আমাদের লোকসঙ্গীতের ভান্ডার অত্যান্ত বিচিত্র এবং সমৃদ্ধ। এ লোকসঙ্গীত প্রধানত চিত্রধর্মী। জীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্র রূপায়িত হয় লোকসঙ্গীতে।
বাংলাদেশে অনেক লোক শিল্পী রয়েছেন তারা প্রতিনিয়ত লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে সদা ব্যস্ত। তেমন একজন আবদুল গফুর হালী, একজন কিংবদন্তী লোকশিল্পী।
আবদুল গফুরের জন্ম ১৯২৯ সালে পটিয়ার রশিদাবাদে। বাবা, আবদুস সোবহান, মা গুলতাজ খাতুন। লেখাপড়া করেছেন রশিদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোয়ারা বিশ্বম্বর চৌধুরী উচ্চবিদ্যালয়ে।
রশিদাবাদ আরেক সাধকশিল্পী আস্কর আলী পণ্ডিতের গ্রাম। আস্কর আলীর গান শুনে বড় হয়েছেন গফুর।
ছোটবেলায় তাঁর আধ্যাত্মিক ও মরমি গান গফুরের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। ৫৪ বছর ধরে টানা লিখে চলেছেন আবদুল গফুর হালী। এখন তাঁর বয়স ৮০, এখনো গান লিখে ও গেয়ে দিন কাটান, চালান সংসার।
সোনাবন্ধু তুই আমারে করলি দিওয়ানা, রসিক তেল কাজলা কোন পাঞ্জাবিঅলা, মনের বাগানে ফুটিল ফুলগো, তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু মাছ মারিবার লাই,‘অ শ্যাম রেঙ্গুম ন যাইও, বানুরে অ বানু আঁই যাইমুব রেঙ্গুম শরত তোঁয়ার লাই আইন্যম কী, কিংবা মাইজভাণ্ডারী গান- দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে, কতো খেলা জানরে মাওলা, মাইজভাণ্ডারে কি ধন আছে এবং মোহছেন আউলিয়া গান- চল যাই জিয়ারতে মোহছেন আউলিয়ার দরবারে, আল্লাহর ফকির মরে যদি, ইত্যাদি শত শত কালজয়ী গানের রচিয়তা আবদুল গফুর হালী।
তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘মেঠো পথের গান’।
‘মেঠো পথের গান’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটিতে কিংবদন্তি লোকশিল্পী আবদুল গফুর হালীর জীবনের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে, ছবিটি ৩৯ মিনিটের। চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন শৈবাল চৌধুরী।
পটিয়ার রশিদাবাদ, চন্দনাইশের জোয়ারা ও দোহাজারী এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে ছবির বিভিন্ন অংশের চিত্রায়ণ করা হয়েছে। দেশের নামী-দামি বিভিন্ন শিল্পীদের গান ছবির উল্লেখযোগ্য অংশ। শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষ, কল্যাণী ঘোষ, কল্পনা লালা, সঞ্জিত আচার্য, শিমুল শীল, সেলিম নিজামী, শিরীন, নয়ন শীল প্রমুখ শিল্পীরা এই ছবিতে আবদুল গফুর হালীর উল্লেখযোগ্য গানগুলো পরিবেশন করছেন।
কারো কাছে গান না শিখলেও তার শিক্ষক ছিল চট্টগ্রামের প্রকৃতি, যা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে সৃষ্টিকর্মে, প্রেরণা পেয়েছেন আস্কর আলী পণ্ডিত ও রমেশ শীলের গান থেকে। আবদুল গফুর হালীর আঞ্চলিক গানের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। মাইজভান্ডারি গানও হাজারের বেশি হবে। ‘দুই কুলের সোলতান’, ‘দেখে যারে মাইজভান্ডারে’সহ অসংখ্য গান শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। তাঁর গান আরও গেয়েছেন, উমা খান, সঞ্জিত আচার্য, কান্তা নন্দী, শিল্পীরানী, আবদুল মান্নান রানা, সেলিম নিজামী ,শিমুল শীল, কল্যাণী ঘোষ, কল্পনা লালা ও সন্ধ্যারানী দাশ।
গফুর হালীর গানে আছে মাটির ছোঁয়া। আছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। গানের কথায় জড়িয়ে আছে ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতা।
হালীও বলেন, ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা মাটির সঙ্গে গাঁথা, এ ভাষার সঙ্গে এ এলাকার মানুষের নাড়ির টান। তাই আমার গানও এসব থেকে সৃষ্টি।
’
সত্তর ও আশির দশক ছিল আঞ্চলিক ও মাইজভান্ডারি গানের স্বর্ণযুগ। তাঁর লেখা সাড়া জাগানো বেশির ভাগ গান বিভিন্ন শিল্পীর গ্রামোফোন রেকর্ডে বেরিয়েছিল। ওই সময় হালী একটি দারুণ কাজ করেছেন। আর তা হলো আস্কর আলী পণ্ডিতের গান সংগ্রহ করে শেফালী ঘোষসহ বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে তুলে দেওয়া। এতে আস্কর আলীকে নতুন করে পান শ্রোতারা।
যশস্বী এই সঙ্গীতকার আবিষ্কার করেছেন অনেক কণ্ঠশিল্পীদের। তাঁর গান গেয়ে অনেক শিল্পী প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। শ্যাম-শেফালীর অনেক স্মরণীয় গানের স্রষ্টা গফুর হালী।
শুরুটা হয় নাটকীয় ভাবে - নিউ মার্কেটে ছোটখাটো একটা দোকান ছিল শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের। শ্যাম গানের মানুষ।
সে সূত্রে তাঁর দোকানে শিল্পীদের আড্ডা বসে সকাল-সন্ধ্যায়। সে আড্ডায় একদিন ঢুঁ মারেন গানের জগতে নবীন আবদুল গফুরও। শ্যাম দিলখোলা মানুষ, গফুরও তা-ই—দুজনের ভাব হতে সময় লাগে না। গ্রাম থেকে গান নিয়ে শহরে ছুটে আসেন গফুর। শ্যামের কণ্ঠে তা তুলে দেন।
চট্টগ্রাম বেতারে প্রচারিত হয় গানগুলো।
বেতারেই একদিন ধরে বসলেন শেফালী ঘোষ। বললেন, ‘উদা শ্যামরে দিলে অইতো ন, আঁরেও গান দেওন ফরিব (শুধু শ্যামকে দিলে তো হবে না, আমাকেও দিতে হবে)। ’
শেফালী বারবার তাগাদা দেন, আর গফুর ভুলে যান। তখনকার আঞ্চলিক পরিচালক (আরডি) আশরাফুজ্জামানকে নালিশ দেন শেফালী, ‘গফুরদা আমাকে গান দিচ্ছেন না।
’ আরডি ডেকে পাঠান গফুরকে। পাশে বসিয়ে চা খাওয়ান। এ কথা-সে কথা বলার পর শেফালীকে গান দিতে অনুরোধ করেন।
গফুর আরডিকে বললেন, ‘একটা দ্বৈত গান আছে। সেটা শ্যাম-শেফালীকে দিয়ে গাওয়ানো যায়।
’ গফুরের প্রস্তাব লুফে নেন আরডি। বলেন, আপনি কালই গানটা রেকর্ড করে দিন।
দুই দিন পর শ্যামসুন্দরের চকবাজারের বাসায় হাজির হন গফুর। শ্যামের সাইকেলে চড়ে পৌঁছে যান শেফালীর বাসায়। শ্যাম ও শেফালীর কণ্ঠে তুলে দেন সেই গান—
‘ন যাইও ন যাইও
আঁরে ফেলাই বাপের বাড়িত ন যাইও (ছেলে)
ন গইরজ্য ন গইরজ্য
বাপর বাড়িত যাইতাম মানা ন গইরজ্য (মেয়ে)।
’
বেতারে প্রচারের পর আলোড়ন তুলল গানটি। শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষের নাম ছড়িয়ে পড়ল হাটে-মাঠে।
এর আগে মলয় ঘোষ দস্তিদারের ‘নাইয়র গেলে আইস্য তারাতারি’সহ দু-একটা দ্বৈত আঞ্চলিক গান গেয়েছিলেন শ্যাম-শেফালী। কিন্তু ‘নাইয়র’ গানটির দারুণ জনপ্রিয়তা আঞ্চলিক গানে নতুন ধারা সৃষ্টি করল। প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন জুটি—শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষ।
এই একটি গান গফুরের জীবনের মোড়ও ঘুরিয়ে দেয়। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন তিনি। সংগীতজীবন শুরু করেছিলেন শিল্পী হিসেবে। খ্যাতিমান হলেন গীতিকার ও সুরকার হিসেবে। এটা ১৯৬৪ সালের ঘটনা।
সেই থেকে এখনো গানের সঙ্গেই তাঁর ঘরবসতি।
-----------------------------------
বাংলার লোকসঙ্গীতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে বিশেষভাবে অধিষ্ঠিত করেছে। এসব গান কালের সীমা অতিক্রম করে পৌঁছে গেছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এবং বেশ আদৃত হচ্ছে। আবদুল গফুর হালী প্রথম মোহছেন আউলিয়াকে নিয়ে গান রচনা করেন। চট্টগ্রামের ভাষায় প্রথম লোকনাটকের রচিয়তাও আবদুল গফুর হালী।
জার্মানির হালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতবর্ষবিষয়ক দর্শন শাস্ত্রের সহকারী অধ্যাপক হানস হারডার (বর্তমানে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) ১৯৮৯ সালের দিকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারসহ বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। পরে শিল্পী কল্যাণী ঘোষের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে। তাঁর জীবন ও গান নিয়ে ২০০৪ ডার ফেরুকটে গফুর, স্প্রিখট (পাগলা গফুর, বলে) নামে একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এতে হালীর ৭৬টি গান অন্তর্ভুক্ত হয়।
এগুলোকে আবদুল গফুর হালী রচিত পূর্ববাংলার মরমি গান বলে উল্লেখ করেছেন হানস হারডার। তিনি আবদুল গফুর হালী সম্পর্কে লেখেন, ‘আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি বা উপাধি না থাকলেও নিজের চেষ্টায় তিনি অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নিজেকে শুধু বাংলা সাহিত্যের দিকে সরাসরি ধাবিত করেননি। প্রায় প্রতিদিনই তিনি মাইজভান্ডারি গান রচনা করেন।
-----------------------------------
এই গুনী শিল্পীকে দেখার এবং গান শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে হঠাৎ করেই।
পটিয়ার রশীদাবাদে বেড়াতে গিয়ে শুনি আমাদের জন্য বাউল গানের আয়োজন করা হয়েছে। গান পরিবেশন করার আগে উনি খুব নম্রভাবে নিজের নাম বলেন, সাথে থাকা নিজের নাতি-নাতনির পরিচয় করে দেন। গান ওরাই গাইবেন কারণ বয়সের কারণে সেভাবে আর গান করতে পারেন না। অনুরোধের গান তারা করবেন সেই সাথে পরিবেশন করবেন নিজের লেখা কিছু গান। এই বলে যখন গান শুরু হয় অবাক হয়ে শুনে যাই মানুষের মুখে মুখে ফেরা কিছু জনপ্রিয় গান, যেমন - সোনা বন্ধু তুই আমারে করলি দেওয়ানা, পাঞ্জাবীওয়ালা, মনের বাগানে ফুটিল ফুলগো রসিক ভ্রমর আইল না, তখন আমাদের অবাক হবার পালা, এই গান গুলি উনার লেখা !!!!!
অনেক মাইজভান্ডারী গান এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান একের পর এক গাইতে থাকলেন তারা, যে গানগুলি আমাদের চট্টগ্রামে অনেক অনেক জনপ্রিয়।
সেদিন বুঝলাম আমাদের দেশে গীতিকাররা কি ভীষণভাবে অবহেলিত। আমরা আবারো যাব কিছু এমন গান পাগল বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। শেষ করছি আরেকটি তথ্য দিয়ে -
১৯৭০-এর নির্বাচনে গান গেয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তখন। গফুর হালী চট্টগ্রাম শহরে গিয়েছিলেন কেরোসিন কিনতে।
ফেরার সময় রৌশনহাটে ধরল রাজাকারেরা। বলল, ‘তুমি তো নির্বাচনে নেতার বিরুদ্ধে গান করেছ। গানের মজা এবার বোঝাব। ’ তাঁর গানের একজন ভক্ত সেদিন তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন।
পরে কালুরঘাটে আরেকবার পেয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা।
ঘাড়ে বন্দুকের বাঁট দিয়ে এমন মার দিয়েছিল যে মনে হয়েছিল, ঘাড়টা বুঝি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। স্রেফ বুদ্ধির জোরে সেদিন পালাতে পেরেছিলেন গফুর হালী।
আবদুল গফুর হালী সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেননি। তবে ক্যাম্পে গিয়ে গান গেয়ে উদ্দীপ্ত করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তাঁরা হালীর একটি গান খুব পছন্দ করতেন।
সেটি হলো, ‘তোর লয় আঁর লয় ন অইব অভাই/আঁই বাঙালি, তুই পাঠান/তোর দেশে আর আঁর দেশে/দুই হাজার মাইল ব্যবধান। ’
---------------------------------
শেষ গান হিসেবে নিজের লেখা গানটি গেয়ে ওঠেন ‘কোন সাধনে তাঁরে পাওয়া যায়। ’
গাইলেন- তাঁর জন্য মোর মন উদাসী ঘরে রব আমি কার আশে / আমায় নিয়ে চলরে সখি আমার বন্ধু যে দেশে। ’
শেষ কথা -"তাঁকে পাওয়ার জন্যই আমার সব সাধনা,তাঁকে আমার পাইতেই হবে। "
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।