শফিক হাসান
সরকারি বা বেসরকারি ছুটির দিনগুলোয় অনেকেই বেশ বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। খাবারদাবারের স্পেশাল আয়োজনও হয় বাসা-বাড়িতে। বসে জম্পেশ আড্ডা। কেউবা সবান্ধবে ঘুরতে বের হয়। এ ক্ষেত্রে আমার ব্যাপার সম্পূর্ণ উল্টো।
ছুটির দিনেই আমি সবচে বেশি ব্যস্ত! কর্মদিবসে মওকা বুঝে যা একটু ফাঁকি-টাকি মারা যায়, বন্ধের দিন সেটাও তিরোহিত। কারণ ফাঁকিটা দেবো কাকে! এই দুর্ভাগা কপালে ছুটি মেলে না বললেই চলে, উপরন্তু অফিসের চাপে কখনো-কখনো সাপ্তাহিক ছুটিটাও বেহাত হয়ে যায়। কিছু করার বা কিছু বলার থাকে না। ছুটির দিনগুলোতে সাধারণত কাপড়চোপড় ধোয়া, সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা, ইন্টারনেট ব্রাউজিং, প্রিয় কোনো বই পড়া-এসব করা হয়। এসবের পাশাপাশি বছরখানেক আগ থেকে যুক্ত হয়েছে আরেকটা জিনিস-ভ্রমণ।
ভ্রমণের নেশা। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রতি শুক্রবার দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসা যায় এমন কোনো জেলায় বেড়াতে যাবো। দেখে আসবো সে জেলার উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্পটগুলো। কিছু জেলায় বেড়ানো হয়েছেও তবে সেটা খুব একটা উল্লেখযোগ্য না। যেমনটি চেয়েছি তেমন হয়নি।
তবু চেষ্টা করে যাই যথাসাধ্য। তাতে যদিও প্রাত্যহিক কাজ বাধাগ্রস্ত হয়।
এ সপ্তাহে আমন্ত্রণ পেলাম একটি শ্যুটিং ইউনিট থেকে। তারা আউটডোরে শ্যুটিংয়ে যাচ্ছেন, চাইলে আমিও যেতে পারি। প্রস্তাব শুনে আনন্দে এমন লাফ দিলাম আরেকটু হলেই চলমান ফ্যানের পাখায় মাথা ঠুকে যেতো! অবশ্য আমন্ত্রণটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসেনি।
আমার এক অগ্রজ মিজান ভাই একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করেন। শ্যুটিংয়ের প্রয়োজনে প্রতি সপ্তাহে তাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যেতে হয়। তাকে বলে রেখেছি কখনো সুযোগ হলে আমাকেও যেন তাদের সঙ্গে নেয়া হয়। ব্যাটে-বলে মিলে গেছে এবার-সফরসঙ্গী হলাম শ্যুটিং ইউনিটের।
গাড়ি ছাড়বে সকাল সাতটায়।
জ্যামের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই এরকম তড়িঘড়ি করা। যাত্রাস্থলে আমি পৌঁছেছি বরাবর সাতটায়। এ জন্য বাসা থেকে বের হতে হয়েছে ছয়টার পরই। হোটেলে নাস্তা সারার পর শরীরে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলাম। মাস তিনেক আগে এ ভাবটা ভালোই ভুগিয়েছে।
শঙ্কিত হলাম, গতবারের মতো আবার পিজি হসপিটালে দৌড়াতে হবে নাতো! ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কাজ হলো না। ব্যর্থ মনোরথে শুরু করলাম মেডিটেশন। মনছবিতে যদি সুস্থতার অবয়ব ফুটিয়ে তোলা যায়। কিন্তু না, মেডিটেশন উল্টো হেজিটেশনে ফেলে দিলো।
আবার চেষ্টা করছি, কিন্তু হচ্ছে না। এই করতে করতে নরসিংদী পৌঁছলাম। বেলা বারোটার মতো বাজে। গাড়ি থামলো চালাকচর বাজারে। সুন্দর নাম তো! ইউনিটের কেউই ব্রেকফাস্ট করেনি।
একমাত্র আমি ছাড়া। করেই তো বিপদে পড়েছি। খাওয়ার জন্য তারা হোটেলে ঢুকলেন আর আমি ছুটলাম ফার্মেসির দিকে। ওষুধ কিনতে হবে। ট্যাবলেট নিয়ে ফিরলাম হোটেলে।
সেখানে বসেই গলাধঃকরণ করলাম।
চালাকচর বাজারে বোধহয় পরোটা বা তন্দুর রুটি বানানো হয় না। তার বদলে আটার রুটি। গ্রামাঞ্চল বলেই বোধহয় এ অবস্থা। আটার রুটি শ্রমজীবী মানুষদের জন্য ভালো।
একবার খেলে ক্ষুধা লাগে অনেক পরে। পুষ্টিগুণও বেশি। এখানকার আটার রুটির সাইজ দশাসই। রুটি যে এতো বড় করে বানায়, স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। আটার রুটি আমার নিজেরও খুব পছন্দের।
কিন্তু নাড়িভুড়ি উল্টানোর ভয়ে রসনাকে সংযত করলাম। কারণ অনেকক্ষণ ধরেই বমি বমি ভাব হচ্ছে। এখন লোভে পড়ে সে ভাবটাকে চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছে দিতে চাচ্ছি না।
নাস্তা-পর্ব শেষে গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। চালাকচর বাজারের শেষ মাথায় দেখলাম একটা সিনেমা হল।
যাক, এখনো কিছু সিনেমা হল টিকে আছে। স্বস্তির ব্যাপার। পুরো যাত্রাপথে এ স্বস্তিটুকু বেশ কয়েকবার পেয়েছি। অসুস্থ ভাবটা কাটানোর জন্য প্রায় সারা পথ চোখ বন্ধ করে, কখনো ঘুমানোর চেষ্টা করে আবার কখনো এমনিতেই বন্ধ রাখলেও এবার আমার চোখ খোলা। মনও প্রশান্ত হয়ে উঠেছে।
কারণ বমি বমি ভাবটা এখন তেমন একটা নেই। ওষুধের গুণেই হয়তো। মন মেলে পরিপার্শ্বের দিকে তাকাই। সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে গ্রাম, বাড়িঘর, ধানক্ষেত। পুরো যাত্রাপথে দেখেছি রাস্তার দুই পাশে ধানক্ষেত।
দিগন্ত বিস্তৃত। পাকা, সোনালি ধানের গোছা মন ভরিয়ে দেয় অন্যরকম এক ভালোবাসার আবেশে। অন্যরা নাকি ইতোমধ্যে ধানের গন্ধ পেতে শুরু করেছেন। কিন্তু আমি পাচ্ছি না। নাকের ফুটো দুটো বন্ধ হয়ে আছে নাকি কে জানে! অবশ্য অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না কখনো ধানের গন্ধ নিয়েছি কিনা এবং ধানের গন্ধ বলে আসলেই কিছু আছে কিনা! যদিও নিজেদের জমিতে এখনো চাষাবাদ হয়।
বাড়ির চারদিকেই ধানক্ষেত। তার মধ্যে তিন দিকে আমাদের নিজস্ব জমি। কিন্তু ধানের গন্ধ...।
আহ, কতদিন পর গ্রাম দেখছি। দ্বীপের মতো জেগে থাকা বাড়ি ঘর, গ্রাম্য সরু-সর্পিল পথ, শ্লথ গতির যানবাহন, গ্রামের মানুষ, স্কুল ফেরত কিশোর-কিশোরী...।
দেখি, কেবলই দেখে যাই। দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে চোখে-মুখে মুগ্ধতার অদৃশ্য কায়া একের পর এক বাসা বাঁধে।
চলতে চলতে গাড়ি থামে নান্দাইলে। নান্দাইলের নাম অনেক শুনেছি কিন্তু এই প্রথম আসা, স্বচক্ষে দেখা। বোধহয় হুমায়ূন আহমেদ’র কোনো একটা নাটক বা উপন্যাসের চরিত্র আছে-নান্দাইলের ইউনুস।
এ ইউনুসের এতোই খ্যাতি, ভাইভা বোর্ডেও প্রশ্ন আসে-নান্দাইলের ইউনুস কে?
সেই বিখ্যাত নান্দাইলে এখন আমি। আমরা থামি। মানে গাড়ি থামে! না থেমেও উপায় নেই, কারণ এটাই গন্তব্য। দৈনিক কালের কণ্ঠ’র স্থানীয় প্রতিনিধি আলম ফরাজী আগে থেকেই আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। ফোন করার পরই তিনি চলে এলেন কয়েক মিনিটের ব্যবধানে।
আলম ভাই আমাদের নিয়ে যান রাজুর উদ্দেশে। বলা দরকার, অনুষ্ঠানটা যা কিছু বিচিত্র বা অলৌকিক সে সব বিষয় নিয়েই। কখনো কখনো ভীষণ মজারও।
আমরা রাজুর দেখা পাই। তাকে নিয়েই প্রথম দৃশ্যায়ন।
সর্বভুক হিসেবে রাজু বিশেষ ‘খ্যাতি’ অর্জন করেছেন। এলাকায় তো বটেই, এলাকার বাইরেও, দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে আছে তার কীর্তিগাথা। সবকিছুই খান রাজু-সাপ, ব্যাঙ, বৈদ্যুতিক বাতি, সার, কীটনাশক...। দশ বছর আগে দৈনিক ইত্তেফাকে রাজুকে নিয়ে আলম ভাই ফিচার লিখেছিলেন-কী খায় না রাজু?
হ্যাঁ, একটা জিনিস খান না রাজু, মানুষের মাংস। তার বাইরে সবই খান তিনি।
তবে এখন তার ঐতিহ্য অনেকাংশে ধসে পড়েছে। নেশা করে শরীরের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছেন। দেখলেই বোঝা যায় তিনি যে নেশাসক্ত। পেশাগত জীবনে রাজু চা দোকানদার, মাঝে-মধ্যে অন্যের জমিতে কামলাও খাটেন। কয়েক বছর ধরে রাজুর মাথার দুই একটা তার নড়ে গেছে বলে স্থানীয়দের ধারণা।
প্রমাণ কিছুটা আমরাও পেয়েছি।
রাজু এলে তাকে প্রশ্ন করা হলো-তিনি কী পারেন, আজ কী কী দেখাতে পারবেন। উত্তরে অপ্রাসঙ্গিকভাবে রাজু নিজের ঢোলে কয়েকটা বাড়ি দিলেন। ‘মেয়র’ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন তিনি, এলাকাবাসী ইতোমধ্যে তাকে মেয়র সাব ডাকা শুরু করেছে! তার জনপ্রিয়তাও উত্তরোত্তর বাড়ছে!
নিজের পারদর্শিতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, বাঁশি বাজিয়ে দশটি সাপ জড়ো করবেন। সাপ তার সঙ্গে কথা বলবে।
উন্মাতাল নৃত্যের পাশাপাশি সাপগুলো বারাক ওবামার হয়ে ভাষণ দেবে। সাপের ভাষা তো আর সাধারণ মানুষ বুঝবে না-সাপের ভাষার অনুবাদ রাজু শোনাবেন!
এমনতর কথাবার্তা, কেচ্ছাকাহিনী। ক্ষুদ্র গল্পবাজ হিসেবে কথার ফানুস ভালোই ওড়াতে পারেন তিনি।
শ্যুটিং ইউনিট দেখলো এ লোকের কাছাকাছি অবস্থান করলে বারাক ওবামার মতো আরো রথি-মহারথির গল্পই শুনতে হবে কেবল, কাজের কাজ তেমন কিছুই হবে না। অন্যদিকে আরো দুইটা কাজ আছে, যা দিনে দিনেই সারতে হবে।
শেষে রাজুকে বলা হলো, তিনি আজ যে নৈপুণ্য প্রদর্শন করবেন, তার আনুষঙ্গিক উপকরণ জোগাড় করে রাখতে। আপাতত এ এলাকার কাছেই একটা কাজ সেরে গাড়ি আবার রাজুর কাছে আসবে।
এবারো সাংবাদিক আলম ফরাজীর নেতৃত্বে আমরা যাই তুরন্তিপাড়া গ্রামে। এ তুরন্তিপাড়া গ্রামেরই একজন মানুষ সেই ১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করে যাচ্ছেন। অবিশ্বাস্যই বটে! এই কম্পিউটার, ইন্টারনেটের যুগে, যে সময়ে মুদ্রণশিল্প এগিয়ে গেছে অনেকদূর-এ সময়েও হাতে লেখা পত্রিকা?
হাতে লেখা পত্রিকার উদাহরণ হিসেবে যায়যায়দিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, বর্তমানে মৌচাকে ঢিল পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমানের কথা জানি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তিনি হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করতেন। মানে হাতে লিখে তারপর ফটোস্ট্যাট। সে সময়ে এটা খুব একটা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু এখন, এ সময়ে!
অবশ্য হাতে লেখা পত্রিকার সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে আমাদের এক বন্ধু জালাল উদ্দিন’র কথা বলতে পারি। তিনি মৌলভীবাজার থেকে হাতে লেখা একটা লিটলম্যাগ বের করতেন।
নাম-মাছরাঙা। এখনো করেন কিনা জানি না। কারণ অনেক বছর ধরে সৌজন্য সংখ্যা পাচ্ছি না।
হাতে লেখা এ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক এ ‘ক্ষ্যাপাটে’ মানুষটির নাম আফেন্দি নূরুল ইসলাম। তার পত্রিকার নাম-বঙ্গবাণী।
এ ফোর সাইজ এ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক ছাড়াও একাধারে তিনি সংবাদদাতা, প্রচারক আরো অনেক কিছু। বঙ্গবাণী মূলত ত্রৈমাসিক পত্রিকা। তবু প্রায় সময়ই ছন্দপতন ঘটে। সময়মতো পত্রিকা বের হয় না। তাতেও বড় কোনো সমস্যা নেই, কারণ তাঁর পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিলের ভয় থাকলে তো! প্রথমে হাতে লিখে তারপর ফটোস্ট্যাট করা হয় পত্রিকাটি।
তারপর এটি বিলি করা হয় স্থানীয়, গণ্যমান্য মানুষদের মাঝে। সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে। এছাড়াও তাঁর বেশকিছু গল্প, কবিতার বইও বেরিয়েছে। সবই স্থানীয়ভাবে করা বলে প্রোডাকশন কোয়ালিটিও অতটা ভালো না। সবচেয়ে বড় কথা, পাঠকের হাতে সেভাবে পৌঁছায়নি।
তিনি চেষ্টা করছেন, বইগুলো আবার ছেপে পাঠকের হাতে পৌঁছানোর। এখন প্রকাশক পেলেই হয়। প্রকাশক খুঁজছেন তিনি। যদিও মফস্বল শহরে বসবাস করে কাজটা তাঁর জন্য কঠিনই হয়ে যায়। তবু তিনি আশায় আছেন...।
কর্মজীবনে ছিলেন স্থানীয় শহীদ স্মৃতি কলেজের শিক্ষক। সৎ, আদর্শবান হিসেবে এলাকায় নামডাক আছে। এখন অবসরে। এক সময় দৈনিক পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে প্রচুর চিঠি লিখেছেন। সঙ্গত কারণেই পত্রিকাগুলো সব চিঠি ছাপতে পারতো না।
অধ্যাপক আফেন্দি নূরুল ইসলামের মনে হলো, জাতীয় পত্রিকার দিকে মুখ তুলে চেয়ে না থেকে নিজের লেখা নিজেই ছাপানো যায়। লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে জানানো। বৃহৎ পরিসরে না হলেও ক্ষুদ্র পরিসরে তার কাজটি করা যাবে। এ লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য থেকেই ত্রৈমাসিক বঙ্গবাণীর। প্রথম প্রকাশ : ১৯৮৫ সাল।
নানাভাবে ত্রৈমাসিক বঙ্গবাণীর ভিডিও ধারণ করা হলো। তাঁর সাক্ষাৎকারও রেকর্ড করা হলো। সুন্দর গান করেন তিনি, গানও চিত্রায়িত হলো।
এবার আমাদের ফেরার পালা। কিন্তু আফেন্দি স্যার না খেয়ে আসতে দেবেন না।
আমাদের আসার খবর জেনে আগ থেকেই আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছেন। তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করার উপায় নেই। খেতে বসতে হলো। খাবারের বিশাল আয়োজন। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এর পাতে এটা, ওর পাতে ওটা পরিবেশন করলেন।
এ সময় তাঁর একটা কমন সংলাপ ছিলো-আরেকটু দিই?
বাংলাদেশিরা যে অতিথিপরায়ণ তা আবার উপলব্ধি করলাম। এই স্বর্ণহৃদয় মানুষটি এবং তার পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিই। তিনি সময় করে আবার একদিন বেড়িয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানালেন। যদিও জানি না, তাঁর সাথে, তাঁদের সাথে এ জীবনে দ্বিতীয়বার দেখা হবে কিনা...।
শ্যুটিং ইউনিটের গাড়ি আবার রাজুর কাছে আসে।
রাজু মোটামুটি প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। দেখা গেলো কাঁচা সরু রাস্তার পাশে কিছু দোকানের সামনে তিনি এলাকাবাসী কয়েকজন মানুষকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। কয়েকজন বসেছেন চেয়ার পেতে। কয়েকজন দাঁড়িয়ে। বাচ্চা ছেলেও কম নেই, তারা উৎসাহী টিভি চ্যানেলের গাড়ি দেখে।
ক্যামেরা দেখে তো উৎসাহ আরো বাড়লো। বয়স্করা বাচ্চাদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন!
রাজুও আমাদের আপ্যায়ন করানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। তার ভাষায় ‘কান ভাই, না কাইলে কষ্ট পামু!’ তার মনের কষ্ট দূরীভূত করতে আমাদের ‘কাইতে’ হয়। সরবত, বিস্কুট। এবার রাজুর সাথে কাজের কথা হয়।
একটা হচ্ছে, গোটা ডিম খাওয়া, অন্যটা কীটনাশক খাওয়া। বাড়ি থেকে একটা মুরগির ডিমও এনেছেন তিনি, সাইজে বেশ ছোট। অনেকটা কোয়েলের ডিমের মতো, তবে সাইজে দ্বিগুণ। আর ডিম খুঁজে পাননি।
আবার শুরু হলো রাজুর বাকোয়াজি।
কিন্তু দশ বছর আগের রাজু আর দশ পরের পরের রাজু-অনেক ফারাক। এ অবস্থায় তাকে কীটনাশক খেতে দিলে যদি বিষক্রিয়া শুরু হয়? এ ভয়ে আজকের মতো শ্যুটিং স্থগিত করা হলো। তাকে বলা হলো, অন্য আরেকদিন শ্যুটিং হবে। আরেকটা কাজ করার ছিলো, দুই বোনের হালচাষ। কিন্তু এ সময় নাকি তাদের পাওয়া যাবে না।
দেরি হয়ে গেছে। তাই সে চিন্তাও আপাতত বাদ।
রাজু এবং এক দঙ্গল কৌতূহলী গ্রামীণবাসীকে পেছনে ফেলে আমরা আবার রওনা দিই। প্রথমে যাওয়া হয় নান্দাইল বাজারে। এখানে তারা আগে একবার শ্যুটিং করেছেন।
একজন লোক কালিম পাখি পালন করেন-তার ওপর। কালিম গৃহপালিত পাখি না, পোষ মানে না। এ অসাধ্যটাই সাধন করেছেন তিনি। অনেকগুলো কালিম পাখি পালন করছেন তিনি, এগুলো ডিম দিচ্ছে, বাচ্চা ফোটাচ্ছে...। কালিম পাখির বর্তমান পরিস্থিতি জেনে আবার যাত্রা।
এবার গন্তব্য ময়মনসিংহ শহর। গোলকি বাড়িপাড়ায়। এটার খবর পাইয়ে দিয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকের ফিচার পাতা। সে ফিচার পড়ে মনে হলো, একটা প্রতিবেদন করা যায়। অবশ্য এটা অনেকটা গেটিস আইটেমের মতো!
মোকসেদ আলী নামে এক ভদ্রলোক বাঁশ-বেত ব্যবহার করে তৈরি করেছেন তার শিল্পভুবন।
নৌকা, ঘর, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, জাহাজ, আরো কতো কী বানিয়েছেন। দেখলেই তাক লেগে যায়। বাঁশ-বেত ব্যবহার করেও যে এতোকিছু করা যায় স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হবে না।
মোকসেদ আলী সাহেব জানালেন, চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর সখের কাজ হিসেবে এসব করেই তিনি দিন কাটাচ্ছেন। এখন তার যে শিল্পসাধনা, এর সূচনা হয়েছিলো স্কুলজীবন থেকেই।
এরকম প্রক্রিয়া একটা সাইকেল বানিয়ে স্কুলের এক প্রতিযোগিতায় জমা দেন। ভুঁয়সী প্রশংসার পাশাপাশি এটা তাকে দিয়েছে পুরস্কারও। তারপর ও পথে হাঁটা হয়নি তার। পড়াশোনা, চাকরি, সংসার ইত্যাদিতে জড়িয়ে গেছেন। অবসর নেয়ার পর চাগিয়ে উঠলো সেই পুরোনো ঝোঁক।
কিছু একটা করে তো সময় কাটাতে হবে! তাঁর লক্ষ্য, ঐতিহ্যকে ধরে রাখা। হাজারো বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে চোখের সামনে মূর্ত করে তোলা। স্বপ্ন, একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার। যে জাদুঘর হবে তার নির্মিত শিল্পসামগ্রী দিয়ে ভরা। এসব দেখেই তরুণ প্রজন্মে জানবে, বুঝবে নিজেদের সমৃদ্ধ অতীত।
না-জানা ইতিহাস। তাদেরকে টেনে নেবে প্রাচীন কীর্তি, সংস্কৃতি...।
গোলকি বাড়িপাড়া থেকে বেরিয়ে গাড়ি যখন ঢাকামুখে রওনা হয়, ভাবি, সাংবাদিক-মিডিয়াকর্মীরা কত ভাগ্যবান। কত সহজে তারা মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারেন...।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।