সময়ে তাদের সশস্ত্র আন্দোলনের কথাই মনে পড়েছিল। আর যেখানে শিক্ষাবঞ্চিত পাহাড়িদের আত্মসচেতনতার অভাবের সু্যোগে নিজ দেশের সরকারই বল প্রয়োগে, কখনো বা বিভিন্ন কুটকৌশল প্রয়োগে পাহাড়িদের নানাভাবে প্রতারিত করে এসেছে, সেখানে বিদেশি শক্তির পক্ষে তাদের ভ্রান্ত করা ছিল অনেক সহজ। পাহাড়িদের বঞ্চনার উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়েক প্রজন্ম ধরে দুর্গম সব এলাকায় বসবাসরত পাহাড়িদের যখন উপযুক্ত কাগজপত্র দেখাতে না পারার অজুহাতে তাদেরকে সেখানে নিজেদের তিল তিল কষ্টে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা নিজ বসতভিটা থেকে উৎখাত করা হয়, তাদের জায়গাজমি জোরপূর্বক কেড়ে নেয়া হয়, আর তারপর বাইরে থেকে অন্যরা সরকারী সহায়তায় কতগুলো বানানো কাগুজে অধিকারের জোরে আকস্মিকভাবে সেখানে উড়ে এসে জুড়ে বসে!! ব্যাপারটা আরো ভালভাবে বলতে গেলে অনেকটা এইভাবে বলা যায় - রেড ইণ্ডিয়ান বা এরকম কোন জাতি, যারা বছরের পর বছর ধরে দুর্গম কোন দ্বীপ বা এলাকায় থেকে তাকে মনুষ্য বসবাসের উপযোগী করে তুলেছে, এরপর কোন একদিন বাইরের সভ্য জগৎ থেকে কলম্বাস বা ঐরকম কেউ কেউ সেখানে আসতে শুরু করল, তারপর শুরু করল ওইখানে বসবাসরত আদিবাসীদের জায়গাজমি জোরপূর্বকভাবে না হলেও সভ্য(!) পন্থায় দখল, কারণ এইসব আদিবাসীদের কাছে জমিজমার কোন উপযুক্ত দলিল-দস্তাবেজ নেই, কতটা অসচেতন এরা!!! যা-ই হোক, উপরের এই কথাগুলো যে লেখাটির প্রেক্ষিতে লিখলাম বা যেভাবে লিখলাম, তাতে মনে হতে পারে আমি হয়তো এর লেখকের সাথে তেমন বেশি একমত নয়, বরং লেখকের বিরোধিতা করার জন্যই এভাবে লিখলাম।

কিন্তু কোন একটা ছোট দলেও যদি সব বিষয়ে সবসময় সবার মধ্যে মতের মিল দেখা যায়, তবে তেমন বিচারবিবেচনাহীন ঐক্যমত দলের জন্য কতটা শুভফল বয়ে নিয়ে আসবে – সেই বিষয়ে মনে সন্দেহ থেকেই যায়। সবশেষে এইরকম একটি বিষয় নিয়ে ব্লগে লেখার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আমার পূর্বপরিচিত সেই লেখকের উদ্দেশ্যেই মূলত নিচের অংশটুকু আমি এখানে যোগ করলাম। ব্লগের বাইরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে ঘটতে থাকা বিভিন্ন ব্যাপারে; আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স, ইরাক, ইসরাইল, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের ব্যাপারে; আন্তর্জাতিক নানান বিষয়েই হয়তো অনেক সময় আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে নানান কিছু বলে থাকি, তাছাড়া বিভিন্ন ব্লগেও প্রায়ই এরকম অনেক বিষয়ে অনেক ভালো ভালো লেখা লিখতে দেখা যায়। তাতে কোন সমস্যাও নেই – এগুলি নিয়ে আরো বেশি বেশি কথাবার্তা হোক, লেখালেখিও অব্যাহত থাকুক। কিন্তু নিজের দেশে চলতে থাকা সমস্যাগুলি যেন আমাদের চোখের আড়ালে না থাকে।

এগুলো নিয়েও যেন আরো বেশি বেশি লেখালেখি হোক, এগুলোর ব্যাপারেও আমরা যেন সচেতন থাকি, দেশের ভিতরে চলতে থাকা এসব অন্যায়-অনাচারগুলো যেন আমাদের সঠিকভাবে জানা থাকে, এগুলোরও যেন আমরা যে যেভাবে পারি নিজেদের সাধ্যমত প্রতিবাদ করি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।