উত্তর মেরুর দেশ সুইডেনের জনসংখা মাত্র ৯৫,৭৩,৪৬৬ হলেও আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বড়। এত বড় দেশের উত্তর অঞ্চল বলতে গেলে সবসময়ই বরফে ঢাকা থাকে। এসকল অঞ্চলে খুব কম মানুষের বসতি। অন্যদিকে মধ্য সুইডেন থেকে শুরু করে পুরো দক্ষিণ অঞ্চলকে ঘন বসতির শহর বলা যেতে পারে। সুইডেনের রাজধানী স্টকহমে দেশের মূল জনসংখার প্রায় ৫ ভাগের ১ ভাগ লোকের বসবাস।
বর্তমানে স্টকহমে বাস করছে ১,৩৫,৮৬৫ জন।
প্রায় এক মিলিয়নের কিছু বেশি অভিবাসীর বসবাস সুইডেনে। তাদের মধ্যে এক বিরাট সংখ্যার আগমন প্রতিবেশী দেশ ফিনল্যান্ড ও নরওয়ে থেকে। তবে ষাট দশকের দিকে তুরস্ক, গ্রিস, ইতালী ও সাবেক যুগোস্লাভিয়া থেকে শ্রমিক ঘাটতি মেটাতে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতোই সুইডেনও নিয়ে আসে জনবল। পরে সত্তর ও আশির দশকে ইরান, ইরাক, আফ্রিকা ও সাউথ আমেরিকার দেশগুলো থেকে বেশ কিছু মানুষ সুইডেনে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করে।
সর্বশেষ নব্বই দশকে সোমালিয়ানদের এক বিরাট সংখ্যা প্রতি বছর সুইডেনে আসা শুরু করে যা এখন পর্যন্ত বহাল রয়েছে। সুইডেনে বাংলাদেশিদের আগমন ঘটে ’৭৫-এর আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে সামরিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পর। পরে জেনারেল এরশাদের আমলেও সুইডেনে এসে প্রবেশ করে বেশ কিছু বাংলাদেশি। এখনো কিছু বাংলাদেশি সুইডেনে এসে বসবাসের চেষ্টা করছে। তবে বসবাসের অনুমতি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কড়াকড়ি নিয়ম হওয়ায় বাংলাদেশিদের পক্ষে অনুমতি লাভ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে সুইডেনে আনুমানিক দশ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করছে।
অতিরিক্ত অভিবাসী প্রবেশের কারণে অনেক সুইডিশরা বিষয়টিকে এখন আর আগের মতো এত সহজভাবে গ্রহণ করছে না। অন্যদিকে দেশের বেকার সমস্যা বর্তমানে ৮.৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অভিবাসীরা তাদের কাজ নিয়ে যাচ্ছে বলে কিছু কিছু সুইডিশ অভিযোগও করছেন। অভিবাসীবিরোধী সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ২০১০ জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সুইডিশ পার্লামেন্টে ইমিগ্রান্ট বিরোধী বর্ণ বৈষম্যবাদী রাজনৈতিক দল সেভরিয়া ডেমোক্রাটারনা পার্লামেন্টে আসার সুযোগ করে নিয়েছে।
তাদের মূল লক্ষ্য হলো ইউরোপের বাইরে থেকে আসা অভিবাসীদের সুইডেন থেকে বিতারিত করা। সম্প্রতি স্টকহমের একটি মসজিদ থেকে শুক্রবার মাইকে আজান দেওয়ার অনুমতিকে কেন্দ্র করে দলটি তাদের ভোটের বাক্স আরো শক্ত করার চেষ্টা করছে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি সুইডেনের রাজধানী স্টকহমের একটি মসজিদকে প্রতি শুক্রবার মাইকের মাধ্যমে আজান দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে যা ইউরোপের আর কোথাও নেই।
এদিকে অতিরিক্ত অভিবাসী প্রবেশের কারণে সুইডেনকে এখন এক বিরাট ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে। কারণ বহিরাগত অনেকেই এখন বেকার জীবন-যাপন করছেন।
ভাষা, সংস্কৃতি ও ভিন্ন ধর্মের কারণে সমস্যাগুলো আরো জটিল করে তুলছে। একসময় সুইডেনের উন্নত স্যোশাল সিকিউরিটির কথা সর্বত্র প্রশংসিত হলেও বর্তমানে এর মান বজায় রাখা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিবাসীদের একত্রিত বাসস্থানের ব্যবস্থা করাকে অনেকে সমালোচনা দৃষ্টিতে দেখছেন। ফলে এসকল এলাকায় ড্রাগসসহ বিভিন্ন বেআইনি কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাওয়াকে অনেকে অভিবাসীদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। যদিও অনেক সুইডিশও এধরনের অবৈধ কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
চাকরির বাজার মন্দ হওয়ায় অভিবাসীদের এখন কাজ পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুইডেনে জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় জেনারেশন অভিবাসীদের বেলায়ও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি আনতে বর্তমান ক্ষমতাসীন ডানপন্থী সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বলা যেতে পারে। বর্তমানে সুইডিশদের তুলনায় অভিবাসীদের বেকার সংখ্যা অনেক বেশি। সুইডেনে জন্ম নিয়ে ও স্থানীয় ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষা লাভের পরও শুধুমাত্র ভিন্ন নামের কারণে অনেক অভিবাসীর চাকরিতে ইন্টারভিউতে পর্যন্ত ডাকা হয় না। চাকরির ক্ষেত্রে এই বৈষম্য দ্বিতীয় জেনারেশনের অভিবাসী সন্তানদের মনে চাপা বিক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
বৈষম্য দূরীকরণে দেশে কড়া আইন থাকা সত্তে¡ও চাকরিদাতারা সেই আইনকে কৌশলে এড়িয়ে চলছে। এভাবে দিন দিন একটি চাপা বিক্ষোভ জেগে উঠছে অভিবাসীদের মনে।
সম্প্রতি স্টকহমের হুসবি এলাকায় ৬৯ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ অভিবাসী পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করলে স্থানীয় লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়। পরে এর প্রতিবাদে গত ১৯ মে রোববার রাতে স্টকহমের ওই এলাকায় প্রথম দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। হুসবি এলাকায় দাঙ্গার সময় বিক্ষুব্ধরা কয়েকটি বাড়ির জানালা ভেঙে ফেলে এবং কনটেইনারে অগ্নিসংযোগ করে।
এখানে সরাসরি হামলায় পুলিশ ও দমকল বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য গুরুতর আহত হয়। বিক্ষুব্ধ যুবকেরা এইসময় পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করে। এসকল এলাকায় বসবাসরত বেশিরভাগ বাসিন্দা অভিবাসী। বেকার সমস্যা ও হতাশা এবং সঙ্গে পুলিশের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির জন্য ঘটনার সূত্রপাত বলে অনেকে মনে করছেন। পরে স্টকহমের অভিবাসী অধ্যুষিত স্কোগস এলাকায় একটি রেস্টুরেন্টসহ কমপক্ষে ৪০টি গাড়িতে দাঙ্গাবাজরা আগুন ধরিয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে সুইডিশ লেফট পার্টির স্টকহম সিটি কাউন্সিলের প্রধান আন মার্গারেট লিভ বলেন, আমরা স্টকহমের অভিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোর উন্নতি ও বেকার অভিবাসী যুবকদের কাজ এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করার লক্ষে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের জন্য বাজেটে প্রস্তাব দেওয়া সত্তে¡ও ক্ষমতাসীন ডানপন্থী জোট বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি।
এদিকে স্থানীয় অভিবাসী তরুণ যুবকদের মতে, স্থানীয় পুলিশরা বাড়াবাড়ির সামীনা লঙ্ঘন করেছে। পুলিশের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণেই ঘটনার সূত্রপাত। কারণে-অকারণে পুলিশ অভিবাসীদের উপর অত্যাচার চালায়। সর্বশেষ এই হত্যার ঘটনা পুলিশের পাশবিকাতর উদাহরণ বলে তারা মন্তব্য করেন।
এই কারণে অভিবাসী অঞ্চলে বসবাসরত লোকজন পুলিশের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী আচরণেরও অভিযোগ তুলেছে।
স্টকহমের পুলিশের মুখপাত্র শেল লিনগ্রেন বলেন, সব ধরনের লোকই এই দাঙ্গায় যোগ দিয়েছে। স্টকহমে আমরা এর আগে কখনো এমন দাঙ্গার ভয়াবহতার সম্মুখীন হইনি। পুলিশ দাবি করছে, নিজ অ্যাপার্টমেন্টে একজন মহিলাসহ ওই ব্যক্তি অবস্থান করছিল এবং অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় তালা দেওয়া ছিল। পুলিশ তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার পর লোকটি ছুরি হাতে তেড়ে আসে এবং সেসময় আত্মরক্ষার জন্য পুলিশকে গুলি চালাতে হয়।
এ নিয়ে একটি তদন্ত চলছে। তবে পুলিশের এই তদন্তের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পুলিশকে বাইরে রেখে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত করার জন্য তারা দাবি জানিয়েছেন। স্থানীয় অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, পুলিশের বন্দুক হামলার কারণে অভিবাসী তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। গুলিবর্ষণের ঘটনার মধ্য দিয়ে পুলিশের বর্বরতা ফুটে উঠেছে বলে দেশটির অনেকে অভিযোগ করেছেন।
বুধবার পুলিশের আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এই এলাকায় স্থানীয় বামপন্থী দল ভেনসটার পার্টিরসহ বসবাসরত জনগণ একটি মিছিল বের করে।
সুইডেনের ডানপন্থী জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী ফ্রেদ্রিক রেইনফেল্দ প্রত্যেককে শান্ত হওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, প্রতিবেশীর গাড়ি পোড়ানো কোনো ধরনের স্বাধীনতা হতে পারে না। তিনি স্টকহমের শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। ২৪ মে শুক্রবার বিষয়টি নিয়ে সুইডিশ পার্লামেন্টে বিতর্ক পর্যন্ত হয়। এখানে অভিবাসী বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন সেভরিয়া ডেমোক্রাটারনার সভাপতি জিম্মি অকেসন এমপি সমস্যাকে পুঁজি করে রাজনীতি করার চেষ্টা করেন।
তিনি এসকল এলাকায় সমস্যা সৃষ্টির জন্য সরাসরি অভিবাসীদের দোষারোপ করে পরোক্ষভাবে এদের সুইডেন থেকে বের করে দেওয়ার প্রশ্ন তোলেন।
হুসবি থেকে শুরু হওয়া এই দাঙ্গা এখন সুইডেনের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে সপ্তম দিনেও সুইডেনের রাজধানী স্টকহমের উপকণ্ঠে দাঙ্গা অব্যাহত রয়েছে এবং ক্ষুব্ধ তরুণ বিক্ষোভকারীরা ৩০টির বেশি গাড়িতে আগুন দিয়েছে। দাঙ্গায় পুড়ে গেছে আরও দুটি স্কুল ও একটি পুলিশ স্টেশন। আর এসকল দাঙ্গা এখন সুইডেনে বসবাসরত অভিবাসীদের প্রশ্নে বিভিন্ন বিতর্ক সামনে নিয়ে আসছে।
কারণ সুইডেনের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ এখন অভিবাসী। এই বিরাট জনগোষ্ঠী দেশের মূলধারা থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ও অবহেলিত। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বিশ্বে শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ হিসেবে সুপরিচিত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ সুইডেনের ভাবমূতি বিনষ্ট করছে। দেশটিতে অতীতে কখনোই এধরনের দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি। সুইডিশ জনগণের আশা শান্তির দেশ সুইডেনের এই অশান্ত পরিবেশ শিগগিরই কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবে।
আগামী বছরের সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় রোববার সুইডেনের জাতীয় নির্বাচন। অভিবাসী বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন এধরনের সমস্যাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে বলে অনেকে ধারণা করছেন। ইউরোপের অন্যতম একটি ধনী দেশ সুইডেনের রাজধানীতে এমন লাগাতার দাঙ্গার ঘটনা দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
View this link
***সামুতে ফটো আপলোড করা যাচ্ছে না। এডমিন একটু নজর দিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।