যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই
আজ আমি নিজের অসহায়ত্ব এবং ব্যর্থতার একটি সত্য ঘটনা বর্ণনা করবো। অনেক বছর আগে ঘটনা, সেই দিন আমি লালমাটিয়া থেকে বাসায় ফিরছিলাম। ব্যস্ত নগরীর ভর দুপুরবেলা, স্কুল কলেজের মাত্র ছুটি হয়েছে। রাস্তায় প্রচণ্ড ট্র্যাফিক জ্যাম। হঠাৎ আমার রিক্সাটির আগের রিক্সার সামনে একটি সাদা প্রাইভেট কার এসে ব্রেক কষলো, যেন অনেকটা হিন্দি সিনেমার স্টাইলে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন যুবক গাড়ি থেকে নেমে গগণভেদী চিৎকার করতে করতে রাস্তার পাশের দেয়ালকে উদ্দেশ্য করে নিজ হাতের রিভলবার থেকে ফাঁকা গুলি ছুড়লো। গাড়ি থেকে সেই সময় প্রায় একই বয়সের আরও দুজন যুবক নেমে আসলো। তাদের একজনের হাতে কাঁটা রাইফেল ও অন্যজনের হাতে একটি রিভলভার। যুবকদের একজন চিৎকার করে আশে পাশের মানুষদের হুমকি দিয়ে জানিয়ে দিলো কেউ যেন সামনে না আসে; সামনে আসলেই তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। আশে পাশের মানুষজন ধরে নিল এটা হয়তোবা কোন ছিনতাই বা রাহাজানির ঘটনা।
আমি সেই রিক্সার ঠিক পেছনে থাকার কারণে সব কিছু স্পষ্ট দেখতে ও শুনতে পাচ্ছিলাম। তাদের মধ্যে একজন পুনরায় একটি ফাঁকা গুলি ছুড়লো, আমার কানের পর্দা যেন ফেটে গেল গুলির শব্দে। কান দু হাতে চেপে ধরে বিস্ফোরিত চোখে সামনের রিক্সার দিকে চেয়ে রইলাম। দেখলাম, ঐ তিন যুবকদের একজন আমার সামনের রিক্সা থেকে একটি সুন্দরী মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে নামালো আর মেয়েটিকে বলল, পালাইতে চাস,পালাইয়া যাবি কই? কানের নীচে গুলি কইরা মাইরা ফালামু, একটা কথাও কইবি না।
মেয়েটি তখন অসহায়ের মত হাউমাউ করে কাঁদছিলো।
তাকে ছেড়ে দেবার জন্য হাতে পায়ে ধরে মিনতি করছিলো। রিকশায় সেই মেয়েটির সঙ্গে আরো একজন বয়স্ক মহিলাও ছিলো।
সেই বয়স্ক মহিলা রিকশা থেকে নেমে আসলো আর যুবকদের বলছিলো, ''যাক সময় মত আইসা গেছো। এইডা যাতে পলাইতে না পারে হের লাইগা আমি সঙ্গে আইছিলাম, ওরে তাড়াতাড়ি গাড়িতে তোলো। ওর কত্ত বড় সাহস!! আইজকা ওরে পলানো কারে কয় শিখাইতেছি''।
তারপর সবাই মিলে মেয়েটিকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুললো ও দ্রুত এলাকা ত্যাগ করলো। আমি সহ আশেপাশের সব মানুষেরা নির্জীব পাথরের মতো পুরো ঘটনাটা শুধু দেখে যাচ্ছিলাম। পিছনের রিকশা থেকে একজন বলে উঠলো, বোধহয় বিয়া বাড়ি থেইক্কা পাত্রী ভাইগা আইছিলো। আমারা কেউ কিছুই করতে পারলাম না, শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া। যাদের কাছে মোবাইল ছিলো তারা কোথায় পুলিশকে খবর দেবে তা নয়; উল্টো বরং উটকো ঝামেলা মুক্ত হতে চাইলো।
সেই সঙ্গে কারো গায়ে গুলি লাগেনি বলে যারপর নাই খুশী হলো। আমি বোকার মত রিক্সায় বসেছিলাম। একসময় আমার রিক্সা সামনের দিকে এগুতে শুরু করলো।
কিছুদূর যাওয়ার পর রিক্সাওয়ালা আমাকে জিগ্যেস করলেন, কি হইছে কিছু বুঝবার পারছেন আপা?
আমি বললাম, বোধহয় মেয়েটি বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলো।
রিক্সাওয়ালা বললেন, আরে আপনি দেখি একটা আস্ত বেক্কল মেয়ে মানুষ!!!
রিক্সাওয়ালা আরো বললেন, মনে হয় এই মাইটারেও বেইচ্চা দিছে।
আমি তার কথা শুনে হতভম্ভ হয়ে গেলাম।
রিক্সাওয়ালা আরো বললেন , মনে হয় মাইয়টা পলাইতে চাইছিলো। তারে পলানের পথে ধইরা আবার আগের আস্তানায় ফেরত নিলো।
আমি তখন রিক্সাওয়ালাকে বললাম, চলেন থানায় যাই, পুলিশকে খবর দেই।
রিক্সাওয়ালা বললেন, আপা আপনার কি মাথা খারাপ হইছে? এইগুলান কি পুলিশ জানেনা মনে করছেন? এইরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে এই এলাকায়।
যেই মস্তানগুলারে দেখলেন হেরা এই এলাকার অনেক বড় মস্তান। এলাকার এমপির ডাইন হাত। সবাই জানে এইসব ঘটনা, খালি আপনে জানেন না। আর থানায় গেলে আপনে একলা যান, আমি যামু না। থানায় ভালা মানুষ যায় নাকি? আমার বউ বাচ্চা আছে, জানের মায়া আছে।
কাইলকা আমি মরলে আমার পরিবাররে কেডা খাওয়াইবো? আপনের মরণের খায়েশ থাকলে আরেকটা রিকশা লইয়া থানায় যান। আমার ভাড়া মিটায় দেন।
বলার অপেক্ষা রাখেনা, আমারও রিকশাওয়ালার মতো প্রানের মায়া আছে। রিক্সাওয়ালার কথা শুনে সেদিন আর থানায় যাইনি। গিয়ে কোন লাভ হতো কিনা তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
আসলে আমি নিজের ব্যর্থতায় নিজেই মুখ থুবড়ে পড়েছি। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কোন না কোন সময় ব্যর্থতার চাপে পিষ্ট হতে বাধ্য হয়, আমিও তাদের ব্যতিক্রম নই। আমিও সেই ব্যর্থ এবং স্বার্থপর মানুষদের একজন। এখনও আমি মাঝে মাঝে সেই মেয়েটি আর্তঃচিৎকার ঘুমের মধ্যে শুনতে পাই। আর নিজের না পারার লজ্জায় ডুবে যাই।
সেই দিনের সেই অসহায় মেয়েটি আমিও হতে পারতাম!! যার চিৎকার লোকে শুনতো ঠিকই, কিন্তু পাশে দাঁড়াবার কেউ থাকতো না।
ফারজানা কবীর খান (স্নিগ্ধা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।